ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পর্যটন

ব্ল্যাক ম্যাদোনার খোঁজে (পর্ব-২)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০১৮
ব্ল্যাক ম্যাদোনার খোঁজে (পর্ব-২) ব্ল্যাক ম্যাদোনার খোঁজে (পর্ব-২)

বার্সেলোনা শহর বিশ্বের কাছে ভালোভাবে পরিচিত হয় ১৯৯১ অলিম্পিকের সময়। তারপর থেকে সারা পৃথিবীর ভ্রমণপিপাসুদের কাছে এটি একটি আকাঙ্ক্ষিত গন্তব্য। আমরা বার্সেলোনায় গিয়েছিলাম চার দিনের জন্য, মনসেরাত ব্যাসিলিকা ছিল অন্যতম আকর্ষণ। কিন্তু প্রথম যেদিন মনসেরাত গিয়েছিলাম সেদিন সময় স্বল্পতার জন্য ব্যাসিলিকায় ঢুকতে পারিনি, তাই একদিন পর আবার রওনা হলাম। এবার ট্রেনে যাত্রা। 

ইউরোপের অনেক দেশেই ইংরেজির প্রচলন নেই, তাই ট্যুরিস্টদের মাঝে মাঝে বিপাকে পড়তে হয়। শহর বা রাস্তার নাম ইংরেজিতে লেখা থাকলেও স্থানীয় লোকজন ইংরেজি ভাষা একেবারেই ব্যবহার করেন না।

ইংরেজি বলা বা বোঝার ক্ষেত্রেও তারা বিশেষ পটু নয়। তাই মনসেরাত যাওয়ার ট্রেন খুঁজে পেতে একটু অসুবিধাই হয়েছিল।  

বার্সেলোনা থেকে মনসেরাত ব্যাসিলিকা পর্যন্ত ট্রেন আছে। প্রায় দেড় ঘণ্টা লাগে পৌঁছাতে। ট্রেন চলতে শুরু করলো। শহর ছাড়িয়ে একসময় ট্রেন খাঁড়া পাহাড়ি পথ ধরলো। একের পর এক পাহাড়সারি পার হয়ে উপরে উঠছে ট্রেন, নিচে দেখা যাচ্ছে মোটা ফিতের মতো রাস্তা, খেলনার মতো ঘরবাড়ি।  
ব্ল্যাক ম্যাদোনার খোঁজে (পর্ব-২)বেশ কিছুটা ওঠার পর একটি স্টেশনে ট্রেন থামলো, সেখান থেকে আরেকটা ট্রেনে চড়ে আমরা সোজা ব্যাসিলিকায় পৌঁছলাম।  

