খুলনা: একঘেয়েমি ক্লান্ত কর্মময় জীবন থেকে ছুটি নিয়ে বেড়িয়ে আসতে পারেন সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুন্দরবনে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এ ম্যানগ্রোভ বনে গাঢ় সবুজের সমারোহ।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, অ্যাডভেঞ্চার, ভয় ও শিহরণের স্থান সুন্দরবন। জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ। প্রকৃতির অকৃপণ হাতের সৃষ্টি। সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল হরিণ, সাপ, বানর, মাছসহ নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণী পৃথিবী বিখ্যাত। পর্যটকদের কাছে সুন্দরবনের আকর্ষণ তাই দুর্ণিবার।
আগামী ১ নভেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে সুন্দরবনের পর্যটন মৌসুম। পরিবার-পরিজন নিয়ে আপনিও ঘুরতে পারেন জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এ বনে।
এখানে সময় কাটাতে পারেন হরিণ দেখে, বাঘ খুঁজে, বানর ও কুমিরের সঙ্গে লুকোচুরি করে। কিংবা নির্জন বনের সি-বিচে গোসল ও সাতার কেটে।
সুন্দরবনের সীমা ও অবস্থান
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে খুলনা-বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার সাতটি থানা এলাকায় সুন্দরবনের মোট আয়তন প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটার। বঙ্গোপসাগরের তীরে ৮৯ ডিগ্রি থেকে ৯০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশ ও ২১.০৩ ডিগ্রি থেকে ২২.৩০ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশের মাঝে সুন্দরবন অবস্থিত। এর মধ্যে বন প্রায় ৪০১৬.৮৫ বর্গকিলোমিটার, নদী খাল ও অন্যান্য চ্যানেল ১৭৫৬ বর্গকিলোমিটার। সুন্দরবনের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পশ্চিমে রায়মঙ্গল, হাড়িয়াডাঙ্গা ও কালিন্দি নদী। উত্তরে বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলা, পূর্বে ধলেশ্বর ও হরিণঘাটা নদী, পিরোজপুর ও বরিশাল জেলা।
দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের বিশাল এলাকাজুড়ে সুন্দরবনের অবস্থান। দুইশ’ বছর আগে মূল সুন্দরবনের বিস্তৃতি ছিল প্রায় ১৬ হাজার ৭০০ বর্গকিলোমিটার।
সঙ্কুচিত হতে হতে বর্তমানে প্রকৃত আয়তন এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটারে। ব্রিটিশ ভারত বিভাগের পর সুন্দরবনের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ পড়েছে বাংলাদেশে এবং বাকিটা ভারতে। এ হিসেবে সুন্দরবনের বাংলাদেশের অংশ প্রায় ৫ হাজার ৮০০ বর্গকিলোমিটার এবং ভারতের অংশে প্রায় ৪ হাজার ২০০ বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশ অংশের মধ্যে প্রায় ৪ হাজার ১০০ বর্গকিলোমিটার স্থলভাগ ও ১ হাজার ৭০০ বর্গ কিলোমিটার জলাভূমি।
পূর্ব ও পশ্চিম দুই বিভাগের অধীনে চারটি প্রশাসনিক রেঞ্জে ভাগ করা হয়েছে সুন্দরবনকে। রেঞ্জগুলো হলো চাঁদপাই, শরণখোলা, খুলনা ও সাতক্ষীরা। ১৮৭৫ সালে সুন্দরবনকে প্রথম সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে প্রায় ৩২ হাজার ৪০০ হেক্টর এলাকা বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ১৯৯৭ সালে সুন্দরবন ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পায়। ৭৯৮তম বিশ্ব ঐতিহ্য এটি।
কী আছে সুন্দরবনে
বিশ্ববিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল হরিণ, বনমোরগ, শূকর, হরেক রকম বানর, অজগর, বহু প্রজাতির পাখি, অপরূপ লতাগুল্ম ও বৃক্ষরাজি এবং নদীতে নানা প্রজাতির মাছ রয়েছে।
গাছের মধ্যে সুন্দরী, কেওড়া, গরান, বাইন, গেওয়া, পশুর, গোলপাতা, হেতাল, কাঁকড়া, ঝানা, সিংড়া, খলসা ইত্যাদি।
