দিল্লি থেকে ফিরে: জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবরের হাতে যে মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ’র মাধ্যমে তার সমাপ্তি। মাঝে তিনশ’ বছরেরও বেশি সময়।
তৈমুর লংয়ের সরাসরি বংশধর ছিলেন সম্রাট বাবর। বাবর এও বিশ্বাস করতেন যে তিনি মায়ের দিক থেকে চেঙ্গিস খানেরও বংশধর। তাই বীরত্ব ও সাম্রাজ্য বিস্তার মুঘলদের রক্তে মিশে আছে।
কিন্তু মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসতো কেবল সাম্রাজ্য বিস্তারের ইতিহাস নয়। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন, সঙ্গীত, ভাষা, স্থাপত্য এমনকি জ্যোতির্বিদ্যা-জ্ঞানের প্রায় সব মহিরুহই শাখা বিস্তার করেছিল এ সময়ে।
সিন্ধু নদের তীরে যে সভ্যতার সূচনা কালান্তরে তা-ই আজকের ভারতীয় সভ্যতা। ঐতিহাসিকরা মনে করেন ভারতীয় সভ্যতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর ধারাবাহিকতা। পৃথিবীর কোনো সভ্যতার প্রভাবই আধুনিক কালে এসে গড়ায়নি। ভারতীয় সভ্যতা এক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।
মুঘল শব্দটি এসেছে মঙ্গল থেকে। মঙ্গলরা বীরের জাতি। ইতিহাসে এদের যুদ্ধ বিগ্রহ ও রক্তপাতের জন্য খ্যাতি আছে। বাবর সেই রক্তস্রোত অনুসরণ করেই ভারত বর্ষের শাসনভার গ্রহণ করেন। কিন্তু মুঘলদের তিনশ’ বছরের শাসন তরবারির শাসন নয়। তরবারির শাসন তিন বছর চলে, তিনশ’ বছর নয়।
মঙ্গলদের রক্তস্রোত সিন্ধুর শান্ত জলস্রোতের সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে। সে জলস্রোত যখন যমুনার নীল জলপ্রবাহকে আলিঙ্গন করেছে তখন তা প্রেমের এক অবিরাম ফল্গুধারায় প্রবাহিত হয়েছে। তাই বুঝি ওর নাম হয়েছে ‘প্রেম যমুনা’। হবে না-ই বা কেন? এই যমুনার তীর ঘেঁষেই যে রয়েছে দুনিয়ায় প্রেমের সবচেয়ে মহান কীর্তি-তাজমহল।
মুঘলরা বড় ভালোবেসেছিলো যমুনাকে। তাইতো জীবনে তারা প্রাসাদ গড়েছেন এই যমুনার পাড়েই-হোক তা দিল্লি বা আগ্রা। মৃত্যুর পরও বেছে নিয়েছেন এই যমুনাকেই- হোক তা তাজমহল বা হুমায়ুন কা মাকবারা বা হুমায়ুনের সমাধি।
মুঘল সাম্রাজ্যের সূর্য যখন মধ্যগগণে তখন সম্রাট শাহজাহান তার মৃত স্ত্রীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মাণ করেন ভালোবাসার এক অমর নিদর্শন-তাজমহল। এ ইতিহাসতো সবারই জানা।
কিন্তু মুঘল সাম্রাজ্যে ভালোবাসার এরকম নজির তাজমহলই প্রথম নয়। হয়তো তা তাজমহলের মতো এতো জৌলুসপূর্ণও নয়। হয়তো তাজমহলের শৈলী, ঐশ্বর্য, বিলাসিতা আর বৈচিত্র্যের কাছে তা ম্লান। কিন্তু ভালোবাসার মাপে তাজমহলের মতোই তা সমুজ্জ্বল।
কিন্তু ইতিহাস বুঝি এমনই হয়। সব সময় তা মুকুটধারীকেই স্মরণ করে-হোক তা ক্ষমতার বা প্রেমের। তাইতো প্রেমের আকাশে তাজমহলই উজ্জ্বলতম নক্ষত্র, হুমায়ুনের সমাধি নয়।
তবে কি শাহজাহানের (তাজমহলের) ঐশ্বর্য, বিলাসিতা, বৈচিত্র্য আর আলোকচ্ছটার কাছে হেরে গেলেন তারই তিন পুরুষ আগের সম্রাট হুমায়ূনের স্ত্রী?