সেদিন সকাল সকাল পৌঁছানোয় প্রচুর ট্যুরিস্টের সমাগম দেখা গেলো। ব্যাসিলিকার বাইরের চত্বরে দাঁড়াতে একপাশে পাহাড়ের অদ্ভুত পাথুরে স্তম্ভগুলো দেখে মনে হচ্ছিল যেন ব্যাসিলিকার পাদ্রিরা সব ধ্যানস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমরা বাইরে বেশিক্ষণ না দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি ভেতরে ঢুকলাম, আজ আর ম্যাদোনাকে মিস করা যাবে না। কিন্তু ব্যাসিলিকার ভেতরের চত্বরে (একে বলে অট্রিয়াম) আজ ভীষণ ভিড়, ‘এল’ আকৃতির বারান্দাজুড়ে লম্বা লাইন ব্যাসিলিকার মূল দরজা পর্যন্ত। আমরাও লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম।
ব্ল্যাক ম্যাদোনার খোঁজে (পর্ব-২)এই ব্ল্যাক ম্যাদোনা বা কুমারী কালো মেরীকে নিয়ে অনেক চমকপ্রদ গল্প প্রচলিত রয়েছে। ধারণা করা হয় এই কালো মেরির মূর্তি তৈরি হয়েছিল জেরুজালেমে। খ্রিস্টধর্মের উত্থানের একদম শুরুর দিকে। এই মূর্তি উপহার দেওয়া হয়েছিল বার্সেলোনার বিশপকে, যিনি এই কুমারী মেরিকে বার্সেলোনায় নিয়ে এসে স্থাপন করেন। সপ্তম শতাব্দীতে বার্সেলোনায় বহির্দেশের শত্রুরা আক্রমণ করে, তখন এই কালো মেরিকে তার উপাসকেরা মনসেরাত পাহাড়ের কোনো এক গুহায় লুকিয়ে রাখেন।
ব্ল্যাক ম্যাদোনার খোঁজে (পর্ব-২)প্রায় দুশো বছর এই ব্ল্যাক ম্যাদোনা পাহাড়ের গুহায় লুকিয়ে ছিলেন, অনেকে ভুলেও গিয়েছিল তার কথা। মনসেরাত পাহাড়ের গোড়ায় বাস করতো কিছু মেষপালক যারা পাহাড়ে তাদের ভেড়া চরাতে যেত। নবম শতাব্দীর কোনো একদিন তারা পাহড়ের ওপর ভেড়া চরাতে গিয়ে দেখতে পায় একটা গুহা থেকে ঠিকরে আলো বের হচ্ছে। সেই সঙ্গে তারা শুনতে পায় অদ্ভুত সংগীত, কিন্তু কোথা থেকে এই গান ভেসে আসছে তার কোনো হদিশ তারা পায় না।  

স্বাভাবিকভাবেই মেষপালকেরা ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। এমন সময় তারা দৈববাণী শুনতে পায় কেউ যেন তাদের গুহার ভেতরে যেতে বলছে। ভীত সন্ত্রস্ত মেষপালকেরা কোনোক্রমে সাহস সঞ্চয় করে গুহায় ঢোকে এবং পাথরের খাঁজের আড়ালে লুকানো ব্ল্যাক ম্যাদোনাকে দেখতে পায়।
ব্ল্যাক ম্যাদোনার খোঁজে (পর্ব-২)এই চমকপ্রদ খবরটি মেষপালকেরা তাদের গ্রামের প্রধান ধর্মযাজককে দেয় এবং তিনি সদলবলে সেই পাহাড় গুহায় যান মেরিকে দেখতে। তাকে গুহা থেকে নামিয়ে এনে একটি ছোট গির্জায় স্থাপন করেন। এমন কথা প্রচলিত আছে যে ধর্মযাজকেরা চেয়েছিলেন কালো মেরিকে আবার বারসেলোনায় নিয়ে যেতে প্রথমে তিনি যেখানে ছিলেন সেখানে। কিন্তু ভীষণ ভার এই মূর্তি কাঁধে নিয়ে উঁচুনিচু পাহাড়ি পথে চলতে বাহকদের খুব কষ্ট হচ্ছিল।

তখন সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে মেরিকে এই পাহাড়েই স্থাপন করা হবে, তিনি বোধহয় এই মনসেরাত পাহাড়ের মায়া ছেড়ে কোথাও যেতে চাইছেন না। সেই থেকে ব্ল্যাক ম্যাদোনা মনসেরাতে আছেন। এই ব্ল্যাক ম্যাদোনা ক্রমে মনসেরাতবাসীর কাছে ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। দূর-দূরান্তে তার অলৌকিক শক্তির কথা ছড়িয়ে পড়ে। অনেক দূর থেকে ভক্তরা আসেন মেরির কাছে তাদের মনস্কামনা নিয়ে, অনেকেরই প্রত্যাশিত মনস্কামনা পূরণ হওয়ায় তাদের বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়ে ওঠে।  
ব্ল্যাক ম্যাদোনার খোঁজে (পর্ব-২)১৫৯২ সালে ব্ল্যাক ম্যাদোনার ছোট্ট গির্জাটিকে ব্যাসিলিকায় রূপদান করা হয় এবং তারপর থেকে কালে কালে অনেক পরিবর্তনের মাধ্যমে এই ব্যাসিলিকা আজকের এই রূপ লাভ করে। আজও ‘ব্ল্যাক ম্যাদোনা অব মনসেরাত’ বা মনসেরাতের কালো মেরি তীর্থযাত্রী ও দর্শনার্থীদের কাছে ভীষণ জনপ্রিয়। অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে এই মেরির মূর্তি কালো কেন? 

