ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

বিভীষিকাময় সুন্দরে-৭

অভিযান দুর্গম ঝরনা জিংসিয়াম সাইতার

রিয়াসাদ সানভী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৪৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২, ২০১৫
অভিযান দুর্গম ঝরনা জিংসিয়াম সাইতার ছবি: শামীমা মিতু

বান্দরবান থেকে ফিরে: আধাঘণ্টা অনেক কম সময় মনে হলো। কোনো কবি এ যৌবনা ঝরনার সামনে এসে বসলে আস্ত একখানা কবিতার বইতার লিখে ফেলতে পারতেন আমি নিশ্চিত।

তৌহিদের অনেক তাগাদার পর গাইগুঁই করতে করতে উঠলাম। জাদিপাইকে ছেড়ে আবার ফিরলাম বাস্তবতায়। যতটুকু নেমেছিলাম ততটুকুই আবার উঠতে হবে।

হাঁপাতে হলো কিন্তু উঠতে তো হবে! নামার সময় জাদিপাইয়ের উত্তেজনায় রাস্তায় খুব বেশি চোখ পড়েনি। মূলত আমরা যে পাহাড়ের রিজ ধরে নামছিলাম তার নীচের অংশটুকই ধসে গেছে। এখন দেখি উপরের রাস্তার জায়গায় জায়গায় ফাটল। আরেকটু বৃষ্টি হলে এ অংশটুকুও ধসে পড়বে। উঠে এলাম সমতল মতোন জায়গায়। এবার রাস্তা ভিন্ন। সঙ্গে একফোঁটাও পানি নেই। এতক্ষণ উৎরাই নেমেছি এবার চড়াই ভাঙতে হবে।  

একটু পানির অভাবে জীবন ওষ্ঠাগত। সামনে দেখি এক ঝিরি। কিন্তু এর পানি বেশ ঘোলা। পা চালিয়ে আরেকটু এগিয়ে পরিষ্কার পানি পেলাম। প্রাণ ভরে পানি খেয়ে উঠতে লাগলাম সেই পাহাড়ের গায়ে, জাদিপাই পাড়ার পথে। সেখান থেকে আরও উপরে উঠতে হবে মেঘের রাজ্য পাসিং পাড়ায়। ওঠার রাস্তা আরও খাঁড়া। তবে পাহাড়ে ওঠার সময় যত পিচ্ছিলই হোক খাঁড়া রাস্তা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে খুব বেশি সমস্যায় ফেলতে পারেনি। বরং মনে হয় নামাটাই সব সময় কঠিন।

সূর্য মাথার উপর ভালোই তাপ দিচ্ছে। দরদর করে ঘাম দিতে লাগলো। একটু থামি আবার উঠি। এক সময় খেয়াল করলাম আরে জাদিপাই পাড়া উঠে এসেছি সবার আগে। আরও প্রায় পনেরো মিনিট পরে সবাই এলো। এর মধ্যেই পাড়ার বেঞ্চে বসে মেঘ পাহাড়ের খেলা দেখতে দেখতে শরীর চাঙা হয়ে গেছে। আরও পনেরো মিনিট পর পাসিং পাড়ার পথে পা বাড়ালাম। ততক্ষণে মেঘের দল এসে পুরো এলাকা ঘিরে ফেলার প্রস্তুতি নিয়েছে। বেশ ঠাণ্ডা পরশ গায়ে মেখে পাসিং পাড়া উঠে এলাম। যেখানে চা, হালকা নাস্তা সেরে নেওয়ার ফাঁকে ঘড়ির কাঁটা জানালো সাড়ে এগারোটা বাজে।

আমাদের আরও একটা বড় লক্ষ্য ছুঁতে হবে দিনের আলো থাকতে থাকতে। তার আগে যেতে হবে সুংসাং পাড়া। সেটি ছাড়িয়ে রুমনা পাড়ায়। কেওক্রাডংয়ে দাঁড়ালে অনেক নীচে চোখ পড়বে পাশাপাশি বেশ বড় দু’টি পাড়া। এর মধ্যে একটি সুংসাং পাড়া, আরেকটি রুমনা পাড়া। আমরা সেদিকেই যাবো। পাসিং পাড়া থেকে এ এলাকায় যেতে হলো খাঁড়া পাহাড় থেকে নামতে হবে। জানি না কি অবস্থা ট্রেইলের।

পাসিং পাড়া থেকে বেশ প্রশস্ত ট্রেইল ধরে নামতে নামতে ভেবেছিলাম পুরো রাস্তা এমনই হবে। ওমা কিছু হাঁটার পরে দেখি সরু ফিতের মতো এক চিলতে খাঁড়া রাস্তা একেবারে পাতাল ফুঁড়ে নেমেছে। কিছু কিছু জায়গা থেকে নীচে তাকালে কিছুই দেখা যায় না। ঘেমে যাওয়ায় স্যান্ডেলের সঙ্গে পায়ের পাতার মাঝে মাঝে ঠিক সমন্বয় হচ্ছিলো না। ভারী ব্যাগপ্যাক কাঁধে একটু যে ভয় লাগেনি তা নয়। কিন্তু ঠিকই পাহাড়ের গোড়ায় ঝিরির উপরে কাঠের সেই বিখ্যাত সেতুর গোড়ায় গিয়ে ধাতস্ত হলাম।

