সাজেক (বাঘাইছড়ি, রাঙামাটি) থেকে ফিরে: সকালের হিম শীতল হাওয়া। কুয়াশায় মোড়ানো পাহাড়ি জনপদ।
শীতের সকাল নয়, গ্রীষ্মেও এমন শিশিরভেজা সকালের দেখা মিলবে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আধার সাজেকের রুইলুই পাড়ায়। সমতল থেকে ১৮‘শ ফুট উপরে। রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি থানায় এর অবস্থান।
ইটপাথরের জঞ্জালে হাঁসফাঁস। যান্ত্রিকতায় প্রাণ ওষ্ঠাগত। মধ্যরাতে সড়কবাতির নিয়ন আলোয় পরিকল্পনা। বৈশাখের এক দুপুরে বেরিয়ে পড়লাম মায়াবী পাহাড়ের টানে। সঙ্গী বাউণ্ডুলে তিনজন। গন্তব্য বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ইউনিয়ন সাজেকের পাহাড়ি অরণ্যে।
৫ মে দুপুরে নগরীর অক্সিজেন থেকে শান্তি পরিবহণে যাত্রা শুরু। নগর পেরিয়ে পাহাড়ের পথে। চোখ যেদিক যায় সবুজ আর সবুজ। বিকেলে চারটায় পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে খাগড়াছড়ির দীঘিনালার বোয়ালখালী বাজারে নামলাম।
ততক্ষণে খিদেয় পেট চোঁ-চোঁ করছে। ঢুকে পড়লাম বোয়ালখালী বাজারের রাখাইন হোটেলে। গরম গরম ভাতের সঙ্গে সুস্বাদু হাসের ঝাল মাংস। পাঁচ তারকা হোটেলেও এমন স্বাদ এবং নির্ভেজাল খাবার জুটবে কি না সন্দেহ। পেট পুরে খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
এখান থেকে সাজেকে যেতে জীপ কিংবা মোটরসাইকেল ভাড়ায় নিতে হয়। মোটরসাইকেলই বেছে নিলাম। দুটি মোটরসাইকেলে চারজন। ১১কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতেই থামতে হলো বাঘাইহাটে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট। এখানে নাম লিপিবদ্ধ করে আবার ৩৪কিলোমিটার দূরে সাজেকের পথে ছুটে আমাদের বহনকারী মোটরসাইকেল।
কিছু পথ এগুতেই দুটি নদীর মোহনা দেখে থামলাম। দুটি নদী দুই দিকে বয়ে গেছে। একটি কাচালং অন্যটি মাচালং। এরপর পাহাড়ি উচু নিচু ২৮ কিলোমিটার পথ পাড়িয়ে দিয়ে মাচালং বাজার। একনাগাড়ে মোটরসাইকেলে বসে থাকতে থাকতে শরীর কেমন নির্জীব হয়ে আসে। এখানে গরম চা খেয়ে শরীর ও মন চাঙ্গা করে নিলাম। সামনে বিপদসংকুল পাহাড়ি পথ।
এরপর আবারও বন্ধুর পথে ছুটে চলা। রাস্তার পাশে ফুটে আছে টকটকে কৃঞ্চচুড়া। দূর পাহাড় থেকে ভেসে আসে নাম না জানা পাখির কুহতান। আঁকাবাঁকা সর্পিল পথ। মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। পথে পথে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের হাত নেড়ে অভ্যর্থনা।
১৭৮০ ফুট উপরে সাজেকের রুইলুইপাড়া পৌঁছাতেই ঝুপ করে নেমে আসে সন্ধ্যা। উঠলাম কালু দাদুর ডেরায়। নাকে মুখে পানি ছিটিয়ে স্থানীয় একটি দোকানে বসে চা পান। এরপর মোটরসাইকেল নিয়ে রুনময়। এটি সেনাবাহিনী পরিচালিত একটি রিসোর্ট। এর নামেই এলাকাটি রুনময় নামে পরিচিত।
রুনময় যেতে যেতে মনে হলো উন্নত বিশ্বের কোন শহরে চলে এসেছি। প্রশস্ত ফুটপাত। সোলারের সড়ক বাতি। পিচঢালা সড়ক। পরিচ্ছন্ন ছিমছাম। রুনময় হেলিপ্যাডের ঘাসে গা এলিয়ে মায়াবী রাতে জ্যোৎস্না স্নান করতে করতে কখন যে মধ্যরাত হয়ে গেছে টেরও পাইনি।
