আজমীর, ভারত থেকে: চাল্লিগুলি চিশতির মোটরসাইকেল হনহন করে ছুটছে। তার পেছনে আমরা দু’জন।
চাল্লিগুল্লির মোটরসাইকেলটি ঠিক মাজার গেটের কিছু আগে থামলো। আমাদের নামিয়ে ডানদিকের ছোট একটি পাহাড়ি গলির ভেতরে গেলেন তিনি। মোটরসাইকেল পার্কিং করে দু’মিনিট বাদেই ফিরে এলেন। আজমীর শরীফের প্রধান গেটের পর কোনো যানবাহন ঢুকতে দেওয়া হয় না। কিন্তু নিজেকে চিশতি বংশের লোক দাবিদার চাল্লিগুল্লি ভাইকে না পুলিশ না অন্যরা, কেউই বাধা দিলো না।
এরপর জুতা খুলে আজমীর শরীফের মূল গেটের ভেতরে ঢুকলাম। এখানে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে পাজামা-পাঞ্জাবির সঙ্গে টুপি পরা বহু লোকই আমাদের ডাকাডাকি করলেন। কেউ গোলাপের পাপড়ি নেওয়ার জন্য, কেউবা টুপি কেনার জন্য। নানাডাকে মাথা কিছুটা বিভ্রান্ত হতে পারে এখানে আগত কারো কারো। তবে চাল্লিগুল্লির মতো গাইড থাকলে কোনো সমস্যা হয় না।
চাল্লিগুল্লি ভাই আমাদের গোলাপের পাপড়ির ডালা কিনতে অনুরোধ করলেন। ২৫ রুপি থেকে বিভিন্ন দামের ডালা পাওয়া যায়। এরপর তার পরিচিত দোকান থেকে ২৫ রুপি করে দু’টি টুপি কিনলাম। এরই মধ্যে আজমীর শরীফের লাল-হলুদ রংয়ের দুটি ফিতা প্যাঁচ দিয়ে আমাদের গলায় বেঁধে দিলেন।
হযরত মঈনুদ্দিন চিশতির মাজারে প্রবেশের আগে ওজু করে নিতে বললেন গাইড। মাজারে ঢোকার পর চাল্লিগুল্লি ভাই আমাদের দু’জনের মাথায় দুটি কাপড় মাথায় দিয়ে হিন্দি ভাষায় দোয়া দরুদ পড়লেন। এরপর মূল কবরে ঢুকে সালাম করতে বললেন। এই পর্ব শেষে আমরা বেরিয়ে এলাম। মঈনুদ্দিন চিশতির মাজারে ঢোকার পর বিভিন্ন লোকজন টাকা দেওয়ার অনুরোধ করে। তবে চাল্লিগুল্লি ভাই আমাদের যার তার কাছে অর্থ দিতে নিষেধ করলেন।
তিনি বললেন, মাজার কমিটির কাছেই আমাদের খুশিমতো টাকা দিতে পারি। ওখানে অর্থ দান শেষে কেউ ইচ্ছে করলে তার যত সময় থাকতে ইচ্ছে হয় মাজার এলাকার ফ্লোরে বসে দোয়া দরুদ পড়তে পারেন।
ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের প্রদেশ রাজস্থানের পবিত্র নগরী আজমীরে এসে থাকতে চাইলে মাজার রোড ধরে সোজা সড়ক অথবা এর আশাপাশের সড়কে থাকাটাই ভালো। তাহলে পায়ে হেঁটে সহজেই এখানে পৌছে যাওয়া যায়। হোটেলে থাকতে হলে বাংলাদেশিদের কিছুটা সমস্যা পড়তে হতে পারে। কারণ বিদেশি হলেই সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার নির্দেশনা মতো একটি অনলাইন ফরম পূরণ করতে হয়। এই পদ্ধতি যদি কোনো হোটেলে না থাকে তাহলে বিদেশিদের এসব হোটেল কর্তৃপক্ষ রাখতে চাইবে না।
মাজার রোড থেকে সোজা বের হয়ে একদম শেষ প্রান্তে বাম দিকে কয়েক পা ফেললেই চোখে পড়বে রিগালসহ বহু হোটেল। বাংলাদেশিরা কেউ আজমীরে এলে সাশ্রয়ী ও বেশি দামে দু’ধরনের কক্ষই পাবেন। ১৫০০ রুপি থেকে শুরু করে ৪৫০০ রুপিতে এসি স্যুইট রুমও মিলবে। তবে ১৫০০ রুপির কক্ষ নন এসি। কেউ দরকষাকষি করলে দু’একশ টাকা কমাতেও পারবেন।
