সোনাদিয়া, কক্সবাজার থেকে: কক্সবাজার রওনা দেওয়ার সময়ই কথা হচ্ছিল উত্তাল সাগরের সত্যিকার সাহসী কন্যা সোনাদিয়া দ্বীপ ঘুরে দেখার ব্যাপারে, কিন্তু মহেশখালী প্রণালী পাড়ি দিয়ে দ্বীপটির তীরে পা রাখা যাবে কিনা এনিয়ে শঙ্কাও ছিল।
শঙ্কা-ভীতি কাটিয়ে স্পিডবোটে চেপে আমরা রওয়ানা হলাম।
আমরাও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে থাকলাম। একসময় স্পিডবোট থেকেই কেউ কেউ পানি ছুঁয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল, আবার ঢেউয়েরই ঝাপটা কাউকে কাকভেজা করে দিচ্ছিল।
প্রায় মিনিট পঁচিশ স্পিডবোটে থেকে মহেশখালী প্রণালীতে বেড়াতে আসা সাগরের ঢেউয়েল নৃত্য দেখার সাঙ্গ হলো মাঝির ইঞ্জিন বন্ধে। সঙ্গে থাকা স্থানীয় শুভাকাঙ্ক্ষী বেলাল ভাই বললেন, আমরা সোনাদিয়া এসে গেছি।
কিন্তু তখন প্রায় সবার ভ্রু কুঁচকে গেলো নীরব প্রশ্নে। যে, সোনাদিয়াকে জীববৈচিত্র্যের দ্বীপ বা প্যারাদ্বীপ বলা হয়, তার বুকে বালুময় সৈকত আর ঝাউবন ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না! কেন?
৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ দ্বীপে যে সাগর লতায় ঢাকা বালিয়াড়ি, কেয়া নিশিন্দার ঝোপ, ছোট-বড় খাল বিশিষ্ট প্যারাবন থাকার কথা শোনা গেছে সেসব কই? এমনকি এই দ্বীপই যে দেশের প্রধান শুটকি মাছ উৎপাদন কেন্দ্র অর্থাৎ শুটকিপল্লী হিসেবে পরিচিত সেই শুটকি পল্লীইবা কোথায়!
আমাদের প্রশ্নমাখা হাবভাবে বেলাল ভাই বললেন, জনপদ, শুটকিপল্লী সব সামনেই আছে। আমরা দ্বীপের পূর্ব পাশ দিয়ে এসেছি বলে সামনের দিকে হাঁটতে হচ্ছে, আর পশ্চিম পাশ দিয়ে আসা যায় না প্রণালী আর সাগরের মোহনা বলে। আমরা বালুর সৈকত বেয়ে এগোতে থাকি। সৈকতে ক’জনকে দেখা যায় লাল কাঁকড়া দৌড়াতে, কাউকে দেখা যায় শঙ্খ সংগ্রহে ব্যস্ত, আবার কেউবা সাগরের বুকে গড়ে ওঠা এই দ্বীপের আবেদনে মোহিত হচ্ছিলেন। পশ্চিমের দিকেই হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে সারি সারি খুঁটির ঘর। এগিয়ে জিজ্ঞেস করতেই জানানো হলো, এটাই শুটকি পল্লী। এখন বৃষ্টির মৌসুম বলে শুটকিপল্লীর প্রধান কাজ বন্ধ, তবে প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে।
সামনে এগিয়ে যেতেই কদমকয়েক বেশি কাছে এলেন সোনাদিয়ার বাসিন্দা ও শুটকিপল্লীর কারিগর হাবিব মিয়া।
জানালেন, এখন বৃষ্টির মৌসুম বলে শুটকি মাছ উৎপাদন বন্ধ। তবে শুষ্ক মৌসুম চলে এলে আবার তারা ব্যস্ত হয়ে উঠবেন।
দ্বীপটির বৈশিষ্ট্য নিয়ে আগ্রহ প্রকাশে হাবিব জানালেন, সোনাদিয়ায় এখন প্রায় ৩০০ পরিবার থাকে। আছে একটি সরকারি স্কুলও। তবে কোনো হাসপাতাল নেই, নেই কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্রও।
প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য জানতে চাইলে তাদের ভাষা বুঝিয়ে বেলাল ভাই বললেন, সোনাদিয়ায় ম্যানগ্রোভ বন, উপকূলীয় বনভূমি, সাগরে গাঢ় নীল পানি, কেয়া বন, লাল কাঁকড়া, বিভিন্ন প্রকারের সামুদ্রিক পাখি রয়েছে। এ কারণেই উত্তাল সাগরপৃষ্ঠ পাড়ি দিয়েও পর্যটকরা ভিড় জমান এখানে।
স্থানীয়দের নাগকির সুবিধা নিশ্চিতের পাশাপাশি পর্যটকদের কথা ভেবে সোনাদিয়ার উন্নয়নে কর্তৃপক্ষ নজর দিলে সেটা জাতীয় স্বার্থই সিদ্ধি করবে বলে সম্ভাবনার বাণী শোনান শুটকি ব্যবসায়ী ইউনুস ও হাফেজ।
বালুর সৈকতে হেঁটে খানিক ক্লান্তিবোধ করছিলাম বলে হয়তো পানির তেষ্টা ভাসছিল চোখে-মুখে। তাই হাফেজই আন্তরিক হয়ে জানতে চাইলেন, পানি পান করাবেন কিনা। আমাদের না করার যুক্তি কোথায়?
