ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পর্যটন

ঢাকা দেখতে ‘ঐতিহ্য জাদুঘর’-এ

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর, ফিচার রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩, ২০১৯
ঢাকা দেখতে ‘ঐতিহ্য জাদুঘর’-এ নিমতলী প্রাসাদকে গড়ে তোলা হয়েছে ঐতিহ্য জাদুঘর হিসেবে। ছবি: শাকিল আহমেদ

ঢাকা: ইট-কাঠের শহরে চোখ মেললে যতটুকু দৃষ্টি যায়, তার চেয়েও কম জায়গার মধ্যেই দেখে ফেলা যায় অতীতের ঢাকা। জায়গা ছোট হলেও ব্যপ্তি বিশাল! নাম ‘ঐতিহ্য জাদুঘর’। ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্যের বড় একটা অংশের পরিচয় মিলবে এ জাদুঘরে।

রাজধানীর বঙ্গবাজার এলাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হলের পাশেই এশিয়াটিক সোসাইটি। সেখানে মূল ভবন সামনে রেখে একটু পেছনে এগোলেই দেখা মিলবে ঢাকার ঐতিহ্য জাদুঘরের।

ঢাকার আদি নবাবদের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক নিমতলী প্রাসাদ (১৭৬৫-৬৬) বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার একটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা। এই স্থাপনাটিকেই গড়ে তোলা হয়েছে ঐতিহ্য জাদুঘর হিসেবে।

প্রায় আড়াইশ’ বছরের পুরনো এই স্থাপনাটিকে জাদুঘরে রূপান্তরের পাশাপাশি গড়ে তোলা হয়েছে শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান গবেষণা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে। সাধারণ ঐতিহ্যপিয়াসী নাগরিক, দর্শক, ঢাকাপ্রেমী, গবেষক ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে রাজধানীর অতীত তুলে ধরাই এই জাদুঘরের অন্যতম মূল উদ্দেশ্য।

ভেতরে রয়েছে নবাবদের ব্যবহার্য বিভিন্ন জিনিসপত্র।  ছবি: শাকিল আহমেদ

জাদুঘরটিকে সাজানো হয়েছে মোট পাঁচটি গ্যালারিতে। মূল ভবনের দিকে এগিয়ে গেলে হাতের ডানপাশেই মিলবে প্রথম ও দ্বিতীয় গ্যালারি। প্রথম গ্যালারিতে রয়েছে এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠালগ্নের ঘটনাবলি। প্রতিষ্ঠানটির জন্ম ১৯৫২ সালের ৩ জানুয়ারি। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদের বাসায় এক সভায় এশিয়াটিক সোসাইটি অব পাকিস্তান গঠনের সিদ্ধান্ত হয়, যার বর্তমান নাম এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ। এই গ্যালারিতে এশিয়াটিক সোসাইটি গঠনের ইতিহাস, এর প্রথম সাধারণ সম্পাদক ড. আহমদ হাসান দানী, প্রথম সভাপতি আব্দুল হামিদের ছবিসহ উল্লেখযোগ্য আলোকচিত্র ও তথ্যাদি তুলে ধরা হয়েছে।

এই গ্যালারির মধ্য দিয়েই প্রবেশ করতে হয় দ্বিতীয় গ্যালারিতে। এ গ্যালারিতে রয়েছে দেউড়ি ভবন সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের বিষয়গুলো। গ্যালারিতে ঢাকার নায়েব-নাজিমদের নিমতলী প্যালেসের গেট হাউস, নিমতলী দেউড়ি সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার কার্যক্রম ধারাবাহিকভাবে আলোকচিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে। এখানে নিমতলী প্যালেস ও দেউড়ির ১৮৬৩, ১৮৭৪ ও ১৯৫০ সালের ছবিসহ ভবনটি সংরক্ষণের আলোকচিত্র স্থান পেয়েছে।

দ্বিতীয় গ্যালারি দেখা শেষ করে ঢুকতে হবে মূল ভবনের বাম পাশের অংশে। সেখানে তিন নম্বর গ্যালারিতে রয়েছে সুবা বাংলার নায়েব-নাজিমদের ঐতিহাসিক পটভূমি। ১৬১০ (মতান্তরে ১৬০৮) সালে ঢাকায় মোগল সাম্রাজ্যের বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার রাজধানী স্থাপিত হয়। তবে, ১৬৩৯ সালে সুবেদার শাহ সুজা রাজধানী স্থানান্তর করলে জাহাঙ্গীরনগর বা ঢাকা সাময়িকভাবে এ মর্যাদা হারায়। পরবর্তীতে ঢাকায় আবারও রাজধানী স্থানান্তর করা হয়। ১৭১৬ সাল পর্যন্ত ঢাকার নবাবী শাসন ও রাজধানী বহাল ছিল। ১৭১৭ সালে ঢাকা থেকে রাজধানী স্থায়ীভাবে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত হয়। মুর্শিদ কুলি খানের সময়ে ১৭১৭ সাল থেকে ঢাকায় নায়েব-নাজিমদের প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু হয় ও ১৮৪৩ সাল পর্যন্ত এটি বহাল থাকে।  