ফিরে এসে জন কেরির হাতের রান্নায় রাতের আহার। জুমের চালের ভাত। সরিষার তেলে পাহাড়ি আলুর ভর্তা। ডিম ভাজি। যেন অমৃত।
খাওয়া শেষ করে কালু দাদুর ঘরেই রাত যাপন। সকালে ঘুম ভাঙতেই খোলা জানালায় দেখি ঘিরে ধরেছে কুয়াশা। তখনো আড়মোড়া ভেঙ্গে জাগেনি রুইলুইপাড়া। এখানে লুসাই ও ত্রিপুরাদের বসবাস। অদূরে একটি ঘর থেকে ভেসে আসছে ইংরেজি গানের সুর। পাহাড়ি অরণ্যে এমন ইংলিশ গান শুনে কিছুটা বিস্মিত। কিন্তু সকালের মিঠে রোদে কুয়াশা দূর হতে বিভিন্ন ঘর থেকে বেরিয়ে আসা তরুণ তরুণীদের দেখে সে ভুল ভাঙ্গলো। সবাই আধুনিক পোশাক পরিহিত। নারীদের কেউ পরেছেন গেঞ্জি, টি শার্ট। কেউ আবার স্কার্ট। নিজেদের মধ্যে ইংলিশ ভাষায় কথা বলছে বেশি।
স্থানীয় ডেবিড লুসাই জানালেন,‘এখানকার অধিকাংশ পরিবারের ছেলেরা ভারতের মিজোরামে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ালেখা করে। ’ ডেভিডদের সাত ভাইয়ের মধ্যেও পাঁচ ভাই থাকে মিজোরামে।
সকালের কুয়াশা কাটতেই আমাদের যাত্রা কংলাকপাড়া। এটি এখানকার সর্বোচ্চ পাহাড়। সম্ভবত রাঙ্গামাটি জেলার সর্বোচ্চ পাহাড়। কারণ এটিকে রাঙ্গামাটির ছাদ বলা হয়। পথে চোখে পড়ে কমলা বাগান। তবে মৌসুম না হওয়ায় সাজেকের মিষ্টি কমলার দেখার সুযোগ হয়নি। পাহাড়ি পথ বেয়ে উঠলাম কংলাকের চুড়ায়। বিশাল পাথর খন্ড। এখানেই ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠি পাংখোয়াদের বসতি। এখান থেকেই দেখা মিলল মিজোরামের লুসাই পর্বত। যতদূর চোখ যায় চারিদিকে পাহাড়ের পর পাহাড়। কোন কোন পাহাড়ের ভাঁজে মেঘের ভেলা। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বসতির দেখাও মিলবে। সবাই সবুজে বিমোহিত। কংলাক পাড়ায় নয়, যেন সিঁড়ি বেয়ে উঠে পড়েছি কোন স্বর্গে। হাত বাড়ালেই যেন ছোঁয়া যাবে নীল আকাশ।
এখানে রবিন ত্রিপুরা খাওয়ালেন পাহাড়ি কাঠাল। সস্তায় কিনে খেলাম গাছের পাকা কলা ও পেঁপে। মিষ্টতা যেন মুখে লেগেই আছে।
এবার ফেরার পালা। ফিরতি পথে হাজাছড়া ঝর্ণা, আলুটিলা গুহা, তারেং টিলা ও নিউজিল্যান্ড মাঠের মুগ্ধতা নিয়ে ফেরা।
কিভাবে যাবেন: চট্টগ্রাম থেকে শান্তি পরিবহনে দীঘিনালা। সেখান থেকে মোটর সাইকেল কিংবা জীপে করে ৪৫ কিলোমিটার দূরে সাজেক। ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি পর্যন্ত শ্যামলী ও এসআলম পরিবহনের বাসও রয়েছে।
থাকবেন কোথায়: সাজেকে সেনাবাহিনী ও বিজিবি পরিচালিত দুইটি রিসোর্ট রয়েছে। এছাড়া বেসরকারি সংস্থা আলো’র একটি রিসোর্ট আছে। কম টাকায় কটেজেও রাতযাপন করা যাবে।
খেয়াল রাখবেন: সাজেকে পানির খুবই সংকট। এখানে পাহাড়িদের দেওয়া পানি নষ্ট করবেন না। তাছাড়া পানির বোতল, পলিথিন, প্লাস্টিক নির্দিষ্ট স্থানে ফেলবেন। যত্রতত্র ফেলে প্রকৃতিকে ধ্বংস করবেন না।
বাংলাদেশ সময়: ১৯২৮ঘণ্টা, মে ১২, ২০১৫
এএএম/টিসি