গাজীপুরের শালনা বাঁশবাড়ি নামক এলাকায় বেড়িয়ে এলাম। জোয়ারের পানিতে ডুবে গিয়েছে ক্ষেত-মাঠ।
আগের দিন রাতে সব কিছু ফাইনাল করে ঘরে ফিরি। ভেবেছিলাম নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পরব। তা আর হলো কই! নির্ঘুম রাত গড়াগড়ি করতে করতে ভোর হয়ে যায়। অবশেষে জোর করে নিজেকে ঘুম পাড়িয়ে নিলাম। কিন্তু ঘুম বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। সকাল ৯টায় ঘুম ভেঙে যায়। বন্ধু শাকিলকে বার কয়েক ফোন করে না পেয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। যাওয়া হবে কি হবে না। পরে শাকিলের ফোন পেয়ে নিশ্চিত হলাম যাওয়া হচ্ছে।
পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বেলা ১২টায় বের হওয়ার কথা থাকলেও বের হতে হতে ৩টা বেজে যায়। মহাখালী থেকে মোটর সাইকেল যোগে গাজীপুরের উদ্দেশে রওনা হই। যাত্রার শুরু থেকেই রাস্তায় ভয়াবহ রকমের জ্যাম ছিল। মোটর সাইকেল থাকায় রক্ষা। নয়তো বাসে গেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে আটকা পরে থাকতে হতো।
জ্যামের মাঝে ফাঁক-ফোকর দিয়ে মোটর সাইকেলে চললাম আমরা। টঙ্গী ব্রিজ পেরিয়েও জ্যাম। গাজীপুরা পেরিয়ে একটি চায়ের দোকানের সামনে যাত্রা বিরতি করি। চা-পান করে রিফ্রেশ মনে আবার ছুটলাম।
গাজীপুর চৌরাস্তার পরে রাস্তার চিত্র ভয়াবহ। বড় বড় গর্ত, কাদা-পানি। গতি একেবারে কমিয়ে মোটর সাইকেল চালিয়ে নিতে খুব কষ্ট হয়েছে। চৌরাস্তা থেকে শালনা কয়েক মিনিটের পথ যেতে মনে হয়েছে কয়েক ঘণ্টা লাগলো।
শালনা পৌঁছে গলির একটু ভিতরে গিয়ে দেখলাম রাস্তা দু'টি ভাগ হয়েছে। একটি বায়ে। আরেকটি ডানে। আমাদের গন্তব্য বাঁশবাড়ি। শাকিল ছাড়া এর আগে আমরা কেউই এখানে আসিনি। শাকিলে প্রশ্ন করলাম, কোন পথে যাব! ও উত্তর দিল, ডানে। ওর কথা মতো ডানের পথে চললাম। এখানকার রাস্তাও খুব বেশি সুবিধার না। একটু ভালো, একটু খারাপ। রাস্তার গর্তগুলো বালি ফেলে ভরাট করা। কোথাও কোথাও বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে গেছে বালি।
খুব সতর্কতার সাথে মোটর সাইকেল চালাতে হচ্ছে। মোটর সাইকেলের চাকা বারবার স্লিপ করছিল। এভাবে অনেকটা পথ এগিয়ে যাওয়ার পর শাকিল বলল, আমরা মনে হয় ভুল পথে এসেছি। নয়তো এত সময় তো লাগার কথা না। ওর এমন কথা শুনে থামলাম। বললাম, আমরা তো আর চিনি না। তুই কি চিনিস না! শাকিল উত্তর দেয়, অনেক বছর আগে এসেছিলাম তো ভুইল্লা গেছি। নিরুপায় হয়ে পথে একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, ভাই বাঁশবাড়ি কোনদিকে? লোকটি উত্তর দেয়, 'বাঁশবাড়ি তো এই পথে না। শালনা দিয়ে ঢুকতে যে বাম দিকে রাস্তা গেছে ওইটা বাঁশবাড়ি যাওয়ার পথ। '
ঘুরে বাঁশবাড়ির পথে পা বাড়ালাম। পাকা সড়ক শেষে মাটির পথ। আমাদের যেতে হবে অল্প একটু পথ। এ পথে মোটর সাইকেল চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে ঠেলে নিয়ে যেতে হলো। তখন দিনের আলো হারিয়ে অন্ধকার নেমে এসেছে। পথের দু'পাশেই থৈ থৈ পানি। এ পানি বর্ষার পানি।
এরই মধ্যে একটি ট্রলারের আওয়াজ শুনতে পেলাম। ট্রলার থেকে একজনের ডাক শুনতে পাওয়া গেল, শাকিল... শাকিল...
