বিরিশিরি (দুর্গাপুর) নেত্রকোনা থেকে: বিকেল সাড়ে ৫টা। ভাত খেয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে আমরা বসে আছি বিরিশিরি বাস স্ট্যান্ডের গোপালের ভাতের হোটেলে।
বাজাজ ১০০ সিসি মোটরসাইকেলের ক্ল্যাচ ছিঁড়ে গেছে। কোনরকমে সেটিকে চালু দিয়ে বাজারের দিকে চলে এলো। পেছনে আমরা এলেও এখন আর তাকে খুঁজে পাচ্ছি না। এদিকে তার ভাড়াও পরিশোধ করা হয়নি। আমাদের ময়মনসিংহ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার কথা তার।
নেত্রকোনা শহরের মোহনগঞ্জ বাস স্ট্যান্ড থেকে নামবিহীন বাসে সে এক মজার ভ্রমণ কলমাকান্দা পর্যন্ত। হাতে লেখা টিকিটে যাত্রীদের সিট নাম্বার দিলেও সেগুলো আগেই পূর্ণ করা হয়েছে। বেশ চতুর চালক, যাত্রীরা নেমে যেতে চাইলেই গাড়ি টানতে শুরু করেন। পুরুষ ছাড়াও বাসে ওঠা স্ট্যান্ডিং নারী যাত্রীরা বেশ বিরক্ত। তবে কিছুই বলার নেই। নেত্রকোনাবাসী বুধবার রাতে দুর্গাপুর যাওয়ার পথের যে রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছে, তার সঙ্গে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা মিললো না। সব যাত্রী যেতে পারলে আমরাও পারি।
প্রায় আড়াই ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে কমলাকান্দা। বাস স্টেশনে নেমে ছোট নদীতে নৌকায় চড়লাম। ২ মিনিটেই নদী পার। এরপর ১০ মিনিট হেঁটে কমলাকান্দা-দুর্গাপুর সড়কে। সেখানে মাহেন্দ্রতে সওয়ার। প্রতিজন ৬০ টাকা ভাড়ায় ৩০ মিনিটে পৌছে গেলাম দুর্গাপুর।
স্থানীয়রা বললো, চীনা মাটির পাহাড় দেখতে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সঙ্গে সাধু যোসেফের পল্লী। মোটরসাইকেল ভাড়াকেই বেছে নিতে বললেন, পরামর্শদাতারা।
মোটরসাইকেল চালকদের সিন্ডিকেট ভাঙ্গাটা কিন্তু কঠিন কাজ। ১ হাজার টাকা খরচের প্রস্তাব দেয়া হলো শেষ পর্যন্ত। কঠিন কঠিন সব পাহাড়ে নিয়ে যাওয়া হবে আমাদের মোটরসাইকেলে চাপিয়ে।
নিজেরাই নদী পার হয়ে দক্ষিণে গিয়ে অন্য বাহন ধরার সিদ্ধান্ত নিই। এরই মধ্যে তারা মিয়ার সঙ্গে পরিচয়। ৪শ’ টাকাতেই রাজি হলেন তিনি। চালক সিন্ডিকেটের ধিক্কার অগ্রাহ্য করে আমাদের মোটরসাইকেলে চাপিয়ে নিলেন।
সোমেশ্বরি নদী প্রসস্ত। নদীর পাড়ে, পাথর, কয়লা উত্তোলনকারী আর মাছ ধরা মানুষ। দূরের পাহাড়ের ঢাল বেয়ে যেন নেমে এসেছে স্রোত। নদীর বালুময় পাড়ের ওপর দিয়ে চালক দক্ষতার সঙ্গে নৌকার পাশে নিয়ে গেলেন আমাদের। এ ইঞ্জিন নৌকাগুলো মানুষ, মোটরসাইকেল ও বাইসাইকেল পার করে। মিনিট সাতেকের মধ্যেই ওপারে। স্রোতস্বিনী নদী ছেড়ে পাড়ে উঠতেও বার বার পেছন ফিরে তাকাতে হয়।