নদীতে নানা প্রজাতির মাঝে কুমির ও ভয়াল অজগরসহ প্রায় ৩৩ প্রজাতির সরীসৃপ বাস করে সুন্দরবনে। এছাড়াও শীতকালে অসংখ্য অতিথি পাখির আগমন ঘটে সুন্দরবন অঞ্চলে। প্রকৃতির নিজ হাতে গড়া সুন্দরবনের এই অপরূপ সৌন্দর্য যে কাউকে মুগ্ধ করে। সুন্দরবনে সুন্দরী গাছের প্রাচুর্য থেকে বা এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে এর নামকরণ করা হয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন।
এক পরিসংখ্যান মতে সুন্দরবনে বর্তমানে প্রায় সাড়ে চারশ’ ডোরাকাটা বাঘ বা রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও ত্রিশ হাজারেরও বেশি চিত্রা হরিণের বসবাস। এ ছাড়া মায়া হরিণ, বন্য শূকর, বানর, গুঁইসাপ, ভোঁদড়, ডলফিন, লোনাপানির কুমির, কিং কোবরা, বেঙ্গল কোবরা, অজগর ইত্যাদি বন্যপ্রাণীর দেখা মেলে সুন্দরবনে।
সুন্দরবনে প্রায় ৩৩০ প্রজাতির গাছপালা রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সুন্দরী, কেওড়া, পশুর, ধুন্দল, আমুর, গরান, গর্জন, খোলশী, বলা, হেতাল, গোলপাতা, টাইগার ফার্ন, হারগোজা ইত্যাদি।
স্থানীয় ও পরিযায়ী মিলে সুন্দরবনে প্রায় ২৭০ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। এর মধ্যে বড় সাদা বক, সি ঈগল, বাজ, মাস্ক ফিঙ্কফুট, বিভিন্ন প্রজাতির মাছরাঙা, ফিঙে, সুঁইচোরা, কাঠঠোকরা, বন মোরগ উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া প্রায় চারশ’ রকম মাছ পাওয়া যায় সুন্দরবন এলাকায়।
সুন্দরবনের আকর্ষণ
পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন। ক্যামেরার সাহায্যে বন্যজন্তুর ছবি তোলার সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে পৃথিবী বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ ছাড়াও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর দর্শন সহজলভ্য। তবে নিরাপত্তার বিষয়টি অবশ্যই বিবেচ্য।
জেলে, বাওয়ালি, মৌয়ালদের সঙ্গে দেখা ও কথা বলার সুযোগ পেতে পারেন অনায়াসেই। রাতে সুন্দরবনের শান্ত স্নিগ্ধ রূপ আর নদী সমুদ্রের সৌন্দর্য অপরূপ। এসব ছাড়াও সুন্দরবনের আশপাশে রয়েছে অসংখ্য পর্যটন আকর্ষণীয় স্থান।
মন ভরে দেখতে পারেন সুন্দরবনে দর্শনীয় স্থান - করমজল, কটকা, কচিখালী, পক্ষীর চর, ডিমের চর, তিনকোনা, হারবাড়িয়া, কোকিলমোনি, হিরণপয়েন্ট, দুবলারচর ও আলোরকোল। এ স্পটগুলোর প্রতি পর্যটকদের মূল আকর্ষণ। মংলা থেকে মাত্র ১ থেকে দেড় ঘণ্টায় যাওয়া যায় সুন্দরবনের করমজলে। এখানে বন বিভাগ কুমির প্রজনন খামার ও মিনি চিড়িয়াখানা তৈরি করেছে।
কচিখালীতে আছে সুন্দরবনের অপার সৌন্দর্যের হাতছানি। ভ্রমণ-পিপাসুদের জন্য কচিখালী হচ্ছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান। এরপর কটকা ও হিরণপয়েন্ট। এ ৩টি পয়েন্টে মংলা থেকে ট্রলারে করে পৌঁছাতে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা সময় লাগে। বনের কটকাতে রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার। এ টাওয়ারে উঠে একনজরে দেখে নেওয়া যায় অপূর্ব সুন্দর সুন্দরবনকে। এর চেয়ে একটু বেশি সময় নিয়ে পৌঁছানো যায় দুবলারচর ও আলোরকোল। আলোরকোল পর্যটকদের কাছে বাড়তি আকর্ষণ। এখান থেকে সূর্য উদয় ও অস্তের দৃশ্য দেখার জন্য ভ্রমণ-পিপাসুরা ভিড় জমান। যেন পানির ভেতর থেকে সূর্য উঠে আসে আবার ডুবে যায়। এ দৃশ্য দেখার জন্য সবাইকে হাতছানি দেয়।
দুবলারচরে গেলে দেখা যাবে বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে অস্থায়ী জেলেপল্লী। হাজার হাজার জেলে ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছেন এই চরে।
