সেতুর গোঁড়ায় সুন্দর সিঁড়ি করা। পর্যটকরা চাইলে অনেক নিচ পর্যন্ত নামতে পারেন।
পাহাড় দেখতে দেখতে গরম চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। ঝির ঝির বৃষ্টি আমাদের পারিবারিক আনন্দে নতুন মাত্রা যোগ করলো। মোঘোটোক সেতু নাকি বেশ বিখ্যাত। কেননা এখানেই কোরবান নামক হিন্দি সিনেমার কোনো একটি বিখ্যাত গানের দৃশ্যায়ন হয়েছে। হিন্দি সিনেমা দেখার অভ্যাস না থাকায় এই তথ্য অবশ্য আমাকে বেশি পুলকিত করতে পারলো না!মেঘালয়ের পাহাড়ি আঁকা-বাঁকা রাস্তা আমাদের নিয়ে গেছে অনেক জায়গায়। পুরো পথই এতো সুন্দর যে বারবার থামতে ইচ্ছে হয়। মেঘ, পাহাড়, উপত্যকা, নদী আর ঝরনার পাশাপাশি আছে সবুজ জঙ্গল। সেখানে অসংখ্য প্রজাতির বৃক্ষরাজি, নানান বর্ণের ফুলের সমাহার।
এখানেই শেষ নয়। মেঘালয়ের পাহাড় চুনা পাথর আর কয়লাসহ নানা রকম পাথরের খনি। পাহাড় কেটে পাথর সংগ্রহ করা এখানকার অন্যতম জীবিকা। চাষাবাদের প্রচলন খুব কম। চলার পথে থেকে থেকে তাই চোখে পড়ছিল সাদা রঙের পাহাড়। চুনা পাথরের জন্য খুঁড়তে খুঁড়তে সেগুলো নানা রকম অদ্ভুত আকৃতি ধারণ করেছে।
সবুজে ঢাকা পাহাড়গুলোও পাথরের খনি। সেগুলোর বুক চিরে বের হয়ে আছে নানা আকৃতির কালো পাথর। নদীর পানিতে ভেসে মেঘালয়ের পাথর চলে যায় বাংলাদেশে। সিলেট-মেঘালয় সীমান্তে পাথর উত্তোলনের যে জমজমাট কারবার সেগুলোর উৎস এখানেই। মেঘালয়ের পাহাড়ের বুকের ভেতরেও রয়েছে এক আশ্চর্য জগৎ। বলছি মাওসমাই গুহার কথা। আমরা যখন সেখানে পৌঁছালাম তখন বিকেল নেমেছে। জঙ্গুলে একটা জায়গা। ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে। গুহায় ঢুকবো নাকি ঢুকবো না এ নিয়ে আমরা আরেকটি বাংলাদেশি পরিবারের সঙ্গে কথা বলছিলাম। তাদের সঙ্গে দুটো ছেলে শিশু আছে যাদের একজন প্রমিতির চেয়ে একটু বড় আরেকজন ছোট। আমার ঢোকার ইচ্ছা ছিল একশ ভাগ। কিন্তু শিশুদের নিয়ে একটু চিন্তা হচ্ছিল। মাত্র গুহা থেকে বের হয়ে আসা এক ভারতীয় দম্পতি নিজ থেকে এগিয়ে এসে বললেন, গুহাটা ছোট, ঘুরতে দশ-বারো মিনিটের বেশি লাগবে না। কিন্তু এই অল্প সময়টুকুতেই অসাধারণ অভিজ্ঞতা হবে। আর শিশুরাও স্বাচ্ছন্দ্যেই গুহায় হাঁটতে পারবে। আমরা দুই পরিবার একসঙ্গে গুহায় ঢুকলাম। সত্যিই সে এক অন্য জগৎ। মেঝে থেকে শুরু করে ছাদ পর্যন্ত পুরোটাই পাথরের তৈরি। ছাদ আর দেয়াল চুঁইয়ে অবিরাম পানি গড়িয়ে পড়ছে। কোনো কোনো জায়গায় বাথরুমের শাওয়ারের মতো ভিজিয়ে দিচ্ছে। পুরো গুহার মেঝেতে তাই গোঁড়ালি সমান পানি। পানিতে ভিজতে ভিজতে গুহা জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পাথর অদ্ভুত আকৃতি ধারণ করেছে।
