প্রতিবছর হাজারো দর্শনার্থী রাসমেলায় অংশ নিতে আসেন। দুবলার চরের রাসমেলায় স্থানীয় লোকজন ছাড়াও দূর-দূরান্তের শহরবাসী এমনকি বিদেশি পর্যটকেরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়ে থাকেন।
এই মেলায় গ্রামীণ অনেক খাবার, মিষ্টি, সন্দেশ, অনেক রকম শুটকি, পুতুল নাচ, যাত্রাপালাসহ অনেক ঐতিহ্যবাহী জিনিসের সন্ধান মেলে। ১১ নভেম্বর শুরু হবে তিনদিনব্যাপী এ রাসমেলা। সমুদ্রকোলে পাঁচ মাইল প্রশস্ত বালুকাবেলায় পদব্রজে ভ্রমণ করে ক্যামেরায়বন্দী করতে পারেন আশ্চর্যসুন্দর সব চিত্র।
১১ থেকে ১৩ নভেম্বর চন্দ্রিমার আলোকমালায় শোভিত নীরব চরাঞ্চল সরব হয়ে উঠবে পুণ্যার্থীদের প্রার্থনা-আরাধনায়। বাঙালি হিন্দুদের অন্যতম প্রধান পার্বণ রাস উৎসব দুবলার চরের আলোরকোলে নতুন এক বিশেষ মাত্রায় সাড়া ফেলে বাঙালি হিন্দু সমাজে। সাগর-প্রকৃতির অভাবনীয় সৌন্দর্যের মাঝে পুণ্য অর্জন আর আনন্দ-সঞ্চার যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
যখন রাসমেলা
প্রতি বছর কার্তিক মাসে (খ্রিস্টীয় নভেম্বর) হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের রাসমেলা এবং পুণ্যস্নানের জন্য দুবলার চর বিখ্যাত। যদিও বলা হয়ে থাকে, ২০০ বছর ধরে এ রাসমেলা হয়ে চলেছে। , তবে জানা যায়, ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে হরিচাঁদ ঠাকুরের হরিভজন (১৮২৯—১৯২৩) নামে এক বনবাসী ভক্ত এই মেলা চালু করেন। প্রতিবছর অসংখ্য পুণ্যার্থী রাসপূর্ণিমাকে উপলক্ষ করে এখানে সমুদ্রস্নান করতে আসেন। দুবলার চরে সূর্যোদয় দেখে ভক্তরা সমুদ্রের জলে ফল ভাসিয়ে দেন। কেউবা আবার বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে ভজন-কীর্তন গেয়ে মুখরিত করেন চারপাশ।
আবার কারও কারও মতে, শারদীয় দুর্গোৎসবের পর পূর্ণিমার রাতে বৃন্দাবনবাসী গোপীদের সঙ্গে রাসনৃত্যে মেতেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। এ উপলক্ষেই দুবলায় পালিত হয়ে আসছে রাস উৎসব।
কী হয় রাসমেলায়
দুবলার চরের রাসমেলায় দেশের বিভিন্ন জায়গা ছাড়াও বিদেশ থেকে প্রচুর পুণ্যার্থী ও পর্যটকের সমাগম ঘটে। প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষ প্রতিবছর এ উৎসবে অংশ নেন।
রাসমেলায় প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রার্থনায় বসেন পুণ্যার্থীরা। তারা সাগরকে সামনে নিয়ে নির্জনে কৃষ্ণপূজার সঙ্গে দেবতা নীল কমল আর গঙ্গাদেবীর আরাধনায় নিমগ্ন হন। পাপমোচন করেন সমুদ্রস্নানে। সূর্যোদয়ে পানিতে ভাসিয়ে দেন ফল-ফুল। অতঃপর ঢাক-ঢোলক-কাসা-মন্দিরা বাজিয়ে ভজন-কীর্তনে নিনাদিত করেন চারপাশ। পূজা-অর্চনার ফাঁকে সূর্যাস্তের পর সাগরকে সাক্ষী করে আকাশের বুকে উড়িয়ে দেওয়া হয় ফানুস।
সন্তানহীন ধর্মানুরাগী হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা দুবলার চরের মেলায় মানত করেন এবং মেলায় এসে মানতকারীরা আনুষঙ্গিক অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করে থাকেন। মেলায় বাদ্য, নৃত্য, গীত ও বিবিধ প্রকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকে। পসার সাজিয়ে বসে কুটির শিল্পের দোকান ছাড়াও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, ফল-ফলাদি, মিষ্টান্ন, মনোহারী সামগ্রীর।
যাবেন যেভাবে
