ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

বিভীষিকাময় সুন্দরে-২

২১ কিমি হেঁটে অবশেষে রুমায়!

রিয়াসাদ সানভী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৪০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৬, ২০১৫
২১ কিমি হেঁটে অবশেষে রুমায়! ছবি: শামীমা মিতু

পূর্ব প্রকাশের পর

বান্দরবান থেকে ফিরে: কেউ কেউ অবশ্য ক্ষীণ কণ্ঠে গাড়ি নিয়ে রাস্তার মধ্যে এ ছোটখাট পাহাড়ও অতিক্রমের প্রস্তাব দিলো। অবশ্য সেই চাঁদের গাড়ির কিশোর ড্রাইভারের চোখ মুখ দেখে তাদের থামতে হলো।

এবার কি হবে! বোঝা গেলো গাড়ির আর কোনো ভরসা নেই পদব্রজই ভরসা।

চালক বললো, রুমা বেশি দূরে না। এইতো বড়জোর দেড় কি দুই ঘণ্টার রাস্তা। কিন্তু পথের পাশের মাইল ফলক বলছে রুমা ২১ কিলোমিটার!!! একবার একটু ভাবুন তো, এমন দুর্যোগে বিরান পাহাড়ের মাঝে পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে হবে ২১ কিলোমিটার। দেরি না করে হাঁটা শুরু করলাম। একটু হাঁটতেই দল ভাঙতে লাগলো। এক সময় খেয়াল করলাম আগে পিছে আর কেউ নেই। চলছি তো চলছিই। কখনো ঢালু বেয়ে নামতে হচ্ছে বৃষ্টি ধোয়া পিচ্ছিল পিচের পথে, কখনো উঠতে হচ্ছে বেশ ক্ষানিকটা।

দুই পাশে মৌন ধ্যানীর মতো বিশাল পাহাড়ের সারি একমাত্র সাথী। মাঝে দু’একজন পাহাড়ির সঙ্গে দেখা হচ্ছে। সবার কাছে একই প্রশ্ন দাদা রুমা আর কত দূর। উত্তর যেন সেট করা। ‘দাদা রুমা অনেক দূর’। চিন্তা করে দেখলাম এভাবে হবে না। চোখের সামনে যতটুকু দেখা যায় ততটুকু টার্গেট করে হাঁটার পরিকল্পনা আঁটলাম। বেশ কাজে দিলো ব্যাপারটা। নির্দিষ্ট দূরত্ব অতিক্রম করে আবার সামনের পথ পাড়ি দেওয়ার প্রস্তুতি। এর মধ্যে থামিনি এতটুকু। কখনো বৃষ্টি পড়ছে অবিশ্রান্ত, কখনো একটু কম। দূরের পাহাড় ছাপিয়ে সে ভিজিয়ে দিচ্ছে একলা পথিককে। অনেকক্ষণ লোকালয় চোখে পড়েনি। রোয়াংছড়ির মুরং বাজারে এসে বেশকিছু মানুষের দেখা পেয়ে মনে বাড়তি বল পেলাম। বিরান পাহাড়ে আমি একা না তাহলে। কিন্তু হাঁটা এতটুকু ধীর করা চলবে না। দু’খানা পা জোড়া যেন স্বতন্ত্র এক স্বত্ত্বা। তারা ঠিক করেছে কেবল রুমা পৌঁছার পরই থামবে। বাজার পার হওয়ার অনেকক্ষণ পর একটি বাস আসতে দেখা গেলো। আর বোধহয় এমন বিরক্তিকর হাঁটতে হবে না!

সে আশায় গুড়ে বালি পড়তেও বেশি সময় লাগেনি। বাস আসছে উল্টো দিক থেকে,  সে নিশ্চয় সব যাত্রী নামিয়ে আমাকে নিয়ে রুমার দিকে রওয়ানা হবে না। একটা একটা করে মাইলফলক পেরিয়ে যাচ্ছিলাম, দূরত্ব কমছিলো একটু একটু করে। রুমার এই পথে প্রতি কিমি পরেই ফলক লাগানো।

সেই ২১ কিলোমিটার থেকে যাত্রার শুরু করেছিলাম। একে একে তা কমে ২০, ১৯, ১৮, ১৭, ১৬, ১৫ তে নেমে আসছিলো। সমতলের এক কিলো বনাম পাহাড়ের এক কিলোর মধ্যে অনেক ব্যবধান, হোক তা যতই পিচঢালা পথ। তার উপর আবার সাধের স্যান্ডেল জোড়া খানা হারিয়ে ফেলায় ছোট ভাইয়ের ব্যাগে থাকা ঘরে ব্যবহারের উপযোগী ফিতাবিহীন স্যান্ডেল বেশ ঝামেলায় ফেলছিলো। কখনো খালি পায়েই হাঁটতে হলো।