পাড়ে উঠে কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকারাস্তা ধরে প্রায় দুই কিলোমিটার। বাম পাশের পথ ধরে চীনামাটির পাহাড়। উঁচুনিচু মাটির রাস্তা পেরিয়ে এক কিলোমিটার ভেতরে প্রবেশ করতেই হাতের ডানে পাথরে ঘেরা সবুজাভ পানি। দেশের আর কোথাও এমন সবুজাভ রঙিন পানি চোখে পড়েনি। হয়তো চীনামাটির সঙ্গে কোন রাসায়নিক মেলবন্ধনে পানির রঙ এমন হয়েছে। সাদা পাথরে ঘেরা রঙিন পানি আপনাকে স্বপ্নের জগতে নিয়ে যাবে। চোখ আটকে যাবে, পাহাড় ঘেরা এমন জলরাশি সিনেমাতেই আমরা দেখেছিলাম।
নেত্রকোনা জেলার উত্তর প্রান্তে গারো পাহাড়ের পাদদেশের এই জনপদের নাম সুসং দুর্গাপুর। আর চীনামাটির এ পাহাড়কেও লাগে দুর্গের মতোন। বিরিশিরির এ ছোট অংশে চীনামাটির পাহাড় থাকলেও পাদদেশে কিন্তু ধানের ক্ষেত। আর কয়েক কিলোমিটারের মধ্যেই মেঘালয়ের সবুজ পাহাড়।
ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড় থেকে সৃষ্ট সোমেশ্বরি নদী মেঘালয়ের বাঘমারা বাজার হয়ে রানিখং পাহাড়ের পাশ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। জনশ্রুতি আছে, সোমেশ্বর পাঠক নামে এক সিদ্ধপুরুষ এ অঞ্চলের দখল নেওয়ার পর থেকে নদীটি সোমেশ্বরী নাম লাভ করে। একেক ঋতুতে এ নদীর সৌন্দর্য একেক রকম। তবে সারা বছরই এর জল টলটলে স্বচ্ছ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ এই জলরাশি।
এখানে মোটরসাইকেল চালকরা বেশ দক্ষ। কয়েকশ’ ফুট ওপরে উঠে যায় ৩ জন নিয়ে। আবার নেমেও যায়। গ্রামের ধুলো মাখা পাহাড়ি পথে বেশ কৌশলে আমাদের চালিয়ে নিয়ে যান তারা মিয়া। এরপর সাধু যোসেফের ধর্মপল্লী। রানিখং গ্রামের এ ক্যাথলিক গির্জাটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১২ সালে। সেখানে রয়েছে ডিসপেন্সারি, কলেজ, যাজকের ভবন ছাড়াও আরো বেশ কিছু জায়্গা।
রানিখং থেকে বিজয়পুর পাহাড়ে যাওয়ার পথে বহেরাতলীতে অবস্থিত রাশমণি স্মৃতিসৌধ। ১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারি সংঘটিত কৃষক ও টংক আন্দোলনের প্রথম শহীদ ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের নেত্রী হাজং মাতা রাশমণির স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে রাশমণি মেমোরিয়াল ট্রাস্ট এখানে নির্মাণ করেছে এ স্মৃতিসৌধ।
আবার ঢাকা ফেরার তাড়া। তাই আর দেরি না করে রওয়ানা দেয়া। আর ফেরার পর সোমেশ্বরী নদী পার হয়ে তারা মিয়ার এ দুর্ঘটনা।
দুর্গাপুর থেকে ময়মনসিংহের রাস্তা ধরলাম। মোটরসাইকেলে আড়াই ঘণ্টা লাগলেও বাসে প্রায় ৪ ঘণ্টা। খানাখন্দে ভরা রাস্তাটিতে যান চলে কিভাবে সেটাও এক বিস্ময়ই বটে!
বাংলাদেশ সময়: ১২১২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১৫
এমএন/জেডএম