গুহাটা চওড়ায় খুবই ছোট। পাশাপাশি দু’জন মানুষ হাঁটতে পারে না। কোনো কোনো জায়গায় পাথর বেয়ে একটু উপরে উঠে আবার নিচে নামতে হয়। কোথাও গুহা এতো সরু যে ভারি শরীরের মানুষ পার হতে পারবেন না। আমাদের সঙ্গী পরিবারটির একজন বয়স্ক সদস্য ভিতরে ঢুকেই বের হয়ে গেছেন। বদ্ধ গুহায় তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে আমাদের গুহাযাত্রার নের্তৃত্ব দিল আমাদের তিন শিশু!তারা মহা উৎসাহে চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সবার আগে হাঁটছে। আমার বর অমিত তাদের তিনজনকে দেখে-শুনে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ইচ্ছা থাকলেও পেছন থেকে তাকে বেশি সাহায্য করতে পারছি না। কেননা পাশাপাশি হাঁটার যে কোনো উপায় নেই! তাছাড়া নিজেরইতো হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। গুহার ভেতর আলোর ব্যবস্থা আছে। কিন্তু প্রাকৃতিক আলো না ঢোকায় একটু অন্ধকারাচ্ছন্ন। প্রতিটা বাঁক পার হওয়ার সময় ভাবছিলাম বোধহয় এখানের গুহা শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু সামনে মিলছিলো আরেকটা বন্ধুর পথ। একদিকে দারুণ অ্যাডভেঞ্চার হচ্ছিল, আবার বেশ গা ছমছমও করছিল। ভয় তাড়াতে আমরা জোরে জোরে কথা বলছিলাম।
অদ্ভুত কিছু দেখলে অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিলাম। সত্যি সত্যি এক সময় আমরা গুহার শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেলাম। বাইরে আলোর আভাস দেখে মনে হচ্ছিলো এতো সুন্দর দিন এর আগে কখনো দেখিনি! পাথরের ফাঁক গলে গুহার ভেতরে আলো ঢুকেছে। সে যে কী সুন্দর দৃশ্য। আমরা সবাই হৈ হৈ করে উঠলাম। আমাদের আনন্দ কলরোল গুহার দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো।
আমি, অমিত আর প্রমিতি, আমাদের তিনজনের ছোট দল। আমরা চেষ্টা করেছি অনেক অ্যাডভেঞ্চারাস না হয়ে প্রতিটি মুহূর্তকে একটি পরিবার হিসেবে উপভোগ করার। তারই একটি নমুনা ওয়াকাবা ফলস এলাকা ভ্রমণ। জায়গাটা পাহাড়ের অনেক উপরে কুয়াশার মতো মেঘে ঘেরা। সেখান থেকে সিঁড়ি নেমে গেছে অনেক নিচে। যদিও জঙ্গল আর কুয়াশার কারণে ঠিক কতটুকু নিচে তা বোঝা যায় না। সেখানেই নাকি আছে দারুণ সুন্দর ওয়াহকাবা ফলস। যদিও এটা মেঘালয়ের অন্যতম বিখ্যাত ঝরনা কিন্তু প্রমিতিকে নিয়ে আমাদের এতো নিচে নামার মোটেই ইচ্ছা নেই। আমরা তাই পাহাড়ের উপর মেঠোপথ ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। ঝকঝকে সুন্দর সকাল। বেশ ভালো লাগছিল। ওমা কিছুদূর যেতেই দেখি ছোট্ট একটা ঝরনা। এটির মতো অনেকগুলো ঝরনা একত্রে মিলে নিচের বড় ঝরনাটা তৈরি হয়েছে। প্রমিতি দারুণ খুশি। সে তার জন্য যথাযথ আকৃতির ঝরনা পেয়েছে। আর আমি বরাবরই পাহাড়ি ছড়া বড্ড ভালোবাসি। আমরা তিনজন সেই ঝরনার পানিতে ইচ্ছেমতো হাঁটাহাঁটি করলাম। পা ভেজালাম। পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকলাম। তারপর হাসিমুখে রওয়ানা হলাম আরেকটা নতুন স্পটের উদ্দেশ্যে।
চলবে….
বাংলাদেশ সময়: ১০৪১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০১, ২০১৮
এএ