ঢাকা, শনিবার, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পর্যটন

‘দারুচিনি দ্বীপে’ পর্যটক বরণে প্রস্তুতি

সোলায়মান হাজারী ডালিম,স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০২২
‘দারুচিনি দ্বীপে’ পর্যটক বরণে প্রস্তুতি

সেন্টমার্টিন থেকে ফিরে: শরতের নীল আকাশের নিচে সাগর জলেও নীলের আভা। সবুজ প্রকৃতিও যেন সেই নীলে মাতোয়ারা।

সুনসান নীরব সাগর পাড়ের বালিয়াড়িতে নেই জন-মানবের পদচিহ্ন। কোলাহলমুক্ত দ্বীপের প্রাণ-প্রকৃতি যেন বিশ্রামে আচ্ছন্ন। এমন নীরবতা আর বেশি দিনের নয়, সপ্তাহ দুই পরেই আড়মোড়া দিয়ে আবার সরব হয়ে উঠবে ‘দারুচিনি দ্বীপ’ খ্যাত দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন।

পর্যটক বরণে পুরোদমে প্রস্তুতি নিচ্ছে জাহাজ, হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট দোকানপাড় থেকে শুরু করে দ্বীপের খেটে খাওয়া মানুষগুলোও।  সম্প্রতি দ্বীপের গিয়ে দেখা যায়, পর্যটক বরণের প্রস্তুতির চিত্র।  রিসোর্টগুলো থেকে আসছে হাতুড়ি পেটানোর শব্দ। মালিকরা তাদের প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে তৈরি করে নিচ্ছেন।  

টুকটাক রং সজ্জা থেকে শুরু করে অবকাঠামো কাজগুলো সেরে নিচ্ছেন। কথা হয়, এমন কয়েকজনের সঙ্গে।

নোনা জল বিচ রিসোর্টের উদ্যোক্তা রিমন বলেন, অনেক দিন বন্ধ থাকার পর দ্বীপের পর্যটন আবার চাঙ্গা হচ্ছে। রিসোর্ট মালিকরা সবাই তাদের প্রতিষ্ঠানের রং করা, পরিষ্কার করা, বসার স্থান, আড্ডা দেওয়ার স্থান রেডি করাসহ যাবতীয় সব কাজ করছে।

দ্য রয়্যাল রিসোর্ট ও মার্টিন টিউলিপ বিচ রিসোর্টের স্বত্বাধিকারী হাসানুর রহমান উল্লাস বলেন, দীর্ঘদিন ধরে সেন্টমার্টিনে পর্যটকদের আসা বন্ধ ছিল। অক্টোবর থেকে আবার আসা শুরু হবে। পর্যটকদের এই আগমনকে ঘিরে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমরা সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার জন্য আন্তরিক। সেজন্য আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি।

স্থানীয় ট্যুর অপারেটর নুর আলম (নুর এসটি মার্টিন) বলেন, সাধারণত পুরো অক্টোবরজুড়ে চলে প্রস্তুতি। রিসোর্টগুলো চার থেকে পাঁচ মাস বন্ধ থাকে স্বাভাবিকভাবেই অনেক কিছু নষ্ট হয়ে যায়, সেগুলো মেরামত করে নিতে হয়। যাদের রুম রেডি থাকে না তারা রেডি করে নেয়। এখন দ্বীপের অধিকাংশ মানুষ পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। সবাই মৌসুমের জন্য এখন নিজেদের তৈরি করে নিচ্ছে। একদম যে অটোরিকশাচালক তিনিও তার অটোটি মেরামত করছেন।



স্থানীয় প্রশাসন দ্বীপকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে নিচ্ছেন। ময়লা আবর্জনা নিয়ে যাচ্ছেন দ্বীপের বাইরে। দ্বীপের ভ্যান, অটোচালকরা পর্যটকদের বরণ করার জন্য তাদের পরিবহনকে সারিয়ে নিচ্ছেন। ছোট-খাট দোকানিরাও তাদের প্রতিষ্ঠানকে মেরামত করছে।

বিচের পশ্চিম এলাকার অটোচালক আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, আমরা সারা বছর এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করি। পর্যটকরা এলে তাদের সেবা দিয়ে আমাদের জীবিকার ব্যবস্থা হয়। নভেম্বর থেকে এপ্রিল। এই কয়েকটি মাস আমরা পর্যটকদের সেবায় নিয়োজিত থাকি। এ সময়ে যা আয় রোজগার হয় তা দিয়েই চলে পুরো বছর।