শাকিল উত্তর দেয়, কে? কাউসার! ট্রলারটি আমাদের কাছাকাছি ঘাটে ভিড়লে একটি ছেলে টর্চ লাইট হাতে নেমে এলো। ছেলেটি শাকিলের ফুফাতো ভাই কাউসার। আমরা এখানে কাউসারদের বাড়িতেই উঠব। রাস্তা থেকে তাদের বাড়িটি দেখা যাচ্ছিল। বাড়ির চারিদিকে পানি। মনে হয়েছে যেন একটি দ্বীপ মাথা উঁচু করে আছে।
রাস্তার পাশের একটি বাড়িতে মোটর সাইকেলগুলো রেখে ট্রলারে করে কাউসারদের বাড়িতে নামলাম। রাতের খাবার শেষে বাড়ির পিছন দিকে পানি সীমানার কাছাকাছি গল্প-গুজবে সময় কাটাই আমরা। নিজেদের মাঝে তর্ক-বিতর্ক সব মিলিয়ে আনন্দ আড্ডা জমে। আড্ডা চলে রাত প্রায় আড়াইটা পর্যন্ত। এরপর বিছানায় শরীর রাখতেই ক্লান্ত চোখে ঘুম নেমে এলো।
সকালে যখন ঘুম থেকে উঠলাম ঘড়ির কাটায় প্রায় ১০টা। খিচুড়ি দিয়ে নাস্তা করলাম। দিনের আলোয় বাড়ির উঠোন থেকে পারিপার্শ্বিক দৃশ্য অসম্ভব সুন্দর লাগছিল। পানিতে ঘেরা বাড়িতে আমরা যেন পানিবন্দি। সে এক অন্য রকম অনুভূতি। যেদিকে চোখ যায় পানি আর পানি।
নদীর পানি, পুকুরের পানি, খালের পানি ও বিলের পানি সব মিলে মিশে একাকার। রাস্তা-ঘাট, ক্ষেত-মাঠ ডুবে নতুন রূপ নিয়েছে।
এদিক সেদিক যতদূর চোখ যায় বাড়ি-ঘরগুলো যেন খণ্ড খণ্ড দ্বীপ। পানির গভীরতা নিয়ে অনিশ্চিত ধারণা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরলাম পানিতে। যারা সাতার জানে না ওরা আমার সিগনালের অপেক্ষায় থাকল। পানির গভীরতা খুব অল্প অনুভব করলাম। ওদের সিগনাল দিলাম, পানির গভীরতা কম, তোরাও নেমে আয়। আমার সিগনাল পেয়ে ওরাও ঝাঁপ দিল। এখানে পানি কম থাকার কারণ, ফসলি জমিতে বন্যার পানি জমেছে। পানিতে নেমে একটু একটু করে এগিয়ে গিয়ে আমি গভীরতা খুঁজতে থাকি। অনেকটা দূরে গিয়ে দেখলাম ঠাঁই পাওয়া যাচ্ছে না। পানির গভীরতায় সাঁতার কাটলাম। এরপর কিনারায় গিয়ে সবার সাথে ঝাঁপাঝাপি করলাম। এভাবে কেটে যায় প্রায় দুই ঘণ্টা।
দুপুর দেড়টায় একশ’ টাকা ঘণ্টায় একটি ট্রলার ভাড়া করি। সবাই উঠলাম ট্রলারে। ঘণ্টা খানেক পর মাঝির কাছে জানলাম ট্রলারের তেল ফুরিয়ে এসেছে। তেল কিনতে হবে। টলার ঘুরিয়ে তেল কিনতে চলল মাঝি। চলন্ত ট্রলার থেকে একটু দূরে পানির মাঝে একটি দোকান দেখতে পেলাম। যা আমাদের সবাইকে অবাক করলো। ট্রলারটি সেই দোকানের পাশেই থামল। সবার দৃষ্টি দোকানটির দিকে। এটিই তেলের দোকান। জানলাম, বন্যার পানিতে ডুবেছে রাস্তা, সেখানে পাড়ার এ চায়ের দোকানটি যেন মাথা উঁচু করে ভেসে আছে। জীবনের তাগিতে চায়ের দোকানের পরিবর্তে স্টিমার-ট্রলারের তেল বিক্রি হয় দোকানটিতে।
একজন নারী বিক্রেতা তেল বিক্রির জন্য অপেক্ষায় বসে থাকেন স্টিমার অথবা ট্রলারের আশায়। তেল নেওয়া শেষে মাঝি ট্রলারের ইঞ্জিন চালু করলো। তারপর আমরা ঘণ্টা তিনেক ঘুরলাম। অতঃপর সন্ধ্যায় স্মরণীয় কিছু স্মৃতি নিয়ে আমরা বাড়ি ফিরে এলাম।
প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।
আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১০, ২০১৪