কলকাতা থেকে ফিরে: এক সময় টানা রিকশা আর ট্রামই ছিল কলকাতা শহরের প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম। এখন এ দু’টোরই প্রায় যায় যায় অবস্থা।
টানা রিকশার চালকদের মধ্যে অধিকাংশই বয়সের ভারে ন্যুব্জ। সরকার তাদের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু বাপ-দাদার এ পেশাই আঁকড়ে থাকতে চান তারা। তবে, নতুন প্রজন্ম আর আসছে না এ পেশায়। তাই টানা রিকশার দিন ফুরনো এখন সময়ের ব্যাপার।
একইভাবে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে শহরের বুক চিরে এগুচ্ছে কয়েকটি ট্রাম। বাস আর ট্যাক্সির ভিড়ে একাকার হয়ে গেছে ট্রামগুলো। ভুগছে অস্তিত্ব সংকটে। ট্রামের পক্ষে আর বিপক্ষে রয়েছে দু’টি গ্রুপ। পরিবেশবাদীরাসহ অনেকে চান কলকাতায় ট্রাম বহাল থাকুক। আরেক পক্ষ মনে করেন, আধুনিক ও গতিশীল যোগাযোগের সঙ্গে ট্রাম কোনোভাবেই যায় না। তবে, দেড়শ’ বছরের ট্রামের সঙ্গে কলকাতার মানুষের রয়েছে এক আবেগী ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে সম্পর্ক কিছুটা ম্লান হলেও একেবারে মুছে যায়নি।
মনে হলো, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট হিসেবে নো রিফিউসাল ট্যাক্সি এখন অনেক জনপ্রিয়। ৩০ রুপি দিয়ে ট্যাক্সিতে ওঠার কথা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। কিন্তু কলকাতায় শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রে ট্যাক্সিগুলো মিটারে চলাচল করে। আমাদের দেশের পাবলিক ট্রান্সপোর্টগুলোতে কবে যে শৃঙ্খলা আসবে, কবে যে এগুলো মানুষের উপকারে আসবে কে জানে?
মেট্রো নিয়ে আমরা এখনো কথা বলছি। আর কলকাতায় তা এখন বাস্তব। দুই ঘণ্টার পথ কুড়ি মিনিটেই খতম। আর আমাদের কুড়ি মিনিটের পথ দুই ঘণ্টায়ও কুলোয় না। এই মেট্রো নিয়ে কলকাতায় রাজনীতিও কম হয়নি। সে সময় কেন্দ্রে রেলমন্ত্রী ছিলেন গণি খান। অনেক সমালোচনার মুখেও তিনি মেট্রো থেকে পিছ পা হননি। কলকাতার লোকজন এখন গণি খানকে স্মরণ করে।
রাজনৈতিক হিংসা-প্রতিহিংসার প্রায় একই চিত্র আমরা দেখতে পাই কলকাতায়। অসহিষ্ণুতা আছে, আছে প্রতিহিংসা, হাতাহাতি, মারামারি। রাজনীতিতে পেশী শক্তির প্রভাব আছে। আছে টাকার খেলা। কিন্তু তারপরও একটা গণতান্ত্রিক ভাবধারা বহমান। তারই রূপ দেখলাম কিছু কিছু জনসমাবেশে। বাংলাদেশের যারা কলকাতার সংবাদপত্র পড়েন বা ওদের টকশো দেখেন তারাও এটা অনুধাবন করতে পারবেন। তবে, আমাদের টকশোগুলোতে যে অসহিষ্ণুতা এমনকি হাতাহাতি পর্যন্ত দেখেছি, তা আমাদের বিদ্যমান রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থারই প্রতিচিত্র। সেক্ষেত্রে কলকাতায় কিছুটা সহনশীলতা আছে বলেই মনে হয়।
ওখানে বামদের বাড়াবাড়ি আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। একসময় মস্কোতে বৃষ্টি হলে, কলকাতার বামরা ছাতা ধরতো। দিন বদলেছে। এখন আর তেমনটা নেই। বিশ্বায়নের রাজনীতি বিস্তারের ফলে রাজনীতিরও বিশ্বায়ন হচ্ছে। ফলে, নেতিবাচক ও প্রথাগত রাজনীতির শেষ অঙ্কটি বুঝি নতুনদের হাতেই রচিত হবে।
ফরাসী লেখক দোমিনিক লাপিয়েরের লেখা ‘সি সিটি অব জয়’ উপন্যাসে আনন্দনগর কলকাতার যে বর্ণনা দিয়েছেন তা এখনো দৃশ্যমান। এ আনন্দ কোনো আনুষ্ঠানিক আয়োজনে সীমাবদ্ধ নয়। তাদের প্রতিদিনের জীবনাচারের সাথেই মিশে আছে এ আনন্দ ও বিনোদন।