অতিরিক্ত পর্যটক দ্বীপের জন্য ক্ষতিকর:

দেশি-বিদেশি পর্যটকে মুখরিত হয়ে উঠুক সেন্টমার্টিন, সমৃদ্ধ হোক দেশের পর্যটনখাত, এমনটা সবারই চাওয়া তবে অতিরিক্ত পর্যটক যেন দ্বীপের ভারসাম্য নষ্ট না করে সেদিকেও নজর দেওয়ার কথা বলছেন পরিবেশকর্মীরা।



পরিবেশবাদী সংগঠন সেভ আওয়ার সি এর মহাসচিব মো. আনওয়ারুল হক বাংলানিউজকে বলেন, অতিরিক্ত পর্যটকের কারণে দ্বীপ পরিবেশের ভারসাম্য হারাচ্ছে। এ দ্বীপে পর্যটকের ধারণক্ষমতা দুই হাজার। সেখানে প্রতিদিন দ্বীপে অবস্থান করে ১০ থেকে ১২ হাজার পর্যটক। পর্যটকদের ফেলা বর্জ্যের কারণে সাগর তীরের প্রাণ ও জীববৈচিত্র্য আশঙ্কাজনকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক কলিম উল্লাহ তার ফেসবুকে লিখেছেন, সেন্টমার্টিন জাহাজ আজ থেকে নাকি কাল থেকে চলবে সেটি আমাদের দেখার বিষয় নয়। আমাদের দাবি, দ্বীপের প্রাণ প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে কীভাবে সীমিত সংখ্যাক পর্যটক ভ্রমণ করতে পারবে সেটাই। ইসিএ এলাকা ও প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী  প্রতিদিন ৯শ’ এর বেশি পর্যটক দ্বীপে ভ্রমণ করতে পারবে না। এটি আমাদের চাওয়া। তাছাড়া সেন্টমার্টিন ভ্রমণে পর্যটকরা সঙ্গে করে কোনো প্লাস্টিকের বোতল ও চিপসের প্যাকেট বহন করতে পারবে না।

প্রস্তুতি নিচ্ছে জাহাজগুলো: 

পর্যটকদের আনা-নেওয়ার জন্য জাহাজগুলোও সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। জাহাজ মালিক ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা অনেকেই ইতোমধ্যে ট্রায়াল দিয়ে রখেছেন। আবহাওয়া ঠিক থাকলে অক্টোবরের শুরু থেকেই তারা যাত্রা শুরু করতে চান।  

কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ রশিদ বলেন, আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। আবহাওয়া ঠিক থাকলে আমরা যাত্রা করার জন্য প্রস্তুত।

তিনি জানান, আবহাওয়া কিছুটা খারাপ, ঠিক কবে থেকে জাহাজ চলাচল শুরু হবে তা এখনও বলা যাচ্ছে না।

কর্ণফুলী এক্সপ্রেস সেন্টমার্টিনের অফিসিয়াল ফেসবুকে জানানো হয়, বৈরী আবহাওয়ার কারণে কর্ণফুলী এক্সপ্রেস অক্টোবর মাসের প্রতি সপ্তাহ বৃহস্পতিবার, শুক্রবার, শনিবার কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে চলাচল করবে। বাকি দিনগুলো কর্ণফুলী এক্সপ্রেস চলাচল করবে না। কর্ণফুলী এক্সপ্রেস আগামী ১ নভেম্বর থেকে নিয়মিত সিডিউল অনুযায়ী প্রতিদিন চলাচল করবে।

এমভি বে-ওয়ান ক্রুজ শিপ বৈরী আবহাওয়ার কারণে অক্টোবরে চলাচল করবে না। নভেম্বরের ৩ তারিখ থেকে এমভি বে-ওয়ান নির্দিষ্ট সিডিউল অনুযায়ী চলাচল করবে। বুকিং করে নিতে পারেন ০১৬৩৫৯৯৯০০০, ০১৬৩২৫৫৫৩৩৩ এসব নাম্বারে কল করে। আরও বিস্তারিত জানতে পারেন তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক থেকে  https://www.facebook.com/Karnafulyexpresssaintmartin/