এই হোটেলে ওঠার পর এরাই চাল্লিগুল্লি ভাইয়ের মতো গাইড সঙ্গে দিয়ে দেবে। এজন্য কোনো বাড়তি অর্থ খরচ করতে হবে না। আমাদের গাইডকে কিছু অর্থ দিতে চাইলেও তিনি নিতে রাজি হননি। পরে জোর করেই কিছু টাকা দেই।
গ্রীষ্মমৌসুমে উঞ্চ এলাকা হিসেবে পরিচিত আজমীরের গড় তাপমাত্রা থাকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বর্ষা মৌসুমে নিয়মিতই বৃষ্টি হয়্। আবার শীত মৌসুমে তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রিতে নেমে আসে। জুন থেকে সেপ্টেম্বর এই সময়েই মূলত বৃষ্টি হয়।
শহরের মধ্যে যোগাযোগের বাহন হিসেবে বাস, অটো রিকশা, ট্যাক্সি ও রিকশা ব্যবহৃত হয়। তবে অটো রিকশার ভাড়া তুলনামূলক কম। আজমীর শরীফ দেখে কারো হাতে যদি সময় থাকে পর্যটন শহরের পাঁচ মিনিটের পথেই পাবেন আনা সাগরের দেখা। তিনদিকে পাহাড় ঘেরা বিশাল এই জলভূমিকে সাগর বলা হলেও আসলে এটি লেক। লেকের মাঝে একখণ্ড দ্বীপ রয়েছে।
আনা সাগর থেকে একটু দূরে রয়েছে ফয় সাগর লেক, পাহাড়ের ওপরে নির্মিত তারাগড় ফোর্ট দেখতে যেতে পারেন। ১২ কিলোমিটার দূরের পুস্কারের ৫২ ঘাঁটের সাগর দেখা যেতে পারে। মরুভূমিতে উঠের পিঠে সওয়ার সুযোগ তো রয়েছেই।
আজমীরে পর্যটকদের বাড়তি আনন্দের জন্য রয়েছে ঘোড়ার গাড়ি ও উটের বাহন। পর্যটকরা মরুভূমির জন্য বিখ্যাত রাজস্থানে এসে উটের বাহন কিংবা উটের পিঠে চড়বেন না তা কি করে হয়।
ভারতে যেকোনো প্রদেশের সঙ্গে রেল ও সড়কপথে এই শহরের সঙ্গে চমৎকার যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে কেউ আজমীরে যেতে চাইলে ঢাকা থেকে সরাসরি কলকাতাগামী সৌহার্দ্য, শ্যামলী, গ্রীনলাইন, সোহাগের টিকেট সহজেই কিনতে পারবেন। এই পরিবহনগুলো সরাসরি বেনাপোল চলে আসে। এরপর এদেরই লোকেরা ভারতগামী প্রত্যেকযাত্রীর কাছ থেকে পাসপোর্ট জমা নিয়ে কাস্টমস ও ইমিগ্রেশনের প্রক্রিয়া শেষ করতে সহযোগিতা করেন।
সীমান্ত পার হয়ে ভারতে প্রবেশ করলে আরেকবার কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন শেষে বাস কাউন্টারে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। সবমিলিয়ে সীমান্ত পার হয়ে বাস ছাড়তে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক সময় লাগবে। বেনাপোল থেকে ৮৪ কিলোমিটার পথ যেতে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার বেশি লাগে না। তবে এটি নির্ভর করে ওই বাসের চালক ও তার দায়িত্বশীলতার ওপর।
কলকাতা এসে শিয়ালদহ থেকে সরাসরি আজমীরের ট্রেন পাওয়া যায়। এর মধ্যে অনন্যা এক্সপ্রেস উল্লেখযোগ্য। দুই হাজার রুপি থেকে তিন হাজার রুপির পর্যন্ত তিন ধরনের ভাড়া রয়েছে এতে। কোনটায় বসে, কোনোটায় শুয়ে যাওয়া যায়। এর মধ্যে এসি ও নন-এসি রয়েছে। এই ট্রেনে আসতে সময় লাগবে প্রায় ৩৪ ঘণ্টা। ক্ষেত্রবিশেষে সময় বেশিও লাগতে পারে। ট্রেনটি আজমীরের রেল স্টেশনে নামিয়ে দেওয়ার পর মাজার সড়কে যেতে অটো রিকশায় ৩০ রুপি, রিকশায় ২০ রুপিতে যাওয়া সম্ভব।
** দিল্লি প্রেসক্লাবে সাবসিডি নেই!
বাংলাদেশ সময়: ২০০৯ ঘণ্টা, আগস্ট ২৪, ২০১৪