বিশ্ব ভ্রমণের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, এই ভ্রমণযজ্ঞে বাধা-বিপত্তি, স্মরণীয় বিষয়াদি নিয়ে নাজমুন নাহার কথা বলেছেন বাংলানিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট শাহেদ ইরশাদ।
নাজমুন নাহারের ছোটবেলা একটু ভিন্ন রকমই ছিল। সে গল্প বলছেন তিনিই, ‘আমি যখন বুঝতে শুরু করি, তখন মনে হয়েছে আমার জন্মই হয়েছে, এই পৃথিবীকে ঘুরে দেখার জন্য। ক্লাস ফোরে পড়ার সময় প্রকৃতির প্রতি দুর্বল ছিলাম। প্রকৃতিতে বসে থাকতাম। বইয়ে ভ্রমণ বিষয়ক লেখা পড়তাম। আমার বাবা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গার গল্প শোনাতেন। বাবার কাছ থেকে গল্প শুনেই ভ্রমণে উৎসাহী হই। আমার দাদা ১৯২৬ থেকে ১৯৩১ সাল আরবের বিভিন্ন দেশ পায়ে হেঁটে, ঘোড়ায় চড়ে, জাহাজে ভ্রমণ করেছেন। সেই গল্পগুলোই আমাকে খুব টানতো। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি ইবনে বতুতা, অতীশ দীপঙ্কর, মাও সে তুং, কলম্বাসের কাহিনীগুলো পড়েছি। ভ্রমণের বিষয়ে পরিবারের সীমাবদ্ধতাগুলো ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠেছি সাহসিকতা ও মনোবলের কারণে। ’
নাজমুন নাহার বলেন, ‘আমি শিখেছি আমার পথে কেউ ঢিল মারলে সেটি সরিয়ে হলেও আমাকে সামনে এগোতে হবে। ভ্রমণ ছিল আমার ধ্যান, সাধনা ও প্রার্থনার মধ্যে। ’
পঞ্চম শ্রেণির পরীক্ষায় শিক্ষকের দেওয়া বাংলাদেশ ও বিশ্বের ভাঙা মানচিত্র জোড়া লাগিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন নাজমুন। সেই বিষয়টি টেনে তিনি বলেন, ‘এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের সংযোগ আমার কাছে মনে হয়েছে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়ার ইচ্ছে জাগিয়ে তুলেছে। ’
নাজমুন নাহার বিশ্ব ভ্রমণে গার্লস গাইড অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত হন। এই গাইড তার জীবনকে একটু ভিন্নভাবে ধাবিত করেছে। তিনি বলছিলেন, ‘এখান থেকে আমি অনেক কিছু শিখতে পেরেছি। বিভিন্ন ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে মাটিতে ঘুমানো, পাহাড়ে যাওয়াসহ নানা রকম সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছি। আমার বোনের সঙ্গে সর্বপ্রথম আমি সীতাকুণ্ড পাহাড়ে উঠি। ’
‘ভারতের উঁচু এবং খাড়া পাহাড়ে ওঠার পর বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছি। তখন আমার চোখে পানি চলে এসেছে। আমার মনে হয়েছে বাংলাদেশের পতাকা যদি আমি সারাবিশ্বে উড়িয়ে দিতে পারতাম। ভারত থেকে ফিরে সিঙ্গাপুর-নেপালসহ কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করি। ’
এরপর ২০০৬ সালে সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করতে চলে যান নাজমুন নাহার। বলছিলেন, ‘আমার ভ্রমণের দরজাটা তখন খুলে যায়। আমার মনে হয়েছে আমি রাইট ট্র্যাকে এসেছি। আমি মনে করেছি ভ্রমণটাকে নিয়মিত করতে হলে পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করতে হবে। তাই করেছি। ১৭-১৮ ঘণ্টা কাজ করেছি। কম খরচে কীভাবে ভ্রমণ করা যায়, সেটা মাথায় রেখেছি। ’ আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি নাজমুনকে। তিনি বলেন, ‘২০০৭ সালে আমি ফিনল্যান্ড যাই। জার্মানি, পোল্যান্ড ও ইংল্যান্ডে গিয়েছি। কিউবাতে গিয়ে দেখছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সবাই চিনে। সেটা আমার জন্য খুবই আনন্দের