চলো না ঘুরে আসি অজানাতে...! অনুসন্ধানী মনের জানালা খুলতে বা ভ্রমণপিপাসু মনের ক্ষুধা মেটাতে আমরা সবাই প্রতি বছর কোনো না কোনো দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে বের হই। ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে তারা উড়িয়ে দেন সব বাধা।
মাঝে মাঝেই আমরা অজানার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ি। আমাদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাচীন স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম মহাস্থানগড়। মহাস্থানগড় যাওয়া সময়-সাধ্যের ব্যাপার। নানা সমস্যার কারণে হয়তো অনেকের মহাস্থানগড় যাওয়ার সময় ও সুযোগ হয়ে ওঠে না। এজন্য দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে ঘুরে আসতে পারেন মহাস্থানগড় সদৃশ্য ভরত ভায়নার দেউল।
কালের সাক্ষী হিসেবে সগৌরবে এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ভরত ভায়নার দেউল। এটি ইতিহাস আর ঐতিহ্যের প্রতীক। ঐতিহাসিক ও প্রাচীন যুগের অনেক নিদর্শন রয়েছে খুলনার কেশবপুর উপজেলার ভরত ভায়না গ্রামের দেউল বা সপ্তকে।
ভরতের দেউলের ছবি দেখিয়ে আপনি যে কোনো ব্যক্তির মনে কৌতূহলের উদ্রেক ঘটাতে পারেন। জায়গাটি এমনই যে ছবির কোনো ক্যাপশন না দিলে যে কেউ মনে করবেন আপনি হয়তো মহাস্থানগড় ঘুরে এসেছেন।
ভরত ভায়নার (ভরত বাজার) দেউল যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলা থেকে ১৯ কিলোমিটার দক্ষিণ কূল ঘেষে বহমান এককালের খরস্রোতা এবং বর্তমানে ক্ষীণস্রোতা ভদ্রা নদীর তীরে অবস্থিত।
প্রায় দু’হাজার বছর আগে গুপ্ত যুগে এ বিশাল আকৃতির সপ্তকটি নির্মাণ করেছিলেন ভরত রাজা।
স্থানীয়দের কাছে দীর্ঘদিন ধরে ভরতের দেউল, ভরত রাজার দেউল নামে পরিচিত। এ প্রত্নস্থানে খ্রিস্টিয় বিশ শতকের গোড়ার দিকে ১২ দশমিক ২২ মিটার উঁচু এবং ২৬৬ মিটার পরিধি বিশিষ্ট একটি ঢিবির অস্তিত্ব ছিল। ১৮৮৯ সালে বৃটিশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সুপারিন্টেন্ডেন্ট কাশিনাথ দীক্ষিত এ দেউল পরিদর্শনে এসে মন্তব্য করেন যে এটি ৫০ ফুটের অধিক উঁচু এবং ব্যাস ৯০০ ফুটেরও অধিক।
নির্মাণে যে ইট ব্যবহার হয়েছে এতো বড় আকারের ইট এতদঞ্চলের অন্য কোনো পুরাকীর্তিতে ব্যবহার করা হয়নি।
১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে এ দেউলের উপরিভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ১৯৮৪ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে সাত অর্থ বছরের বরাদ্দ পেয়ে এ দেউলে খননের কাজ চালায়। খননের ফলে দেউলটির পূর্ণ অবয়ব মানুষের দৃষ্টিতে আসে।
খননে সমগ্র প্রাসাদটির ভিত থেকে শেষ পর্যন্ত মোট ৯৪টি কক্ষ পাওয়া যায়। চারপাশে ৪টি উইং ওয়াল। এর মধ্যে ১২টি কক্ষ। বাকি ৮২টি কক্ষের সমন্বয়ে এ বৌদ্ধ স্তুপটি তৈরি। স্তুপটির চূড়ায় ৪টি কক্ষ। এ কক্ষের দু’পাশে আরও ৮টি ছোট ছোট কক্ষ রয়েছে। অধিকাংশ কক্ষগুলো মাটি দ্বারা পরিপূর্ণ।