মূর্তিটি ওক কাঠের তৈরি, ধারণা করা হয় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মোমের ও মশালের ধোঁয়ায় এর রং এমন কালো হয়ে যায়। অবশেষে আঠারো শতকে মেরিকে কালো রঙেই রাঙানো হয়। এই মূর্তিটি বাইজেন্টাইন স্টাইলে বানানো। স্প্যানিশ ভাষায় এই মেরিকে বলা হয় ‘লা মরেনেটা’ যার বাংলা মানে করলে দাঁড়ায় ‘ছোট্ট কালো মূর্তি বা ছোট্ট কালো মানুষ’।

তো আমরা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম, আস্তে আস্তে লাইন এগোচ্ছে, মুগ্ধ হয়ে ব্যাসিলিকার স্থাপত্য দেখছি। এটি কিছুটা গথিক আদলের সঙ্গে স্প্যানিশ স্থাপত্যরীতি মিলিয়ে বানানো। একসময় ব্যাসিলিকার মূল কক্ষে প্রবেশ করলাম। ভেতরের জাঁকজমক দেখবার মতো। দুই পাশে কারুকার্যময় খিলান দেওয়া বিশাল ঘর, মাথার উপর কারুকাজ করা ছাদ, জমকালো সব বাতি ঝোলানো, মোজাইক মেঝেতে সারি সারি বেঞ্চ পাতা আর শেষ প্রান্তে মূল প্রার্থনা বেদী, তার পেছনের বাইবেলে বর্ণিত বিভিন্ন কাহিনী চিত্রিত, প্রার্থনা বেদীর ওপরের ছাদের অংশে খোলা একটা জানালা।
এক পাশে লম্বা বারান্দা ধরে সবাই হাঁটতে লাগলাম, ডানপাশের দেয়ালের একদম ওপরে মোজাইক করা কাচের জানালা। কেউ কোনো কথা বলছে না, একজন পাদ্রি বেদীতে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন, সবাই চুপচাপ শুনছেন। হাঁটতে হাঁটতে একটা লম্বা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলাম, সিঁড়ির ওপরের খিলানটিও খুব সুন্দর কারুকাজ করা, এর দু’পাশের দেয়ালে নারী সন্তদের ছবি আঁকা। সিঁড়ি পেরিয়ে একটা ছোট ঘরে ঢুকলাম, সেই ঘর পার হলেই নাকি ব্ল্যাক ম্যাদোনার দেখা পাওয়া যাবে। পেছনে দাঁড়ানো ইংরেজ ট্যুরিস্ট তাই বললেন। আর তর সইছিলোনা, কিন্তু অপেক্ষা করতে হলো আরো অনেকক্ষণ। সেই ঘরের বামদিকের দরজা পার হয়ে আরেকটা সিঁড়ি দেখা গেলো, কিন্তু লোকের ভীড়ে সিঁড়ির ওপরে কি আছে দেখা গেলো না।  

সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম, হঠাৎ সামনে তাকাতে সোনালি রঙের জমকালো কিছু চোখে পড়লো। ভালো করে দেখে বুঝলাম সেটাই ব্ল্যাক ম্যাদোনার মূর্তি। অবশেষে আমার পালা এলো, এক একটা সিঁড়ি পার হয়ে লাইনের প্রথমে এসে দাঁড়ালাম, ঠিক ব্ল্যাক ম্যাদোনার সামনে। সত্যিই অসাধারণ এই কালো মেরি। কাচের ঘেরাটোপের মধ্যে সিংহাসনে আসীন, তার কোলে বালক যিশু। ঘন কালো তাদের শরীর, পরনে সোনালি পোশাক, এক হাতে তিনি যিশুকে জড়িয়ে ধরে আছেন, আরেকটি হাতে একটি ছোট গোলক, এটি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতীক, তার মুখে মাতৃত্বের কমনীয়তা।
ব্ল্যাক ম্যাদোনার খোঁজে (পর্ব-২)কাচের দেয়ালের সামনের অংশে ছোট একটি ছিদ্র, মেরির হাতের আঙুল আর হাতে ধরা গোলকটি ওই ছিদ্র দিয়ে স্পর্শ করা যায়। পেছনে লম্বা লাইন, বেশিক্ষণ সময় নেওয়া যাবে না, তাই তার হাতের আঙুল স্পর্শ করে প্রার্থনা করলাম। মেরির হাতটা ধরতে কেমন যেন একটা অনুভূতি হলো, মনে হলো এই স্পর্শটা আমার খুব চেনা, মেরীর মুখটাও মনে হলো কোথাও যেন দেখেছি। ভীষণ পজিটিভিটি অনুভব করলাম।  

বেশি সময় নেওয়া যাবে না তাই আবার হাঁটা শুরু করলাম অপরদিকে। আবার একটা সিঁড়ি পার হয়ে আরেকটা ঘর ও প্যাসেজ পার হয়ে বিশাল কাচের দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম, যেখানে সারি সারি মোম জ্বলছে, এর নাম ‘আভা মারিয়া পাথ’। আজ এখানে অনেক লোকের সমাগম, সেদিনের মতো নির্জন নয়। সবাই মোম জ্বালাচ্ছে, আমরাও জ্বালালাম। লোকজনের ভীড়ে এই জায়গাটিকে আজ অন্যরকম লাগছিল, সেদিনের মন কেমন করা নীরবতায় এই জায়গাকেই কেমন অপার্থিব লাগছিল। আবার বাইরের চত্বরে বেরিয়ে এলাম, বারান্দায় এখনও লম্বা লাইন। দিনটা কেমন মেঘলা করেছিল, পাহাড়গুলোকে বিষণ্ন দেখাচ্ছিল। কেবল কার দিয়ে এই পাহাড়ের ওপরেও ওঠা যায়। বাইরের খোলা চত্বরেও প্রচুর ট্যুরিস্ট, একপাশে দেয়ালের গা ঘেঁষে পাহাড়সারি দাঁড়িয়ে, অন্যদিকে রেলিংয়ের নিচে ছড়িয়ে আছে উঁচুনিচু উপত্যকা।  

ব্ল্যাক ম্যাডোনার সত্যিই কোনো অলৌকিক ক্ষমতা আছে কিনা জানি না, তবে তার মুখটা কেন পরিচিত লেগেছিল এবার বুঝলাম। তার মুখে যা দেখেছি তা আরও বহুবার বহু মায়ের মুখে দেখেছি, তা হলো শাশ্বত মাতৃত্ব। কোন শিল্পী এই মূর্তি তৈরি করেছিলেন তা কেউ জানে না, কিন্তু তিনি যে নিখুঁতভাবে এই মূর্তির মুখে মাতৃত্বকে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। কে জানে তিনি নিজের মায়ের মুখের আদলেই হয়তো মেরির মুখটা তৈরি করেছেন। মনসেরাত পাহাড়ের কোলে প্রকৃতির নির্জনতায় দাঁড়িয়ে থাকা এই ব্যাসিলিকা ও ব্ল্যাক ম্যাদোনা যেকোনো পর্যটকের মনে জাদুময় অনুভূতি সৃষ্টি করতে বাধ্য।

** ব্ল্যাক ম্যাদোনার খোঁজে (পর্ব-১) 

বাংলাদেশ সময়: ০৯২২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০১৮
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।