বালুর ওপরই কাঠের বেড়া আর টিনের ছাউনিতে গড়ে তোলা শুটকি কারিগরদের ঘরে বসে টিউবওয়েলের ঠাণ্ডা পানি পান করে যখন উঠছিলাম তখন ইউনুস স্মরণ করিয়ে দিলেন বড় সম্ভাবনার কথা, এই দ্বীপটিতে নির্মিত হচ্ছে দেশের গভীর সমুদ্রবন্দর। এই গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সোনাদিয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরো দেশের অর্থনীতির চেহারাই পাল্টে যাবে।
ইউনুস-হাফেজদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বেলাল বলেন, পণ্যবোঝাই বড় বড় জাহাজগুলো বাংলাদেশের কোনো বন্দরে নোঙ্গর করতে পারে না। এ কারণে সেগুলো সিঙ্গাপুর বন্দরে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে ছোট ছোট জাহাজে করে দেশের বন্দরে পণ্য নিয়ে আসতে হয়। যদি সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হয় তবে এখানেই ভিড়তে পারবে বড় বড় সেসব জাহাজ। আর এতে সাশ্রয় হয়ে হবে বিপুল অংকের অর্থ। একইসঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো, চীনের কুনমিং, নেপাল, ভুটান এবং মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যসহ এ অঞ্চলের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর সবচেয়ে উপযোগী হিসেবে আবির্ভূত হবে।
‘অনেককাল আগে জেলেরা এই স্থানে মাছ ধরতে এসে মহামূল্যবান সোনারখণ্ড পেয়েছিলেন, তখন কেউ এই অঞ্চলটার নাম সোনাদিয়া রেখে দেয় এবং সে নামেই এখন দ্বীপটি পরিচিত’-সোনাদিয়ার নামকরণ নিয়ে প্রচলিত এমন কথা জানিয়ে ব্যবসায়ী হাফেজ ও ইউনূস বলেন, কর্তৃপক্ষের নজর হয়তো পড়েছে। এখন বাস্তবায়ন হলে সত্যিই এ দ্বীপ দেশের সোনার দ্বীপে পরিণত হতে পারে।
সম্ভাবনার এমন গল্প শুনে যখন স্পিডবোটে চড়ে ফিরছিলাম তখন পূর্ব পার্শ্বেরই সৈকতে নজরে পড়লো সামুদ্রিক পাখির মিছিল। কেউ একজন দৌড়াতে চাইলেন, কেউ বললেন, খেলুক। তবে সবগুলো একসঙ্গে উড়াল দিলে কেমন লাগবে সেই কৌতূহল থেকে একজন ছুটলেন পাখিদের পিছু পিছু। এই দৃশ্যবন্দি করতে ক্যামেরাপারসন যখন এদিক-ওদিক ছুটছিলেন, তখন আমরা উঠে গেলাম স্পিডবোটে…মিষ্টি পানের দ্বীপ মহেশখালীর উদ্দেশে…অবশ্যই ক্যামেরাপারসনকে নিয়ে!
** মিষ্টি পানের সবুজ দ্বীপ
** খাবারের সন্ধানে সাঁতারু গাভী!
** অটল পাহাড়ের বুকে উদ্দাম সাগর
** শারদ মেঘের দেশে, পাখির ডানায় ভেসে
** গরম গরম ফিশ ফ্রাই
** মহাপতঙ্গের পেটে একঘণ্টা!
** রিজেন্টে ফ্রি কক্সবাজার দর্শন
বাংলাদেশ সময়: ১৩০০ ঘণ্টা, আগস্ট ৩০, ২০১৪