এখানে ব্যাপক মশা। কিছুদিন ধরে ম্যালেরিয়া নিয়ে বেশ হইচই হচ্ছে। রুমা ছাড়ার দিন আর্মি ক্যাম্প থেকে বললো হাতিপোকার কামড় থেকে নাকি ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ায়। দিব্যি পোকা জাতীয় কিছু যেন কামড়িয়ে গেলো। সে হুশ কি আর আছে এখন। অনেকটা পথ এখনও হাঁটতে হবে। সেখান থেকে সুংসাং পাড়া গিয়ে তৌহিদের পরিচিত এক ঘরে ঠাঁই হলো। রাতটা আজ আমরা এ পাড়াতেই কাটাবো। তবে যাবো রুমনা পাড়ার দিকে। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে আরেক বিস্ময়!

তড়িঘড়ি করে ম্যাগি ইন্সট্যান্ট নুডলস রান্না করা হলো। এটাতে সীসা পাওয়া গেছে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায়। তা নিয়ে ব্যাপক হইচই। এরপরও দেদারসে বিক্রি হচ্ছে বাজারে, আমরাও কিনেছি। কোনো উপায় নেই। ঝটপট নুডলস খেয়ে রওয়ানা দিলাম রুমনা পাড়ার দিকে। তখন প্রায় আড়াইটার মতো বাজে। সূর্য একেবারে মাথার উপর।

আর্মি ক্যাম্পের দিকে যাওয়ার পথে ক্যাম্প কমান্ডারের সঙ্গে আলাপ হলো। তিনি সুংসাং পাড়ার দিকেই আসছিলেন। তার হাসি মুখের অভ্যর্থনা কিছুটা নিশ্চিন্ত করলো। এর আগে একবার বাকত্লাই পাড়া ক্যাম্পের অভিজ্ঞতা ভালো ছিলো না। ক্যাম্পে নাম নিবন্ধন করে চললাম রুমনা পাড়ার দিকে। আগে পাড়া একটাই ছিলো। এখন নতুন পাড়া হয়েছে। সেটি পেরিয়ে পুরনো পাড়ার আঙিনা ছুঁয়ে আমরা চলেছি এক বুনো ঝরনার উঠোনে। নাম তার জিংসিয়াম সাইতার। বলা হয়ে থাকে বান্দরবানে যে কয়েকটা ঝরনা দেখতে সবচেয়ে কষ্ট করতে হয় জিংসিয়াম সাইতার তার মধ্যে অন্যতম।

সাথে করে দড়ি নিয়ে নিয়েছি। একেতো রাস্তা পিচ্ছিল তার উপর এ ঝরনার সেকেন্ড স্টেপ থেকে ফার্স্ট স্টেপে যেতে রাস্তা একেবারে তলোয়ারের ফলার মতো। একটু পা হড়কালেই নিশ্চিত মুক্তি। রুমনা পাড়ার সীমা ছাড়িয়ে বাঁশবনের ভেতর দিয়ে নামতে শুরু করলাম। এখানে ব্যাপক মশার উপস্থিতি। এক দণ্ড দাঁড়ালে আর রক্ষা নেই। প্রায় দৌড়াচ্ছিলাম। দেখি মশার পাল মাথার উপর কুণ্ডলি পাকিয়ে সাথে সাথে চলেছে। হাতে পায়ে ওডোমাস মেখে নিয়েছি। কিন্তু ব্যাটারা আমাদের চেয়েও চালাক। ঘাড়ে, পিঠে টি-শার্টের বর্ম ভেদ করেই কামড়াতে লাগলো।

উপেক্ষা না করে উপায় ছিলো না। একে তো খাঁড়া রাস্তা ধরে নামছি, তার উপর থামলে আরও বেশি কামড় খেতে হবে। এ খাঁড়া পথটুকু এক জুম ঘরে গিয়ে শেষ হয়েছে। এখান থেকে ঝরনার আওয়াজ ভালো মতোই পাওয়া যাচ্ছে।

চলবে...

বাংলাদেশ সময়: ০০৪৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০২, ২০১৫
এএ

** ঝরনা রানী জাদিপাই পেখম মেলে বসে...
** গা-ভর্তি জোঁক নিয়ে আকাশছোঁয়‍া কেওক্রাডংয়ে
** এভারেস্ট জয়ের ক্লান্তি নিয়ে যৌবনবতী বগালেকে
** ভরাযৌবনা শঙ্খ নদী হয়ে বগা লেকের পথে
** ২১ কিমি হেঁটে অবশেষে রুমায়!
** পাহাড়ের আড়ে বিধ্বস্ত বান্দরবানের অবিশ্বাস্য সৌন্দর্যে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।