এবার সব কাজ ফেলে উড়ু উড়ু মনটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে ‘ঘুরে বেড়াই বাংলাদেশ’ দল নিয়ে গিয়েছিলাম মেঘ পাহাড়ের দেশ বান্দরবানে। সেখানে মেঘ ছাপিয়ে মাথা উঁচু করে বসে থাকা গ্রাম পাসিংপাড়া এবং চারপাশে পাহাড় দিয়ে ঘেরা লুকানো এক অসাধারণ সুন্দর গ্রাম লুং থাউসি।
রাতের বাসে রওয়ানা দিয়ে বান্দরবানে পৌঁছাই সকাল ৯টার দিকে। গন্তব্য বগালেক হয়ে পাসিংপাড়া। বান্দরবান থেকে জিপ গাড়িতে সোজা রুমা বাজার।
রুমা থেকে গাইড পানুওম বমকে সঙ্গে নিই। আর্মি ক্যাম্পে নাম ঠিকানা লিপিবদ্ধ করে চান্দের গাড়িতে গিয়ে উঠি। থিম পার্কে না গিয়েও রোলার কোস্টারের মজা পেতে চাইলে আপনাকেও উঠতে হবে বান্দরবানের চান্দের গাড়িতে।
কমলা বাজার পর্যন্ত পথটা কেটে গেল এভাবেই। বগালেকের পথে পর্যটকদের নামিয়ে দেওয়া হয় কমলা বাজারে। এবার শুরু হল বাঁশের লাঠি নিয়ে উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথের পাড়ি দেওয়া।
এভাবে পাহাড় বেয়ে মাঝরাতে পৌঁছাই বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত একটি অদ্ভুত প্রাকৃতিক হ্রদ বগালেকে।
বগালেকে পানির রং লালচে ধরনের দেশের কোনো জলাভূমির সঙ্গেই যার মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এ লেকের উচ্চতা প্রায় তিন হাজার ফুট।
লেকের টলটলে পানি দেখে সাঁতার না জেনেও ঝাঁপিয়ে পড়লেন স্বপন মামা। মামাকে তুলতে গিয়ে পালিয়ে গেল ‘ঘুরে বেড়াই বাংলাদেশ’ দলের রাতের ঘুম। মুগ্ধ নয়নে দেখলাম আকাশ পাহাড় আর জলের মিতালি।
প্রকৃতি এখানে ঢেলে দিয়েছে একরাশ সবুজের ছায়া। যেন তুলির আঁচড়ে বগালেকের পুরো জায়গা সেজেছে ক্যানভাসের রঙে। আর প্রকৃতি তার আপন খেয়ালে এঁকেছে জলছবি।
পরদিন সকালে চিংড়ি ঝরনা পার হয়ে পাহাড়ি পেয়ারার লোভে ঢুকে পড়লাম বান্দরবানের সবচেয়ে সুন্দর গ্রাম দার্জিলিং পাড়ায়। সেখানকার দোকানদার জানালেন, পাশেই নাকি একটা সুন্দর পাড়া রয়েছে নাম লুংথাউসি।
গাইড পানুওম বমও ভরসা দিল, তার এসব চেনা। তার উপর ভরসা করেই কেওক্রাডংকে ফেলে বা দিকে নেমে চললাম পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। সে এক রোমহর্ষক যাত্রা!
