ভ্রমণ সবারই প্রিয়। অন্যদের মতো আমাকেও বিষয়টি খুবই টানে।
নানাভাবে সঠিক খোঁজ-খবর নিয়ে ও সুন্দর পরিকল্পনা করে বের হয়ে যাই ভ্রমণে...
নভেম্বর, ২০১৪। এবার গন্তব্য অস্ট্রেলিয়া। সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে সিডনি বিমানবন্দরে প্লেন অবতরণ করলে বের হয়ে ইমিগ্রেশনের নানা আনুষ্ঠানিকতা শেষ করলাম।
পরে গিয়ে উঠলাম জর্জ স্ট্রিটের নির্ধারিত হোটেলে। সেখানে বিশ্রাম নিয়ে পরদিন থেকে শুরু করলাম ভ্রমণ!
ওশেনিয়া অঞ্চলে অবস্থিত অস্ট্রেলিয়ার ছয় অঙ্গরাজ্য আছে ছয়টি। এগুলো হচ্ছে- নিউ সাউথ ওয়েলস, কুইন্সল্যান্ড, দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া, তাসমানিয়া, ভিক্টোরিয়া এবং পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া। রয়েছে দুটি টেরিটরিও।
দেশটির বড় শহরগুলোর মধ্যে সিডনি, মেলবোর্ন , ব্রিসবেন, এডেলেড, তাসমানিয়া ডারউইন পার্থ ও গোন্ডকোস্ট অন্যতম। রাজধানী হচ্ছে ক্যানবেরায়।
এরমধ্যে নিউ সাউথ ওয়েলসের রাজধানী সিডনি সবচেয়ে প্রাচীন ও বৃহত্তম এবং ব্যস্ত শহর। পাহাড় কেটে তৈরি এই শহরকে ঘিরে রয়েছে মনোরেল।
পাহাড়ি এলাকা বলে এখানকার পথঘাট ও অবস্থান বেশ উঁচু-নিচু। চারপাশে মানুষজনের ছুটোছুটি আর ব্যস্ততা হলেও তাদের রয়েছে এক অদ্ভূত শৃঙ্খলা বোধ। উন্নত জীবনযাত্রার মধ্যে আছে মার্জিত আচরণ এবং সহযোগিতার প্রবণতা।
এ অঞ্চলের আবহাওয়ার চিত্র ঠিক বাংলাদেশের বিপরীতে। বাংলাদেশে যখন শীত অনুভূত হয় অস্ট্রেলিয়ায় তখন প্রচণ্ড গরম।
নভেম্বরে সিডনি থাকে পর্যটক মুখর। এমনিতেই এই মহানগরে বিভিন্ন জাতির বসবাস, এরমধ্যে পর্যটকের পদচারণা আরও বর্ণময় করে তুলেছে এই শহরকে।
ফলে ট্রেন-বাস কিংবা ফুটপাথে দেখে কাউকে বুঝার উপায় নেই যে কে কোন দেশের মানুষ। কান পাতলে শোনা যাবে-সঙ্গীদের সঙ্গে কেউ কথা বলছে চীনা ভাষা, কেউ ফরাসি বা হিন্দিতে, কেউ বা অকৃত্রিম বাংলায়। ইংরেজি ভাষাভাষী তো আছেই।
সিডনির কিছু স্মৃতি কোনো দিনই মন থেকে মোছা যাবে না। কেননা এই শহরেই এসে প্রথম দেখেছি প্রশান্ত মহাসাগরের বন্ডাই বিচে। নীল জল, ঢেউগুলো অনেকটা বঙ্গোপসাগরের মতোই, তবু যেন কেমন অন্য রকম!
পৃথিবীর মোট স্থলভূমিকে যে মহাসমুদ্রটা ঢেকে দিতে পারে, যার অতল গহ্বরে ডুবে যাবে মাউন্ট এভারেস্ট, তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে গা ছমছম না করে কী পারে? আমারও তাই হলো!
তবে দেখি অনেক লোক নিশ্চিন্তে জলে নেমে খুবই উপভোগ করছে, এরমধ্যেই আকস্মিক সাইরেন বেজে উঠলো– হাঙর আসছে! হুড়মুড়িয়ে সবাই তীরে উঠতে লাগলো। লাইফ বোটগুলোও বেশ সজাগ।
সিডনি বন্দর ও পোতাশ্রয় হচ্ছে প্রাকৃতিক। শহরের বিভিন্ন অংশে প্রশান্ত মহাসাগরের বা খাঁড়ির বিভিন্ন অংশ ডালপালা মেলেছে। ফলে এই অপূর্ব শহরের প্রায় সর্বত্র প্রশান্ত মহাসাগরের দেখা মেলে।
এরপর আরও কয়েক বার দেখা হয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরের সঙ্গে। ম্যানলি কিংবা পাম বিচসহ অন্যান্য বিচগুলোতে। শহরের প্রায় ২০ কিলোমিটার জুড়ে কমপক্ষে ৩০টির মতো সৈকত আছে।
সিডনির অন্যতম আকর্ষন হচ্ছে পৃথিবী বিখ্যাত ‘সিডনি হারবার ব্রিজ’। বিশ্বের একক স্প্যান বিশিষ্ট সবচেয়ে প্রশস্ত সেতু এটি। যা ঘুরে বেশ ভালো লেগেছে।
স্টিলের তৈরি এ ব্রিজের আয়তন প্রায় ১ হাজার ১৪৯ মিটার। ১৯২৩ সালের ২৮ জুলাই শুরু হয়ে কাজ শেষ হয় ১৯৩২ সালের ১৯ জানুয়ারিতে।
এবার আসি অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত অপেরা হাউজের কথায়। বিশ্বের অন্যতম সুন্দর নির্মাণ শৈলী সিডনি অপেরা হাউজ। অসাধারণ স্থাপত্যে নির্মিত হাউজটি দেখলে মনে হয় পানির ওপর ভাসমান কয়েকটি নৌকার সফেদ পাল। আবার মনে হতে পারে শ্বেতশুভ্র বিশাল রাজহাঁসের ঝাঁক! তেইশ তলা সমান উঁচু এই অপূর্ব ভবনটিতে দুই হাজার ছয়শ নব্বইটি আসনসহ একটি কনসার্ট হল, একটি ড্রামা থিয়েটার ও একটি প্লে-হাউজ রয়েছে। বাইরের চত্বরটিও বিস্তৃত ও সুদৃশ্য।
ড্যানিশ স্থপতি জন অ্যাডজেনের নকশায় ১৯৫৯ সালে শুরু হয়ে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৭৩ সালে।
হাউজের ভেতরে গিয়ে দেখলাম, সারি সারি গ্যালারি জুড়ে অসংখ্য শ্রোতা-দর্শককের ভিড়। টিকিট কেটে নির্দিষ্ট আসনে গিয়ে আমিও বসলাম। শুরু হল অপূর্ব সুর লহরী।
পুরো মঞ্চ জুড়ে বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বসেছেন কুশলীরা। বাজাচ্ছেন অপূর্ব সুরে একই ছন্দে একই লয়ে। যে কেউ বিমোহিত হবেন!
