ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে নেমেই কয়েকজন বাংলাদেশি চোখে পড়লো। ট্রানজিটের কবলে পড়ে এদের কারো দুই ঘণ্টা, কারো পাঁচ, কারো কারো আবার আট-নয় ঘণ্টার অপেক্ষা।
হঠাৎই পেছন থেকে মধ্যবয়স পার করা এক ভদ্রমহিলার ডাকে পিছু ফিরলাম। টিকিটটি আমার হাতে দিয়ে বললেন তিনি পড়তে পারেন না, তাই তার ফ্লাইটটি কখন ছাড়বে আর কোন গেট দিয়ে বোর্ডিং শুরু হবে তিনি বুঝতেই পারছিলেন না।
গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে থাকেন তার ছেলে। ছেলেবউ সন্তানসম্ভবা। মূলত অনাগত প্রজন্মের জন্যই ছুটে চলা এই গ্রাম-বাংলার সাধারণ নারীর।
রাশিয়ার পরমাণু শক্তির পুরোভাগ দেখভালের প্রতিষ্ঠান রোসাটমের আমন্ত্রণে পাঁচদিনের সফরে মস্কোর পথে আমাদের যাত্রাবিরতি ছিলো ৫ ঘণ্টার। সহযাত্রী নিউএজ, ইউএনবি এবং এনটিভির তিন সিনিয়র সাংবাদিক মঞ্জুরুল আহসান, একেএম মইনুদ্দিন এবং মারুফ হাসান রনি।
অনেক কিছুই নিজেকেও বুঝে-শুনে নিতে হচ্ছে। ভদ্রমহিলাকে একা ছাড়া উচিত হবে না ভেবে নিজের সঙ্গীদের ছেড়ে তার ফ্লাইটের বোর্ডিং গেট খুঁজতে লেগে গেলাম।
কিন্তু তার টিকিটে ফ্লাইটের সময় দেখে চোখ কপালে উঠে গেলো। বোর্ডিং টাইমও প্রায় শেষের পথে। আশেপাশের অনেককে জিজ্ঞাসা করলাম, কিন্তু উত্তর পেলাম না, ভাষা বিড়ম্বনার কারণে। অনেকেই ইংরেজি বোঝেন না, আর যারা বোঝেন তারা ব্যর্থ হলেন প্রত্যাশিত উত্তর দিতে।
ছুটলাম ইনফরমেশন ডেস্কে। ভীড়ের মধ্যে টিকিটটা এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, গেট? উত্তরে কিছুই বললেন না, স্বভাবজাত ভঙ্গিতে মাথার উপরের মনিটরে দেখতে ইঙ্গিত করলেন। সেখানে গেট নাম্বারটা দেখে ছুটে চললাম সেই দিকে।
শেষ মূহূর্তের পথ যেনো আর শেষ হয় না। তায় এক বয়স্ক নারী।
হেঁটে আর দৌঁড়ে যখন গেটের কাছে পৌছলাম তখন তিনিই বোর্ডিংয়ের শেষ তিনজনের একজন। এবার মুখে হাসি ফুটলো নারীর।
ফ্লাইট ধরতে পারার আনন্দে নাকি পরিবারের কাছে পৌঁছার আরও একটু নিশ্চয়তায় বুঝা গেলে না।
ছুটলাম নিজের সঙ্গীদের খোঁজে। মনিটরে দেখাচ্ছে আমাদের নির্ধারিত ফ্লাইটের পাশে লিখা "ওয়েটিং ফর গেইট"।
সঙ্গীদের খুঁজে বের করা আর বিমানবন্দরটা একটু ঘুরে দেখা একসঙ্গে সেরে ফেলাই সাব্যস্ত করলাম। এই ঘোরাঘুরি ফাঁকেই টুকটাক কথা হলো অপেক্ষারত আরও যাত্রীদের সঙ্গে। তাদের মধ্যে কয়েকজন ভারতীয় ছিলেন। দেশ থেকে অনেক দূরে প্রতিবেশী দেশের কেউ একজনকে অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই কাছের মনে হয়।
এদিক-সেদিক ঘুরে ঘুরে পা ব্যথা করে খানিক বসলাম। মনিটরে দেখলাম নির্ধারিত ফ্লাইটের নাম্বারের পাশে গেইট নাম্বার পড়েছে ৩০৫। ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকলাম সে পথে।
পৌঁছে দেখি বোর্ডিং তখনো শুরু হয়নি।
কৃষ্ণাঙ্গ কিছু যুবককে চোখে পড়লো। তাদের মধ্যে একজনের পাশে বসে ‘হাই’ বলে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। ভাষা জটিলতায় অনেকের সঙ্গেই কথা বলে উত্তর পাওয়া যাচ্ছিলো না। ইনি উগান্ডা থেকে। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, রাশিয়া যাচ্ছেন এক বছরের কন্ট্রাক্টে কাজ করতে।
কথা বাড়ালাম। কথায় কথায় জানালেন স্বপ্নের কথা। মাত্র দুই বছর চাকরি করবেন। তারপর নিজেই একটা কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দিয়ে নিজের দেশের ছেলেদের সমৃদ্ধির পথ দেখাবেন। এও বললেন, তার দেশে এখন ইন্টারনেট বলতে ছেলেমেয়েরা শুধু ফেসবুককেই জানে। ইন্টারনেট যে এক আজব দুনিয়া, সেটা তিনি তাদের শেখাবেন।
শুনে মনে হলো আমার দেশেরওতো অনেক কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার বিদেশে যান বড় চাকরি নিয়ে। কিন্তু সেতো ব্রেন ড্রেনই। ক’জনই বা দেশে ফিরে শেখাতে চান। ভাবেন নিজের দেশের কথা। উগান্ডার এই নাগরিক তার মেধাকে দেশের কাজেই লাগাতে চান।
মনে পড়লো সেই বয়ষ্ক নারীটির কথাও। ছেলে তার আমেরিকাতেই সেটেলড। তাকেই ছুটতে হচ্ছে নতুন প্রজন্মের সঙ্গী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে।
তবে সে অভিব্যক্তির প্রকাশ না করে বরং তাকে জানালাম আমাদের দেশের ডিজিটাল বাংলাদেশ কনসেপ্টের কথা। কিভাবে আমরা ধীরে ধীরে ডিজিটাল দেশে পরিণত হচ্ছি, সে গল্প বেশ আগ্রহের সাথেই শুনলেন উগান্ডা নিয়ে এই স্বপ্ন দেখা তরুণ।
চোখে পড়লো বোর্ডিংয়ের সময় হয়ে গেছে। লাইনে দাঁড়িয়ে অনেকেই। দেখা পেলাম সহযাত্রী বড় ভাইদেরও।
উগান্ডার তরুণকে তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে শুভ কামনা জানিয়ে মস্কোগামী প্লেনে উঠে বসলাম। ঘণ্টাখানেক উড়েই গন্তব্যে।
পরের স্টোরিতে সে বিষয়ে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা থাকলো।
বাংলাদেশ সময় ০৯০১ ঘণ্টা, অক্টোবর ০২, ২০১৫
একেএ/এমএমকে