সমাজ মাত্রই পরিবর্তনশীল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয় সমাজ ও মানুষের। বলা হতো, পৃথিবীর সবচেয়ে খিটখিটে মেজাজের পুরুষরা বসবাস করে কলকাতায়। তবে, আজ আর সে অবস্থা নেই। কলকাতা আজ মানবিক মূল্যবোধ আর মর্যাদাবোধের শহর। যা বেড়ে উঠছে নারী আর পুরুষের হাত ধরে।
কলকাতা আজব শহর, দেখে এসো গিয়ে,
কল টিপলে পানি আসে, চোখ টিপলে মেয়ে’
যারা এ পঙক্তিটি বিশ্বাস করেন, তারা এক চরম বিভ্রান্তিতে রয়েছেন। কলকাতা কখনোই এরকম শহর ছিল না। নারীর প্রতি মর্যাদায় পাঞ্জাব আর দিল্লির চেয়ে এগিয়ে রয়েছে কলকাতা। দিল্লির একের পর এক ধর্ষণকাণ্ড দিয়ে কলকাতা বা পুরো ভারতবর্ষকে বিচার করা অবিচারের শামিল। কারণ, এ কলকাতা রানী রাসমনি, কাদম্বিনী গাঙ্গুলি, চন্দ্রমুখি বসু, সরলা দেবী, চারুলতা মুখার্জি ও রমলা সিনহার শহর। অতীতের পথ ধরে আগামীর কলকাতা গড়তে নারীই অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
কলকাতা গিয়ে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলে যাবো না তা কি হয়! তাই বরাবরের মতো এবারও গন্তব্য ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল। ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসকে এক নজর দেখতে চাইলে যেতে হবে ভিক্টোরিয়ায়।
১৯০১ সালে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুর পর সে সময়ের ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জন রাণীর স্মৃতির উদ্দেশে নির্মাণ করেন এ মেমোরিয়াল হল। ১৯২১ সালে উদ্বোধন করা হয় এ মেমোরিয়াল হলের। ব্রিটিশ ও মোগল স্থাপত্যরীতির এক অপূর্ব সংমিশ্রণ এ জাদুঘর। রাণী ভিক্টোরিয়ার স্মৃতি বিজড়িত বেশ কিছু সামগ্রী ছাড়াও এখানে আছে ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাস বিজড়িত বেশকিছু পেইন্টিং। যা থেকে ভারত বর্ষে ব্রিটিশ শাসনের একটি খণ্ডচিত্র পাওয়া যায়। লর্ড হেস্টিংস, কর্নওয়ালিস, ক্লাইভ, ওয়েলেসলি এবং ডালহৌসির মূর্তি রয়েছে এ জাদুঘরে।
এখানকার প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে আছে ব্রিটিশ শাসনের ইতিবৃত্ত। ইতিহাসের পরতে পরতে ঘুরতে ঘুরতে শেষ প্রান্তে চোখ আটকে গেলো দু’টি কামানের ওপর। ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ। পলাশীর যুদ্ধে ব্যবহার হয়েছিল এ ফরাসি কামান দু’টি। দু’টিই সিরাজের পরাজয়ের পর ব্রিটিশের হ্স্তগত হয়। আজ সিরাজ নেই, নেই ক্লাইভ-মীরজাফর এমনকি মুহম্মদি বেগ। কী ঘটেছিল সেদিন পলাশীতে? কামান দু’টির সামনে দাঁড়িয়ে থেকে অথবা নীরবে কান পেতে জানতে চেয়েছি সেদিনের কুশিলবদের ভূমিকা। ২৩ জুনের বৃষ্টিভেজা কামান সেই থেকেই নিরুত্তর। হয়তো সিরাজের পরাজয়ের গ্লানি (নাকি মীরজাফরের বিশ্বাস ঘাতকতার সাক্ষী হয়ে?) মাথায় নিয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে কামানগুলো।
শুধু কামানই নয়, মীরজাফর-জগৎশেঠ বাহিনীর বিশ্বাসঘাতকতার আরো নমুনা আছে এ জাদুঘরে। ওয়ারেন হেস্টিংসকে তুষ্ট করতে মীর জাফরের স্ত্রী মুন্নী বেগম হাতির দাঁতের একটি চেয়ার উপহার দিয়েছিলেন। চেয়ারটি সংরক্ষিত আছে এ হলে। ইতিহাস সাক্ষী, মীরজাফর চক্র ক্লাইভ-হেস্টিংসকে গদি উপহার দিয়েও নিজেরা গদিতে বসতে পারেনি। বাংলার শাসন ক্লাইভদের হাতে গেছে, তবু মীরজাফরদের হাতে নয়। ইতিহাস বড় কঠিন, বড় নির্মম।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০১৫
জেডএম
** সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড, কলকাতা ইন অক্টোবর