৬ বার রূপ বদলায় সুন্দরবন:
প্রায় ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট এই সুন্দরবন ২৪ ঘণ্টায় কমপক্ষে ৬ বার তার রূপ বদলায়। খুব ভোরে এক রূপ, দুপুরে অন্যরূপ, পড়ন্ত বিকালে আরেক রূপ, সন্ধ্যায় সাজ নেয় ভিন্নরূপে। মধ্য ও গভীর রাতে সৌন্দর্য আরেক রকম। আর যদি চাঁদনি রাত হয়, তবে তো কথাই নেই। এর সব ক’টি রূপ আপনাকে দেখতে হলে অবশ্যই একটু সময় নিয়ে আসতে হবে।
এ বনে ঝুঁকি এড়াতে ভ্রমণের সময় বনরক্ষীদের সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে।
যেভাবে যেতে হয় সুন্দরবনে
ঢাকার মতিঝিল, আরামবাগ, শ্যামলী, কল্যাণপুর, গাবতলী থেকে গ্রিনলাইন, সোহাগ, হানিফ, ঈগল, এ কে ট্রাভেলসসহ বিভিন্ন এসি/ননএসি বাস খুলনার উদ্দেশে ছেড়ে যায় সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত। খুলনা নেমে লোকাল বাসে বাগেরহাট, মংলা যাওয়া যাবে। এছাড়া সায়েদাবাদ থেকে সুন্দরবন, পর্যটক, বনফুলসহ বিভিন্ন বাস খুলনা, বাগেরহাট ও মংলার উদ্দেশে ছেড়ে যায় সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত। এছাড়া খুলনায় ট্রেনে এবং যশোর পর্যন্ত বিমানে যাওয়া যাবে। পাশাপাশি নৌ-পথেও আসা যায়।
যেখানে থাকবেন ও খাবেন :
খুলনায় থাকা-খাওয়ার জন্য হোটেল সিটি ইন (০৪১-২৮৩৪০৬৭), হোটেল রয়্যাল (০৪১-৭৩০৭১৪), হোটেল ক্যাসল সালাম (০৪১-৭৩০৩৪১), হোটেল এ্যাম্বাসেডর (০৪১-৭২২৩৭০), হোটেল টাইগার গার্ডেনসহ (০৪১-৭২২২৪৬) বেশ কয়েকটি ভালো মানের হোটেল রয়েছে। বাগেরহাটে থাকতে চাইলে বাগেরহাট সদরে আছে বেশকিছু হোটেল। মংলায় আছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মোটেল পশুর (০১৭৭৩-০৪৪৪৭০) এছাড়া আমিন ইন্টারন্যাশনাল লি. (০১৭২৫-৮১৯৪৫৩)।
আপনার ভ্রমণ পরিকল্পনা অনুযায়ী সুন্দরবন ঘুরিয়ে দেখাতে রয়েছে বিভিন্ন বেসরকারি ভ্রমণ সংস্থা।
এর মধ্যে খুলনার উল্লেখযোগ্য- সাওদান ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলস ( ০১৭১২-৭৭৩৩৬১),এক্সপ্লোর ট্যুরিজম কর্পোরেশন লি.( ০১৭১১-১৭৬৫৯৩), দি গাইড ট্যুরস লি. (০১৭১১-৫৪০৪৩১), ভীশন ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলস লি. (০১৭১১-০০০০৩৮), দি বেঙ্গল ট্যুরস লি.।
সুন্দরবনে ভ্রমনের সহযোগী সংগঠন মংলা লঞ্চ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকদের জন্য বিভিন্ন ধরণের লঞ্চ, ট্রলার রয়েছে।
তিনি জানান, মিনি দোতলা ১৬ কেবিনের একটি লঞ্চে ৩৪ জন একসঙ্গে সুন্দরবন যেতে পারেন। তিন দিনের এ ট্যুরে খাওয়া দাওয়াসহ সব মিলে ভাড়া ২ লাখ ৫২ হাজার টাকা। এছাড়া এক দিন এক দুপুরের ট্যুরের জন্য বিভিন্ন ভাড়ায় লঞ্চ ও ট্রলার পাওয়া যায়।
করমজল পর্যটন ও বণ্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের কর্মকর্তা আব্দুর রব রোববার বাংলানিউজকে বলেন, নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সুন্দরবনে পর্যটন মৌসুম চলবে।
এ সময়ের মধ্যে কর্মব্যস্ত জীবন থেকে একচিলতে সময় সজীব সবুজের মধ্যে জুড়িয়ে নিতে পারেন প্রাণটা। এজন্য বন বিভাগ সব ধরণের সহযোগিতা করবে।
তিনি জানান, সুন্দরবন দেখার জন্য করমজলে প্রবেশের জন্য দেশি পর্যটকদের জনপ্রতি ২০ টাকা, বিদেশিদের ৩০০ টাকা, ভিডিও ক্যামেরা দেশি ২০০ টাকা, বিদেশি ৩০০ টাকা। এছাড়া সব কিছুর ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়।
প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।
আর একটা কথা, লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে একদম ভুলবেন না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।
বাংলাদেশ সময়: ০১৫২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২২, ২০১৪