কোথায় যাচ্ছি কিছুই জানি না। পাহাড়ে ওঠার চেয়ে নিচে নামা কঠিন কাজ। সে সময় যদি পায়ের নিচে থাকে ঝুর ঝুরে মাটি, তাহলে তো কথাই নেই।
একটানা প্রায় আড়াই হাজার ফুট খাঁড়া পাহাড়ের ওপর থেকে নামতে থাকলাম। পরিস্থিতি এমন যে পা একটু পিছলে গেলে সোজা গিয়ে পড়বো নিচে থাকা সঙ্গী রাসেল ভাইয়ের ঘাড়ে।
এরপর আবার ওপরে ওঠা আমাদের দুঃখ দেখে আকাশও কেঁদে দিলো! টানা আট ঘণ্টা বৃষ্টিতে সৃষ্টি পাহাড়ি ঢল ঠেলে আর শরীরে গোটা ৬০-৭০টি জোঁক নিয়ে শেষ বিকেলে যখন লুংথাউসি পাড়ার সীমানায় পা রাখলাম, তখন আর শরীরে এতটুকু শক্তিও অবশিষ্ট রাখেনি খেয়ালী সবুজ পাহাড়।
রাতে থাকার জন্য দুইটা তাঁবু টানানো হয়েছিল। সেগুলোও ভিজে জবজবে চারপাশে তাকিয়ে দেখি পায়ের নিচে থেকে মেঘেরা কুণ্ডলি পাঁকিয়ে উঠে যাচ্ছে ওপারের দিকে।
যেন এই মাত্র তাদের স্কুল ছুটি হলো। অদ্ভুত সেই দৃশ্য। সূর্যের আলোয় মুহূর্তেই সাদা থেকে সোনালি হয়ে যেন যেমন খুশি তেমন সাজ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে।
এখানে সাদা কুণ্ডলি তো খানিক দূরে পাঁক খাচ্ছে সোনালি মেঘ। চারপাশে যেন রংধনুর রাশি। একটা গুনতে শুরু করলে মুহূর্তেই সেখানে আরেকটা তৈরি হয়ে যায়, তার ওপর সিঁড়ির মতো আরেকটা। যেন তৈরি হচ্ছে স্বর্গে যাওয়ার রঙিন রাস্তা!
বেলা বাড়তে বাড়তেই মেঘগুলো উঠে যায় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। কাজেই সেগুলোকে আবার নাগালে পেতে হলে আমাদের উঠতে হবে আরও উপরে।
সুতরাং আর দেরি না করে রওয়ানা দিলাম অনেক উঁচু গ্রাম বা জনবসতি এলাকা মেঘের রাজ্য পাসিংপাড়ার দিকে। পাহাড়ে যান বাহন বলতে দুটি পা-ই সম্বল।
সেগুলোকে বিরাম না দিয়ে সন্ধ্যার পরে পৌঁছে গেলাম মেঘের রাজ্য পাসিংপাড়ায়। ঘন মেঘে ছেয়ে আছে এই পাড়ার পুরো রাস্তা। অনেক নিচের ব্যস্ত শহর সেখানে গরমে দরদর করে ঘামছে।
সেখানে ‘ঘুরে বেড়াই বাংলাদেশ’ দলের সদস্যরা ঠাণ্ডায় কাঁপছিল থরথর করে। ঘন কালো মেঘের জন্য এখানে ঘর বাড়িতো দূরের কথা, হাতে রাখা চায়ের কাপটা পর্যন্ত দেখা যায় না।
মেঘগুলো পুরোপুরি কুয়াশার মতো। গায়ে লাগলে টের পাওয়া যায় জামা-মাথা ভিজে যাচ্ছে। হাত দিয়ে ধরা যায় না, দলা পাঁকানো যায় না, অথচ সে আছে। রাত ১০টার দিকে ঘন কালো ভারি মেঘে ঢেকে গেল রাস্তার প্রতি ঘাসের মাথা।
শুরু হলো তাণ্ডব লীলা! বজ্রসহ বৃষ্টি। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো সবই হচ্ছে আমাদের পায়ের নিচে! পায়ের নিচে বজ্রপাত, বৃষ্টি, বাতাস সব বুঝতে পারছি কিন্তু একটা ফোটাও পায়ে এসে লাগছে না। লাগবে কীভাবে আমরা এখন মেঘের ওপরে।
কীভাবে যাবেন:
ঢাকার ফকিরাপুল, কমলাপুর, কলাবাগান, ইস্পাহানী বিল্ডিংয়ের পাশ থেকে শ্যামলী, এস আলম, সৌদিয়া, ডলফিন ও সেন্টমার্টিনসহ আরও অনেক পরিবহনের বাসে বান্দরবান যাওয়া যায়।
ভাড়া ৭৩০ টাকা (নন এসি) ৮৫০ (এসি), বান্দরবান থেকে রুমা বাজার পর্যন্ত জিপে জনপ্রতি ১৫০ টাকা। রুমা থেকে বগালেক পর্যন্ত রিজার্ভ চান্দের গাড়িতে ভাড়া প্রায় আড়াই হাজার টাকা। এরপর বাকিটা হাঁটা পথ। পাসিংপাড়া পৌঁছাতে ছয়-সাত ঘণ্টা লাগবে।
প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।
আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।
প্রিয় পাঠক, আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন-
বাংলাদেশ সময়: ১১২৩ ঘণ্টা, মে ১৫, ২০১৫
এমএ