এছাড়াও টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন রুটে চলাচলকারী কেয়ারী ক্রুজ ও সিন্দাবাদসহ অন্য জাহাজগুলোও প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। জাহাজের আপডেট পেতে চোখ রাখতে পারেন কেয়ারীর এই পেজে   https://www.facebook.com/kearitoursandservicesltd  যোগাযোগ করে নিতে পারেন ০১৬৭২-৮৮৮৩২০ নাম্বারে।

যা বলছে স্থানীয় প্রশাসন: 

পর্যটন মৌসুমের প্রস্ততি নিয়ে কথা হয় কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. এরফানুল হক চৌধুরীর সঙ্গে।

তিনি বলেন, মৌসুমের শুরুতে জেলা পর্যায়ে একটি প্রস্তুতি সভা হয়। সেটির পরে হয় উপজেলা পর্যায়ে। এখনও জেলার সভাটি হয়নি।  

এই কর্মকর্তা জানান, মিয়ানমার সীমান্তে জটিলতার কারণে এবারের পর্যটন মৌসুম শুরু করতে দেরি হতে পারে। যাতায়াতের যে জলপথ এই পথে আমাদের অংশে নাব্যতা কম থাকায় মিয়ানমারের জলসীমার কাছ দিয়ে জাহাজগুলো চলাচল করে। বিষয়টি আলোচনার পর চলাচল শুরু হতে পারে।  

তিনি আরও বলেন, প্রতিবছর যেমন জাহাজগুলোতে সতর্কবার্তা প্রচার করা হয় এবারও তা করা হবে। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে পর্যটন সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করা হবে। দ্বীপে এ বিষয়ে সচেতনতা কার্যক্রম চালানো হবে।  

সরকারি ওই কর্মকর্তা জানান, মানুষ আগে থেকে এখন অনেক সচেতন। মানুষ এখন আর ময়লা, আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলে না।


   
যাতায়াত নির্দেশনা: 

সেন্টমার্টিনে তিনভাবে যাওয়া যেতে পারে। প্রথমটি হলো ঢাকা থেকে বাস যোগে কক্সবাজারের টেকনাফ। সেখান থেকে জাহাজ যোগে সেন্টমার্টিন। সায়েদাবাদ, কলাবাগান, ফকিরাপুলসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে হানিফ, সেন্টমার্টিন, শ্যামলী, সৌদিয়া, রিল্যাক্সসহ বিভিন্ন বাস এ রুটে চলাচল করে। ২য় টি হলো চট্টগ্রাম থেকে জাহাজ যোগে সেন্টমার্টিন। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে জাহাজটি সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনের নির্দিষ্ট সময়ে যাতায়াত করে। তৃতীয়টি হলো কক্সবাজার থেকে জাহাজে সেন্টমার্টিন। সুবিধামতো তিনটির যেকোনো একটি বেছে নিতে পারেন।
 
সতর্কতা:

এই দ্বীপে এক সময় বিভিন্ন দেশ থেকে পরিযায়ী পাখিরা এলেও এখন আর আসে না। রাতে হোটেল রিসোর্টগুলোর আলোর কারণে কাছিম আর ডিম পাড়ে না। এক সময় এ দ্বীপে প্রচুর শৈবাল চোখে পড়তো। অনিয়ন্ত্রিত পর্যটকের কারণে সেই শৈবাল এখন আর চোখে পড়ে না। এভাবে চলতে থাকলে একদিন হয়তো এ দ্বীপ বিলীন হয়ে যাবে। দেশের অমূল্য সম্পদ এই দ্বীপকে রক্ষা করতে হলে কিছু সতর্কতার প্রয়োজন। এর মধ্যে অন্যতম হলো প্লাস্টিক ও ময়লা আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলা যাবে না। প্রবাল বা কোরাল তুলে নিয়ে আসা যাবে না। রাতের বেলা উচ্চ আওয়াজে গান শোনা যাবে না। আগুন ও আলো জ্বালানো যাবে না। জেটির উত্তর দিকে একটা জায়গা খুব বিপজ্জনক সেটি এড়িয়ে চলতে হবে। নভেম্বর থেকে মার্চে সময়টায় যেতে পারেন।  

এ সময়টা নিরাপদ। এছাড়াও দ্বীপের বিভিন্ন অংশে স্থানীয় প্রশাসনের বিভিন্ন সতর্কবার্তা রয়েছে তা মেনে চলতে হবে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০২২
এসএইচডি/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।