ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পর্যটন

আমের হাট যেনো জীবন্ত যাত্রাপালা

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২১৯ ঘণ্টা, জুন ২, ২০১৮
আমের হাট যেনো জীবন্ত যাত্রাপালা আমের হাট যেনো জীবন্ত যাত্রাপালা। ছবি: বাংলানিউজ

বানেশ্বর (রাজশাহী) থেকে: জেলার সবচেয়ে বড় এবং প্রসিদ্ধ আমের হাট বানেশ্বর। বৈচিত্র্যময় এই হাটে একই দিনে তিনবার বিক্রি হয় একই আম। দৃশ্যপট অনেকটা গ্রাম্য যাত্রাপালার মতো।

ভোরে আম নিয়ে হাটে আসেন চাষিরা। দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলে সেই বেচা-কেনা।

এ সময়ে সাধারণত প্রধান ক্রেতা ফড়িয়ারা। এ পর্যায়ে আম বেচাকেনা হয় ঠিকা অনুযায়ী। চাষিরা আন্দাজ করে খাঁচিতে ভরে আম নিয়ে আসেন বাজারে। আর ফড়িয়ারাও ঠিকা অনুযায়ী কিনে নেন। এ সময় ওজন বিবেচ্য হয় না।

এই ধাপে কিছু বিষয় লক্ষ্যণীয়, তা হচ্ছে বিক্রেতারা সবটুকু একসঙ্গে বিক্রি করে থাকেন। যদি পাঁচ খাচি আম এনে থাকেন তাহলে সবটুকুই কিনে নিতে হবে। বাড়তি দাম সাধলেও কেউ বিক্রি করবেন না। অর্থাৎ বিক্রেতার সবটুকু, হতে পারে বিশ কিংবা ত্রিশ মন সবটুকু একবারে নিতে হবে। এ কারণে অনেকের আগ্রহ থাকলেও প্রকৃত চাষির কাছ থেকে তুলনামুলক কম দামে আম কেনার সুযোগ থাকে না। আমের হাট যেনো জীবন্ত যাত্রাপালা।  ছবি: বাংলানিউজপ্রথম ধাপের ক্রেতা হচ্ছেন স্থানীয় ফড়িয়ারা যারা আশপাশের গ্রামের বাসিন্দা। যারা পরস্পর পরস্পরের পরিচিত। এ সময় কেনাবেচায় অনেক দরাদরি লক্ষ্যণীয়। শুক্রবার (১ জুন) সকালেও প্রায় এক মণ ওজনের একটি লক্ষণভোগ আমের খাচি নিয়ে দরদাম চলছিলো। ক্রেতা অনেকটা জোর করেই ৭শ’ টাকা গুজে দিতে চাইছেন চাষির পকেটে। কিন্তু চাষি কিছুতেই ৯শ’ টাকার নিচে বিক্রি করবেন না।

চাষিকে আরও ৫০ টাকা বাড়িয়ে দিয়ে আবার তা গুজে দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু চাষি আবারও টাকা হাতে নিতে অসম্মতি জানান। এবার ক্রেতা বলেন, ‘তোমার আম দাম ৮শ’ টাকা। সাড়ে ৭শ’ টাকা দিয়ে নিচ্ছি, ওই পঞ্চাশ টাকা আমার লাভ। ’ চাষি তবু না সূচক জবাব দেন। তখন ক্রেতা খানিকটা কৌশলী অবস্থান নিয়ে বিক্রেতাকে কাবু করার চেষ্টা করেন। বলেন, ‘আমারও তো সংসার আছে, নাকি?’

এরপর ক্রেতার অপর সঙ্গীর আর্বিভাব। বললেন, ঠিক আছে ৮শ’ টাকা দিয়ে দাও। ভাই (বিক্রেতার উদ্দেশ্যে) তুমি আর কথা বলিও না। তোমার এই আম দিয়ে আমরা বউনি করছি। যে কারণে বেশি দাম দিচ্ছি। তবুও অনড় বিক্রেতা ৫০ টাকা কমিয়ে সাড়ে ৮শ’ দাম হাকেন। এরপর প্রায় মিনিট দশেক দরাদরির পর ৮২৫ টাকায় দফা হয় সেটাও অনেকটা ক্রেতার জোরাজুরিতেই।

এই পর্যায়ে বেচাকেনায় অনেকটা অধিকার খাটানোর প্রভাব দেখা যায়। ক্রেতার অভিমানও ভাঙাতে হয় বিক্রেতাকে। পরিচিত এই ক্রেতারা নিজের সংসার ও ছেলেমেয়ের দোহাই দিয়েও দাম কম দেওয়ার চেষ্টা করেন। এই বিড়ম্বনা এড়াতে অনেক চাষিই ‘দৃঢ় মানসিকতা’র মানুষকে ‘ভাড়া’ করেন আমের পাশে দাঁড়িয়ে দরাদরি করার জন্য।

তিন খাচি হিমসাগর আমের দরদাম চলছিলো। তখন পাশেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছেন মাহফুজার রহমান রানা। অনেকক্ষণ দরাদরির পর প্রথম ক্রেতা চলে গেলেন। আরেকজন ক্রেতা এসে ২৪শ’ টাকা দিয়ে দরদাম শুরু করেন, শেষ পর্যন্ত ২৮শ’ টাকায় কিনে নিলেন।

যিনি এতোক্ষণ বিক্রেতা সেজে ক্রেতার সঙ্গে দরাদরি করে আম বিক্রি করলেন, ক্রেতা চলে যাওয়ার পর তিনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা রানার হাতে গুজে দিলেন টাকা। রানাও মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, ‘এজন্য আমের পাশে দাঁড়াই না। ওরা এমন নাছোড়বান্দা কম দেবেই। এ পর্যায়ের কেনাবেচা অনেকটা মঞ্চ নাটকের মতো। এখানে কে ভিলেন কে নায়ক বোঝা কঠিন’।

১২টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে দ্বিতীয় ধাপে বেচাকেনা। এ ধাপে বিক্রেতা ফড়িয়ারা। আর ক্রেতা হচ্ছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বড় ব্যাপারিরা। ফড়িয়াদের জমা করা আমের স্তূপ ঘুরে ঘুরে আম কেনেন ব্যাপারিরা। এ ধাপে আমের দর আর ঠিকা অনুযায়ী হয় না। ওজন করে বিক্রি করা হয়। ব্যাপারির চাহিদা অনুযায়ী আম সরবরাহ করে থাকেন ফড়িয়ারা।

আবার আরেক শ্রেণির লোক রয়েছেন, যারা ফড়িয়াদের কাছ থেকে কিনে প্রকৃত ভোক্তার কাছে বিক্রি করেন। এই শ্রেণির বিক্রেতারা সকাল থেকেই মধ্যরাত পর্যন্ত কখনও সারারাত ধরেই পসরা সাজিয়ে থাকেন। নাইট কোচের যাত্রীদের কাছে আম বিক্রি করার জন্য।

হাত বদলের এই প্রক্রিয়ায় আমের দাম মণপ্রতি দেড়শ’ থেকে ৫শ’ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। সকালে যে লক্ষণভোগ সাড়ে ৮শ’ টাকা মণ দরে বিক্রি হলো, সেই লক্ষণভোগ খুচরা কিনতে গেলে বিক্রেতা দাম হাঁকালেন ৫০ টাকা কেজি। অর্থা প্রতিমণের দাম গিয়ে ঠেকলো ২ হাজারে গিয়ে।

বাংলাদেশ সময়: ০৮১৮ ঘণ্টা, জুন ০২, ২০১৮
এসআই/এইচএ/

...

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।