ডারলিং হারবারের জায়গাটিও খুব সুন্দর। চাইনিজ গার্ডেনে গিয়ে মুগ্ধ হতেই হবে! এতো সুন্দর রকি গার্ডেন। ঝিরিঝিরি পানির ফোয়ারা। নানা রকম গাছ-গাছালি, কী যে সুন্দর। সমুদ্রের বুকে ভাসতে ভাসতেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখার ফাঁকে সেরে নিলাম ডিনার।
একদিন সকালে বেরিয়ে পড়লাম মাদাম তুসোর মোমের জাদুঘর দেখতে। মোমের মিউজিয়াম, ওয়াইল্ড লাইফ ও অ্যাকুইরিয়ামও দেখলাম। চমৎকার! মিউজিয়ামে ঢুকতেই চোখে পড়ে অস্ট্রেলিয়া নামের এই সুন্দর দ্বীপটির আবিষ্কারক ক্যাপ্টেন কুকের মোমের মূর্তি।
পুরো কক্ষজুড়ে জাহাজের মোটা দড়ি-পাল, কাঠের বিশাল স্টিয়ারিং সাজানো। মনে হয় এইমাত্র ক্যাপ্টেন কুক অস্ট্রেলিয়ার অস্তিত্ব আবিষ্কার করলেন!
ভেতরে রয়েছে আরও বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের মোমের মূর্তি। অ্যাকুইরিয়ামে রয়েছে বিশেষ বিশেষ প্রজাতির মাছ। কোরাল শোভিত অ্যাকুইরিয়ামও বেশ আকর্ষণীয়। অক্টোপাস, জেলিফিশ আরও কত নাম না জানা মাছের সমাহার।
ওয়াইল্ড লাইফ যেন এক বিস্ময়কর ভুবন। কী নেই এই রাজ্যে! সাপ খোপ, বিশাল অলস কুমির, গুইসাপ, গিরগিটি, মাঠময় বিচরণ করছে ইমু পাখি, অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত প্রাণী ক্যাঙ্গারু।
আর গাছের ডালে জড়ো সড়ো হয়ে বসে আছে লাজুক কোয়ালা, কচি পাতা খায় আর জুলজুল করে তাকিয়ে থাকে ভয়াতুর চোখ মেলে। একদিন বিকেলে তিমি দর্শনে গেলাম সমুদ্রে। বেশ উত্তেজনাকর ভ্রমণ ছিল এটা।
প্রথমে কিছুই টের পাইনি, ভেবেছি সহজেই আনন্দে ভাসতে ভাসতে তিমি দেখবো! দেশি-বিদেশি বৃদ্ধ,যুবা ও শিশু অনেক পর্যটকের সঙ্গে আমিও আনন্দিত মনে সমুদ্রের ঢেউ দেখছি।
এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেল প্রবল দুলুনি। সবার নাকাল অবস্থা স্বত্ত্বেও তিমি দর্শনের জন্যই উৎগ্রীব ছিরাম আমরা। হঠাৎ একজন চিৎকার করছেন- ঐ দেখ দেখ...। দেখা মিললো তিমির!
এভাবে দেখতে দেখতে আনন্দের মধ্যে কোথায় যে এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেল তা টেরই পাইনি। কিন্তু ফিরতে তো হবেই...বাংলা মায়ের কোলে! তাই একদিন সকালে চেপে বসলাম উড়োজাহাজে। আর মনে মনে বললাম ‘বিদায় অস্ট্রেলিয়া’।
মেঘ আড়াল করে ‘মায়াবী সিডনি’কে পেছনে ফেলে প্লেন চলছে কুয়ালালামপুরের দিকে। সেখানে থেকে ঢাকা। কিন্তু সব ছাপিয়ে মনে ভাসছিল সিডনির আনন্দঘন দিনগুলো।
প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক।
আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।
আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।
প্রিয় পাঠক, আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন-
বাংলাদেশ সময়: ০১৪৯ ঘণ্টা, মে ১০, ২০১৫
এমএ