সিলেট: স্বর্গের সিঁড়ি, মানুষ বিক্রির দলিল, প্রাচীন নাগরিলিপি কিংবা দুইমণ ওজনের হাতির দাঁত, সভ্যতার বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়া অসংখ্য স্মৃতি বহন করে চলেছে সিলেটের ভাষাসৈনিক মতিন উদদীন জাদুঘর।
এখানে রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভিন্ন স্মৃতি, ১৩শ’ শতাব্দির কালো পাথরে তৈরি তৈজসপত্র ও কামান।
পারিবারিকভাবে গড়ে উঠা সুবিশাল এই জাদুঘরের অবস্থান সিলেট নগরীর প্রাণকেন্দ্র জিন্দাবাজারের শুকরিয়া মার্কেটের ৪র্থ তলায়। সিলেটের হাতেগোনা কিছু মানুষ ছাড়া জাদুঘরটির অবস্থান সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা নেই। যে কারণে মানুষের আনাগোনাও ছিল কম। তবে, দেশ ও দেশের বাইরে থেকে সিলেট সফরে আসা বিশিষ্টজনরা পা মাড়িয়েছেন এই জাদুঘরে। রয়েছে তাদের ঘুরে যাওয়ার স্মৃতিও।
জাদুঘর ঘুরে দেখা গেছে, প্রাচীন ঘড়ির গ্যালারি, সাটানো রয়েছে ১৭শ’ শতাব্দির মসলিন শাড়ি, প্রাচীন দলিল, ১৭১৯ শতাব্দির সংস্কৃত শিলালিপি, প্রচীন যুগে ব্যবহৃত বিভিন্ন অস্ত্র, নেপালি ছুরি-খাপসহ তলোয়ার ও গুপ্তি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত কামানের গোলার ক্যাপসুল, বিভিন্ন দেশের প্রাচীন মুদ্রা, ১৯৪৬ সালের ওরিয়েন্ট প্রেসসহ ইতিহাসের নানা অজানা উপকরণ। এসব উপকরণ যে কাউকে সমৃদ্ধ করবে।
দর্শনার্থীদের কথা চিন্তা করে অনেকটা আড়ালে থাকা এই জাদুঘর এবার শাহজালাল (র.) দরগাহ গেইট সংলগ্ন কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে (কেমুসাস) স্থানান্তর হচ্ছে।
মতিন উদদীন জাদুঘরের পরিচালক ডা. মোস্তফা শাহজামান চৌধুরী বাহার এসব তথ্য নিশ্চিত করে বাংলানিউজকে বলেন, ভাষা সৈনিক মতিন উদদীনের ইচ্ছে ছিল নিজের সংগৃহীত নিদর্শন ও জিনিসপত্র দিয়ে একটি জাদুঘর প্রতিষ্টার। তার জীবদ্দশায় তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সংগৃহীত এসব নিদর্শন দিয়ে নিজস্ব বাণিজ্যিক ভবন শুকরিয়া মার্কেটের ৪র্থ তলায় ১৬শ’ স্কয়ার ফুট জায়গার মধ্যে জাদুঘরটি গড়ে তোলা হয়। বর্তমানে জাদুঘরের নিদর্শনের সংখ্যা চার হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
জাদুঘরটি বাণিজ্যিক ভবনে হওয়ায় দর্শনার্থীদের আনাগোনাও ছিল কম। এবার কেমুসাসের ৫ম তলায় ৫০০ স্কয়ার ফুটের জায়গায় জাদুঘরটি আগামী এক মাসের মধ্যে স্থানান্তর হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে এখান থেকে কিছু জিনিসপত্র জাদুঘরটির নতুন ঠিকানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
ডা. মোস্তফা শাহজামান চৌধুরী বাহার বলেন, তার অবর্তমানে জাদুঘরের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেবে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ। এতে করে জাদুঘরটি যুগ যুগ ঠিকে থাকবে। তাছাড়া দরগাহ সংলগ্ন হওয়ায় দর্শনার্থীও টানতে পারবে জাদুঘরটি।
জীবন থেকে নেওয়া
১৯০০ সালের ১০ জুন সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার আটগ্রামে গিয়াস উদদীন ও মিসবাহ-উন-নেছা দম্পতির কোল আলো করে জন্ম নেন মতিন উদদীন। পৈত্রিক নিবাস উপজেলার ওমরপুর গ্রামে। তার পূর্বপুরুষ ছিলেন জমিদার বংশীয়।
১৯১৮ সালে করিমগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাশ করেন মতিন উদদীন। ১৯২০ সালে মুরারি চাঁদ (এমসি) কলেজ থেকে আইএ, কলকাতা রিপন কলেজ (বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) থেকে ১৯২২ সালে বিএ এবং ১৯২৬ সালে বিএল ডিগ্রি লাভ করেন।
চাকরি জীবনে ১৯২৭ সালে আসাম জুনিয়র সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। দীর্ঘচাকরি জীবন শেষে ১৯৫৮ সালে অবসর গ্রহণ করেন। অবসরে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন মতিন উদদীন। এ সময় রম্য লেখক হিসেবে খ্যাতিলাভ করেন তিনি। তার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ‘খোকা-খুকু’ নামক শিশু মাসিক পত্রিকায়।
১৯৪৭ সালের ৯ নভেম্বর সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে রাষ্ট্রভাষার উপর আলোচনার আহ্বান করেন মতিন উদদীন।
একই বছরের ৩০ নভেম্বর সিলেট আলিয়া মাদরাসা মাঠে রাষ্ট্রভাষার উপর প্রথম সমাবেশ করেন। তখনো রাষ্ট্রভাষা নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে কোনো সভা-সমাবেশ হয়নি। রাষ্ট্রভাষার উপর এটিই ছিল প্রথম কোনো সভা-সমাবেশ।
(উল্লেখ্য: এই জাদুঘরের ভিতরের বা বাইরের ছবি তোলার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে কর্তৃপক্ষের। এই ছবিগুলো স্থানান্তরের সময় তোলা। )
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৪