জাদুঘরে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের প্রাচীন ধাতব মুদ্রা।  ছবি: শাকিল আহমেদ

তিন নম্বর গ্যালারিতে নায়েব নাজিম প্রথার পটভূমি তুলে ধরা হয়েছে। এখানে ১৬ জন নায়েব-নাজিম ও তাদের প্রতিনিধির কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত বিবরণ উপস্থাপন রয়েছে। দেখানো হয়েছে ওই সময়কার উল্লেখযোগ্য স্থাপনার বিবরণ ও ছবি।

গ্যালারি চারে রয়েছে সুবা বাংলার নায়েব-নাজিমদের ইতিহাস, যা মূলত মোগলদের শেষ সময় ১৭০৭ থেকে ১৮৫৭ সালের সময়কাল। ১৭১৭ সালে সুবা বাংলার নবাব মুর্শিদ কুলি খান প্রথম নাজিম নিযুক্ত করেন খান মোহাম্মদ আলীকে। এরপর পর্যায়ক্রমে ১৬ জন নায়েব নাজিম ১৮৪৩ সাল পর্যন্ত নিযুক্ত ছিলেন। সবশেষ নায়েব-নাজিম ছিলেন গাজী উদ্দিন হায়দার। এই গ্যালারিতে সময়ের ক্রমানুসারে নায়েব-নাজিমদের তালিকা ও যাদের আলোকচিত্র পাওয়া গেছে তাদের আলোকচিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধি ক্যাপ্টেন আর্চিবল্ড সুইন্টনের ঢাকায় আগমন ও নিমতলী প্রাসাদ নির্মাণসহ উল্লেখযোগ্য তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়েছে এই গ্যালারিতে।

চার নম্বর গ্যালারি শেষ করে কয়েকটা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে দেউড়ি ঘরের দ্বিতীয় তলায়। সেখানে সবশেষ পাঁচ নম্বর গ্যালারি ঢাকার জীবন ও শিল্পকর্ম নিয়ে। এই গ্যালারির আকর্ষণীয় প্রদর্শনী হলো নায়েব-নাজিম নবাব নুসরাত জংয়ের (১৭৮৫-১৮২২) দরবারের ডিওরামা বা ত্রিমাত্রিক উপস্থাপনা। সেখানে দেখা যাবে, নবাব নুসরাত জং বসে আছেন তার রাজকীয় দরবারে। পাশে এক প্রহরী তরবারি হাতে দণ্ডায়মান, আরও একজন নবাবের পেছনে হাতপাখা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। নবাবের হাতে আছে হুক্কার নল।

নবাব নুসরাত জংয়ের রাজ দরবার।  ছবি: শাকিল আহমেদ

এই গ্যালারিতে আরও রয়েছে নায়েব-নাজিমদের ব্যবহার্য জিনিসপত্র। এর মধ্যে তৎকালীন সময়ের তাম্রমুদ্রা, রৌপ্যমুদ্রা, গহনার বাক্স, মসলিন কাপড়, এলকাই বা বিয়ের কনের ওড়না, মেয়েদের ব্লাউজ, প্লেট, গহনার বাক্স, কাঠের টোকরা (তাক), পিতলের প্রদীপদানি, কোরআন শরীফ, হরিণের শিং, ধাতব কেটলি, সিঁদুরের কৌটা উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও রয়েছে সমসাময়িক বিভিন্ন আলোকচিত্রের প্রদর্শনী। ফলে, এই গ্যালারিতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গ রাজদরবারে প্রবেশের শিহরণ স্পর্শ করে যাবে হৃদয়কে।

কথা হয় জাদুঘর দেখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাঈমা ফেরদৌসির সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, প্রায়ই জাদুঘরের কাছাকাছি আসা হয়। কিন্তু, জানা ছিল না ঐতিহাসিক এত সুন্দর কিছু লুকিয়ে আছে এখানে। ছিমছাম ছোট্ট একটা জাদুঘর যে এত সুন্দর আর আকর্ষণীয় হতে পারে, তা ভাবিনি। চোখের পলকে দেখে এলাম ঢাকার নবাবদের। জাদুঘর মানেই ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয়। নিমতলী জাদুঘরও সেই কাজটি করছে দারুণভাবে।

তবে, ঐতিহ্য জাদুঘরকে আরও সমৃদ্ধ করার কথা বললেন এর কিউরেটর জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, জাদুঘরটিকে কীভাবে আরও সমৃদ্ধ করা যায়, তা নিয়ে কাজ চলছে। আমরা চাই সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এই জাদুঘরটির সম্পৃক্ততা আরও বেশি হোক। এটি শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, গবেষণা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠুক।

জাদুঘরে দেখা মিলবে ঢাকার ঐতিহ্য মসলিন কাপড়ের।  ছবি: শাকিল আহমেদ

প্রতি শুক্রবার এবং শনিবার দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত এই জাদুঘরের প্রবেশমূল্য ২০ টাকা। তবে, শিক্ষার্থীদের পরিচয়পত্র দেখালে ৫০ শতাংশ ছাড় পাওয়া যায়।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৩, ২০১৯
এইচএমএস/একে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।