ক্লান্তি তাড়াতে ইয়ারফোনে একের পর এক বাজছে লিংকিন পার্ক, গানস অ্যান্ড রোজেস, মাইদুল ইসলামের কবিতার আবৃত্তি।

কৈখ্যাঝিরির পর থেকে একটানা অনেকক্ষণ সঙ্গে দিয়েছে পাহাড়ি ঢলে প্রমত্তা শঙ্খ নদী। চলতে চলতে পায়ে আর কোনো সাড় নেই। ক্লান্তিতে নুয়ে পড়ার পর্যায়ও পার হয়ে গেছে। শরীরটাকে টেনে নেওয়ার কসরত শুধু। রুমা সদরের রয়াল পাড়ার উপর থেকে বেশ কিছু দালান কোঠা চোখে পড়বার পরও এবার তাই উত্তেজনাবোধ করলাম না।

সব অনুভূতির সমাপ্তি ঘটেছে, শুধু একটানা চলাই তখন একমাত্র বাস্তবতা। এভাবে রুমাব্রিজ অতিক্রম করে সদরঘাটে এলাম। আশা ছিলো এখান থেকে বোধহয় কোনো গাড়ি পাবো। কিন্তু সদরঘাট একেবারে খাঁ খাঁ করছে। আরও কিছুটা যেয়ে বুঝলাম আসল ঘটনা। সদরঘাট থেকে রুমা বাজার যাওয়ার রাস্তার তিনটি অংশে পানি উঠে গেছে। সেখানে রীতিমতো নৌকা চলছে। প্রতিঘাটে দশ টাকা করে দিতে হলো পারাপারে। হাঁটা শুরুর প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা পর অবশেষে রুমা বাজারে এলাম। এ বাজারের পরিবেশ সব সময়ই মনে পাহাড়ি স্বপ্নের দোলা লাগায়।

কিন্তু এবার সে অবস্থা নেই। একটাই চিন্তা তৌহিদকে খুঁজে বের করতে হবে। এয়ারটেল সিম থাকায় সেটি কাজে লাগবে না। অন্যদের কি অবস্থা তাও জানি না। বাজারের এক দোকানির কাছে জানা গেলো তৌহিদকে মুসলিম পাড়ার দিকে পাওয়া যাবে। সেখানে যেয়ে এক দোকানের মোবাইল ফোনে খবর দেওয়া হলো তাকে। সে আসার আগে দুই বোতল মোজো শেষ করতে তিন থেকে চার চুমুকের বেশি নেয়নি।

তৌহিদের কাছে খবর পেলাম। অন্যরা কৈখ্যাঝিরি থেকে নৌকায় রওয়ানা হয়েছে। মোবাইলে যোগাযোগ হয়েছে তার সঙ্গে। কথা হলো জুয়েল ভাইয়ের সঙ্গে। তিনি ঘাটে থাকতে বললেন। ততক্ষণে পেটে শুরু হয়ে গেছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। প্রায় আধঘণ্টা পর নৌকা ভিড়লো ঘাটে। বাজারের এক দোকানে দুপুরের খাওয়া সেরে সাব্যস্ত হলো রুমাতেই রাত কাটানোর। বিকেল চারটার পর বগা লেকের দিকে আর যাওয়া যায় না।

আবহাওয়াও বেশি সুবিধের না। হোটেল ফিরে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। কিন্তু ঘুম আর আসে না। অতি ক্লান্তির কুফল বোধহয়। পাহাড়ে টুপ করে আঁধার নামে। বৃষ্টির বেগও বাড়ছিলো। চারদিনের পরিকল্পনা নিয়ে এসেছি। এর মধ্যে একটি দিন রুমাতেই শেষ। তৌহিদের সঙ্গে পরিকল্পনা ঝালিয়ে নিতে হলো।

সে অভয় দিলো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই ট্র্যাকিং শেষ হবে। অবশ্য দুশ্চিন্তার ভাঁজ তার মুখেও। ভেতরের পাহাড়ের অবস্থা ভালো না। অনেক জায়গায় নাকি পাহাড় ভেঙে রাস্তা বন্ধ। এর মধ্যে আগামী কয়েকদিনের রান্নার সদাইপাতি সারা হলো। রাতের খাওয়াও সেরে নিলাম। এরপর আগামীকালের সূর্যের প্রতীক্ষায় বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। বৃষ্টির বেগ কিন্তু বেড়েই চলেছে।

চলবে...

বাংলাদেশ সময়: ০০৩২ ঘণ্টা, আগস্ট ২৬, ২০১৫
এএ

** পাহাড়ের আড়ে বিধ্বস্ত বান্দরবানের অবিশ্বাস্য সৌন্দর্যে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।