নিজস্ব উদ্যোগে সুন্দরবনের গহীনে ভ্রমণ কঠিন। তাই রাসমেলা ছাড়াও সুন্দরবনে ভ্রমণে যেতে সাহায্য নিতে হবে অভিজ্ঞ কোনো ভ্রমণ সংস্থার।
এবারের রাস উৎসব উপলক্ষে সুন্দরবনে বিশেষ প্যাকেজের ব্যবস্থা নিয়েছে অসংখ্য বেসরকারি ভ্রমণ সংস্থা।
দি রয়েল ট্যুরের রাসমেলার যাত্রা শুরু হবে নভেম্বরের ১১ তারিখে। শেষ হবে ১৩ নভেম্বর। মোবাইল নম্বর: ০১৭১১২৯৫৭৩৮।
রূপসী বাংলা ট্যুরিজমের ট্যুর প্যাকেজ নভেম্বরের ১১, ১২ ও ১৩ তারিখে। মোবাইল নম্বর: ০১৭১১৪০৯৩০৯, ০১৫৫১৩০৮০৮০।
সুন্দরবন হলিডেস ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের রাসমেলার তিন দিনের প্যাকেজ রয়েছে। মোবাইল নম্বর: ০১৭১১৩৭৭৫৩৬।
দি ম্যানগ্রোভ ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস খুলনা-সুন্দরবন-খুলনা তিন দিনের ট্যুরের আয়োজন করেছে। মোবাইল নম্বর: ০১৯১৭৭২১২৩৬, ০১৭১৬২৭৯৪০৪।
এস আর ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের তিন দিন দুই রাতের এ ভ্রমণে প্যাকেজ রয়েছে। মোবাইল নম্বর: ০১৭২৫২৩২০২৩, ০১৯১৯২৯৪৪৪৪। ভ্রমণের তারিখ ১২, ১৩ ও ১৪ নভেম্বর।
সুন্দরবন পলি ট্যুরিজমে মোবাইল নম্বর: ০১৭১৫৬৩৪৬৯৪। সাওদান ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের মোবাইল নম্বর: ০১৭১২-৭৭৩৩৬১। এসব ট্যুরিজম প্রতিষ্ঠানের প্যাকেজে জনপ্রতি খরচ ননএসিতে ৮-১২ হাজার টাকা। আর এসিতে ১২-১৮ হাজার টাকা।
এ ধরনের প্রায় ৪০টি ট্যুরিস্ট কোম্পানি খুলনার বিআইডব্লিউটিএ’র লঞ্চঘাট থেকে সুন্দরবনের রাসমেলায় যাবে। খুলনা থেকে লঞ্চে সুন্দরবন যাতায়াতে সবার জন্য থাকছে এসি/ননএসি কেবিন ব্যবস্থা এবং একই মানের খাবার। দুবলার চরে রাসমেলা দেখা ছাড়াও এ প্যাকেজে থাকছে হিরণ পয়েন্ট, আলোরকোল, কটকা, জামতলা, টাইগার পয়েন্ট ও কচিখালী ভ্রমণের সুযোগ। এছাড়া থাকবে বনের ভেতর র্ট্যাকিং, বিচভলিবল, ফানুস ওড়ানো ও সাংস্কৃতিক আয়োজন।
ঢাকার মতিঝিল, আরামবাগ, শ্যামলী, কল্যাণপুর, গাবতলী থেকে বিভিন্ন বাসে খুলনা, মোংলা বা সাতক্ষীরার শ্যামনগর এসে নৌপথে রাসমেলায় যেতে পারেন। খুলনায় ট্রেনে এবং যশোর পর্যন্ত বিমানেও আসা যাবে। পাশাপাশি নৌপথেও আসা যায়। তবে রাসমেলায় যাওয়ার সবচেয়ে ভালো মাধ্যম হলো খুলনার বিআইডব্লিউটিএ’র লঞ্চঘাট থেকে। কেননা এ লঞ্চঘাট থেকে বিভিন্ন ভ্রমণ সংস্থা রাসমেলা উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন করে থাকে।
ট্যুরিস্ট ভেসেল বা নৌযান ছাড়াও সুন্দরবনের অভয়ারণ্যে হিরণ পয়েন্টের নীলকমল এবং টাইগার পয়েন্টের কচিখালী ও কটকায় বন বিভাগের রেস্টহাউজে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।
বন বিভাগের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মো. মঈনুদ্দিন খান বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিবছরের মতো এবারও রাস পূর্ণিমা উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী সুন্দরবনের দুবলার চরে ঐতিহ্যবাহী ‘রাস পূর্ণিমা পুণ্যস্নান’ অনুষ্ঠিত হবে। পুণ্যস্নানে দর্শনার্থী ও তীর্থযাত্রীদের নিরাপদে যাতায়াত নিশ্চিত করার জন্য বন বিভাগ প্রস্তুতি নিয়েছে। এ বিষয়ে বুধবার (২৩ অক্টোবর) বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে সভা রয়েছে। সভায় বিগতবারের মতো আটটি পথ নির্ধারণের প্রস্তাব করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১৯
এমআরএম/এইচএ/