ছিল। হাভানা থেকে যাওয়ার সময় গাড়ি নষ্ট হওয়ায় ১৮ ঘণ্টা আখের রস খেয়ে বেঁচেছিলাম। এক জায়গায় ২৬ ঘণ্টা না খেয়েছিলাম। আফ্রিকায় তিনমাস আলু, ইথিওপিয়াতে খেয়েছি গরুর কাঁচা মাংস। আটকা পড়ে মানুষের বাড়ির সামনে কাঠের মধ্যে ঘুমিয়েছি। বতসোয়ানা থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় আসার সময় এক নারী আমাকে বাঁচিয়েছেন। সেখানে ট্যুরিস্ট দেখলে গুলি করে দেয়। মুখে কালো কাপড় বেঁধে ট্যাক্সিকাবে তুলে হোটেলে পৌঁছে দিয়েছে। চিলির আতাকামায় (মরুভূমি) যাওয়ার পরে হাতের ত্বক ফেটে রক্ত বের হয়েছে। এক জায়গায় হোটেলে ওঠার পর প্রচণ্ড কাশি হচ্ছিল। পাশ থেকে একটি মেয়ে আমাকে একটি ওষুধের নাম লিখে দিয়ে খেতে বলেছিল। আমি দুর্বলতার কারণে খেতে পারিনি। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরে দেখি আমার বিছানার পাশে একটি ওষুধের বোতল আর একটি চিরকুট। এরকম অনেক অনেক ঘটনা ঘটেছে। আমি শুধু পৃথিবীর সৌন্দর্য নয়, মানুষের হৃদয়ের সৌন্দর্যও দেখেছি। ’
‘আইভরিকোস্টের মানসিটির বাসস্ট্যান্ডে কোনো গাড়ি না পেয়ে চায়ের দোকানে মিশরের এক ছেলের সঙ্গে দেখা হলো। তাকে সব বলার পরে সে আমাকে বাসায় নিয়ে রান্না করে খাওয়ানোর পর রাতে ঘুমানোর ব্যবস্থা করেছে। পরের দিন আমি চলে এসেছি। কোনো ধরনের দুর্যোগ ও খারাপ দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়াই পৃথিবীর অনেক মানুষ আমাকে সাহায্য করেছে। ’
১৩৫টি দেশ ভ্রমণের সময় পাঁচবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন নাজমুন। একটি ঘটনা দক্ষিণ আমেরিকার পেরুর রেইনবো পর্বতের ওঠার জন্য ১৪ হাজার ২০০ ফিট পায়ে হেঁটে উঠতে হয়। বলছিলেন তিনি, ‘ওই পর্বতে ওঠার সময় আমার মৃত্যুকষ্ট হয়েছে। আমি গাইডকে একটু অপেক্ষা করতে বলেছিলাম, শুনেনি। বলেছে তুমি এখানে মারা গেলে তোমার লাশও আমি নিয়ে যেতে পারবো না। একথা শুনে আমি শক্তি সঞ্চয় করে পাহাড়ে উঠে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছি। গুয়াতেমালায় আমি এবং কানাডার এক যুবক ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছিলাম। ছুরি হাতে দুই ছিনতাইকারী আমাদের কাছে যা আছে সব চেয়েছিল। কানাডার ওই ছেলে ছুরি মারা দেখে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ায় সে যাত্রায় বেঁচে গেছি। ’
নতুন ভ্রমণকারীদের উদ্দেশ্যে নাজমুন নাহার বলেন, ‘ভ্রমণের জন্য নারী-পুরুষের ভেদাভেদ ভুলে যেতে হবে। বাধা বিপত্তি এলে তা সমাধানের প্রত্যয় নিয়ে পথে নেমে পড়তে হবে। ছেলে-মেয়ে সবাইকে বিপদে পড়লে কৌশলে বাঁচিয়ে নিতে হবে। শুধু মেয়েদের নয়, ছেলেদেরও নারীকে মানুষ হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতে হবে। নারী না পুরুষ পারবে, এ ধরনের মিশ্র ভাবনা ত্যাগ করতে হবে। শুধু বিশ্ব ভ্রমণ নয়, আমি চাই আমাদের মেয়েরা মহাকাশে, এমনিক চাঁদেও যাবে। কষ্টকে হাসিমুখে মেনে নিতে হবে। পথই আপনাকে পাথেয় দেখাবে। ’
বাংলাদেশকে পর্যটনবান্ধব করতে নাজমুন নাহারের পরামর্শ, ‘প্রথমত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। পর্যটকদের আকর্ষণ করতে শিক্ষা ও কর্মশালায় সচেতন করতে হবে। বিদেশিদের আতিথেয়তা, ট্যুরিস্ট গাইড আরও সহজলভ্য করতে হবে। আদিকাল থেকে বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৪২২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০১৯
এসই/এইচএ/