বরিশাল: দিন যত যাচ্ছে পাল্টে যাচ্ছে ততই পাল্টে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী দুর্গাসাগর দিঘির চিত্র। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক আলপনা দিয়ে সাজানোর কাজ যতই এগিয়ে চলছে ততই পর্যটক ও দর্শনার্থীরা আকৃষ্ট হচ্ছেন।
তবে এমন চিত্র গেলো কয়েকবছর ধরে দেখেনি স্থানীয়রা। তাদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের পঞ্চদশ রাজা শিবনারায়নের খনন করা ঐতিহ্যবাহী দুর্গাসাগর দিঘি সাধারণ মানুষকে বেশি আকৃষ্ট করতো শীতের সময় আসা অতিথি পাখিদের অবাধ বিচরণের কারণে। তবে ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর থেকে এখানকার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। স্থানীয়দের মতে সিডরের সময় ত্রাণ নিয়ে বড় বড় হেলিকপ্টারের বিচরণের কারণে ভয়ে চলে গেছে অতিথি পাখিগুলো।
তবে পাখি প্রেমীরা বলছেন, অপরিকল্পিতভাবে মেহেগনি গাছ লাগানোতে পাখির বিচরণ কমেছে এখানে। তাদের মতে মেহেগনি গাছ এমন একটি গাছ, এ গাছের নিচে বা কাছাকাছি অন্য কোনো গাছ যেমন হতে চায় না, তেমনি এর ফলও পাখিরা খেতেও চায় না। তবে যে কারণেই হোক ২০০৭-০৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আর এ দিঘিতে অতিথি পাখির বিচরণ দেখা যায়নি।
স্থানীয়রা জানান, এরপর থেকে দিন যত গেছে, দুর্গাসাগর ততই নিস্তেজ হয়ে পরেছিল। অনেকটাই পর্যটক শূন্য দুর্গাসাগরে বখাটে-মাদকসেবীদের বিচরণ ঘটতে শুরু করে। নজরদারির অভাবে এখানকার অবকাঠামোর ভঙ্গুর দশার সৃষ্টি হলে জরাজীর্ণ এক বিনোদনকেন্দ্রে রূপ নেয় ঐতিহ্যবাহী দুর্গাসাগর।
তারপর হঠাৎ করে বিষয়টি নিয়ে নরেচরে বসে জেলা প্রশাসন। জনপ্রতিনিধি, প্রকৃতিপ্রেমী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ২০১৬-১৭ সালের দিকে দুর্গাসাগরের অবকাঠামো ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাড়ানোর কাজে হাত দেয় জেলা প্রশাসন। তবে হঠাৎ করেই তৎকালীন জেলা প্রশাসকের বদলি হয়ে যাওয়ায় সে কাজ আর বেশি দুর আগাতে পারেনি।
এরপর বরিশালের বর্তমান জেলা প্রশাসক এস এম অজিয়র রহমান দায়িত্ব নেওয়ার পরই বরিশালের যেসব দিকের উন্নয়নের চিন্তা করেন তার মধ্যে পর্যটন ছিল অন্যতম। তার প্রচেষ্টায় এরই মধ্যে সাতলার শাপলার বিল যেমন দেশের পর্যটনকেন্দ্রের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তেমনি গত দেড় বছরে দুর্গাসগরের আমুল পরিবর্তন ঘটেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০ টাকার টিকিটে বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী দুর্গাসাগর দিঘির সৌন্দর্য অবলোকন করতে গড়ে প্রতিদিন সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ জন মানুষ আসছেন। যা আসন্ন শীত মৌসুমে আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু কয়েকবছর আগেও এখানে গড়ে অর্ধশত দর্শনার্থীও টিকিট কেটে প্রবেশ করতেন না।
এদিকে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, দুর্গাসাগর দিঘিকে দর্শনীয় করে তুলতে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ ও প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এর ফলে দুর্গাসাগরের প্রাকৃতিক ও অবকাঠামোগত সৌন্দর্যের প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটছে।
গত বছরের সংস্কার ও সংযোজনের মধ্য দিয়ে দিঘিতে বর্তমানে রয়েছে সুপরিসর ও দৃষ্টিনন্দন দু’টি ঘাট, পিকনিক বা অনুষ্ঠানের জন্য মঞ্চ, দীঘির পানিতে ঘুরে বেড়ানোর জন্য প্যাডেল বোট ও নৌকা। এছাড়া বড়শি দিয়ে মাছ শিকারের ব্যবস্থা, দীঘির পাড়ে বসার জন্য ছাউনিযুক্ত বেঞ্চ এবং সাধারণ বেঞ্চ, পাবলিক টয়লেট, ওয়াশরুম, রেস্ট হাউজ। সার্বক্ষণিক সিসিটিভির আওতায় থাকা দিঘি এলাকায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাড়ানোর লক্ষে তৈরি করা হয়েছে বাগান। এছাড়া রয়েছে দিঘির স্বচ্ছ পানিতে শাপলা ও পদ্মফুলের সমারোহ এবং হরিণ, হাঁস, বানর ,কবুতর ও বিভিন্ন প্রজাতির সৌখিন পাখি সরবরাহ করার পাশাপাশি স্থাপন করা হয়েছে বাঘ-হরিণের ম্যুরাল।
এছাড়াও দেড় বছরে দুর্গাসাগরের পশ্চিম পাড়ের গেট সংলগ্ন চত্বর সংস্কার, ঐতিহ্যবাহী বটমূলের সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়েছে। পাশাপাশি নতুন একটি পিকনিক সেড নির্মাণ, বিভিন্ন প্রজাতির হাঁসের সংখ্যা বাড়ানো, ঘর ও খাঁচা নির্মাণপূর্বক বানর, কবুতরসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি সংযোজন, প্রবেশ গেট মেরামত এবং সৌন্দর্যবর্ধন, ইলেক্ট্রনিক নামফলক স্থাপন, দিঘিতে বিভিন্ন প্রজাতির মৎস্য অবমুক্তকরণ, সম্পূর্ণ দুর্গাসাগর এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া, সৌরবিদ্যুৎ সুবিধা সংযোজন, ওয়াকওয়ের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য মাটি ভরাট করার মতো কাজগুলো করা হয়েছে।
পর্যটকরা বলছেন, ধীরে ধীরে পর্যটকমুখর হয়ে উঠছে দুর্গাসাগর। ফলে বাণিজ্যের প্রসারসহ স্থানীয়রাও সুফল পেতে শুরু করেছে। আর প্রকৃতির কথা চিন্তা করে দিঘির উন্নয়নে এ বছর এখানে কিছু অতিথি পাখির আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে শীত শুরু হলে প্রচুর অতিথি পাখির দেখা মিলবে এবার।
বরিশালের জেলা প্রশাসক এস এম অজিয়র রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ঐতিহ্যবাহী এ দিঘির সার্বিক উন্নয়নে আমাদের পক্ষ থেকে যথাসাধ্য চেষ্টা চালানো হচ্ছে। দিঘিতে বিপুল পরিমাণে দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ছাড়া হয়েছে। এছাড়া এখানে বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় সাত শত হাঁস ও কয়েকশত কবুতর রয়েছে। যা হাজারে উন্নীত করার চিন্তা ভাবনা রয়েছে। এছাড়া প্রাকৃতিকভাবে পাখিদের আকৃষ্ট করতে ফলজ গাছের বনায়নও করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮২৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৩, ২০২০
এমএস/আরআইএস