ধারণা করা হয় বৌদ্ধ সপ্তকের উপরিভাগে জাঁকজমকপূর্ণ একটি উপাসনালয় ছিলো। প্রাসাদটির চারপাশে ৩ মিটার চওড়া রাস্তা রয়েছে। উপাসনালয়ের চারপাশে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা প্রদক্ষিণ করে পূণ্য অর্জন করতো। ৪টি উইং দেয়ালে যে ঘরগুলো ছিল সম্ভবত সেগুলোতে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বসবাস করতেন বা অবসর সময় কাটাতেন।
প্রতিটি কক্ষের দেয়াল ৩ মিটার থেকে ১৩ মিটার পর্যন্ত চওড়া। অনেক ইট ৩৬ সেন্টিমিটার থেকে ৫০ সেন্টিমিটার। ইটগুলো দেখলে মনে হবে হাত দিয়ে তৈরি।
সপ্তকটির দেয়াল বড় থেকে ক্রমান্বয়ে ছোট হয়ে সর্বশেষে পৌঁছেছে। মন্দিরটির ছাদ ছিল শিকল আকৃতির। স্তপটিতে দুটি পানির পাতকূয়া ছিলো, সেটাতে কলাগাছ ডুবিয়ে দিলে পাশের ভদ্রা নদীতে গিয়ে ভেসে উঠতো।
স্থানীয়রা জানান, খননকার্য চলাকলীন যে সব পুরাকীর্তি ও জিনিসপত্র পাওয়া গেছে- তার মধ্যে পোড়া মাটির বাঘের মুখমণ্ডল, মানুষের মুখমণ্ডল, দেব-দেবীর হাতের ভগ্নাংশ। বিভিন্ন প্রকৃতির নকশা করা ইট, পোড়া মাটির খেলনা।
এছাড়া বিভিন্ন নকশা করা ইট ও চাড়া পাওয়া গেছে। প্রত্নতাত্ত্বিক জিনিসগুলো খুলনা বিভাগীয় জাদুঘরের গ্যালারিতে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
ভরতের দেউলের স্থানটি বেশ মনোরম এবং প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী খুবই চমৎকার। বিরাট এক প্রাচীন বট বৃক্ষ স্থানটির একাংশ আগলে রেখেছে। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ভদ্রা নদী।
খেঁজুর, আম, জাম, কাঁঠাল আর পাখিদের কলরবে স্থানটি মুখরিত দেখে পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। পর্যটকদের সুবিধার্থে এখানে একটি সুন্দর পিকনিক স্পট তৈরি করা প্রয়োজন বলে সচেতন মহল মনে করেন।
ভরত বাজারের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে এর বেশি কিছু এখনও জানা সম্ভব হয়নি। একেক জন একেক রকম কথা বলেন, পূর্ণাঙ্গ খনন ও আশপাশের অন্যান্য স্থানের খনন কাজ সম্পন্ন হলে প্রকৃত ইতিহাস জানা যাবে বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। শিল্পগুণ বিচারে এগুলোর সময়কাল আনুমানিক খ্রিস্ট্রিয় ৩য় থেকে ৬ষ্ঠ শতকের বলে ধারণা করা যায়।
কীভাবে যাবেন:
ভরতের দেওল দেখতে হলে আপনি যেখানে থাকেন না কেন, আপনাকে প্রথমে খুলনার জেলার চুকনগরে আসতে হবে। সেখান থেকে ভ্যান, ইঞ্জিনচালিত ভ্যান অথবা মোটরসাইকেলে করে আপনাকে ভরত ভায়না নামক স্থানে যেতে হবে।
সেখানে যাওয়ার পর যে কাউকে জিজ্ঞেস করলে বলে দেবে ভরতের দেউল কোথায়। সৌন্দর্যের দিক থেকে কোনো কমতি নেই স্থাপনাটির।
এরপরও যদি আপনার ঘোরার ইচ্ছে থাকে তবে ঘুরে আসতে পারেন ভদ্রা নদীর উপর সদ্য নির্মিত ব্রিজ ও সরকারি বনায়ন কর্মসূচিতে।
প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।
আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।
বাংলাদেশ সময়: ১০২০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৬, ২০১৪