তাজমহল সৃষ্টিরও শতবর্ষ আগে (১৫৬২ সালে) এক মহান মুঘলপত্মী হামিদা বানু বেগম তার প্রয়াত স্বামীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মাণ করেন হুমায়ুন কা মাকবারা বা হুমায়ুনের সমাধি।
মুঘলরা উদ্যান-সমাধিক্ষেত্র পছন্দ করতো। তারই নমুনা দেখা যায় হুমায়ুন সমাধিতে। এমনকি বাবরের কবরেও (আফগানিস্তানে) এরকম উদ্যান-সমাধিতেই অবস্থিত।
তবে, সব মুঘল সম্রাটদের এরকম উদ্যান-সমাধি জোটেনি, বিশেষ করে শেষ মুঘলরা অতি সাধারণ সমাধিতেই শায়িত।
দিল্লির প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এ উদ্যান-সমাধিক্ষেত্রের স্থপতি ছিলেন মিরাক মির্জা গিয়াথ। এ জায়গাটি হয়তো হুমায়ুনের পছন্দ ছিল। তাই তিনি তার জীবদ্দশাতেই এর কাছাকাছি দিনা-পানাহ বা পুরানা কিল্লা নির্মাণ করেছিলেন (১৫৩৩ সালে)। হামিদা বানু বেগম হয়তো দিল্লিশ্বরের অন্তিম ইচ্ছার কথা জানতেন। তাই মৃত্যুর পর তাকে এখানেই সমাহিত করা হয়।
হুমায়ুনকে এখানে সমাহিত করার আরো কারণ থাকতে পারে। এই বিশাল এলাকার অংশবিশেষে হুমাযুনের কবর হওয়ারও কমপক্ষে কুড়ি বছর আগে থেকেই কবর স্থান ছিল। বেশকিছু কবর এখনো আছে।
যমুনার তীর ঘেঁষেই এ সমাধিক্ষেত্রের বিস্তার। এ কবরের স্তম্ভের ওপর দাঁড়ালে একসময় দিল্লি শহর এক নজরে দেখা যেতো। সমাধিক্ষেত্রে সংগৃহীত কিছু ছবি থেকে তার প্রমাণও পাওয়া যায়।
মুঘল সম্রাটদের অনেকেই সুফিসাধকদের ভক্ত ছিলেন। কোনো কোনো সম্রাটের চরিত্রে কিছু ত্রুটি থাকলেও হুমায়ুন সম্পর্কে সেরকম বিশেষ কিছু জানা যায় না। তিনি শুধু আফিম খেতেন বলে কোনো কোনো বর্ণনায় আছে। তবে, হুমায়ুন যে খাজা নিজামুদ্দিনের ভক্ত ছিলেন তা অনেকেই বর্ণনা করেছেন।
প্রথম দিকের মুঘল সম্রাটরা খাজা নিজামুদ্দিনের ভক্ত ছিলেন এক ঐতিহাসিক কারণে। অনেকে মনে করেন, নিজাম ভক্ত হুমায়ুনকে তার সুপ্ত ইচ্ছার কারণেই নিজামুদ্দিনের কবরের পাশেই সমাহিত করা হয়।
নিজামুদ্দিনের কবরের পাশে শুধু হুমায়ুন না, শাহজাহান কন্যা জাহানারার কবরও আছে।
এতো বিশাল জায়গা নিয়ে অন্য কোনো মুঘল সম্রাটের সমাধি নেই। চারটি গেট পার হয়ে মূল সমাধি সংলগ্ন জায়গায় যেতে হয়। চারপাশটা কয়েক স্তরের সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। একই মুঘল স্থাপত্যরীতির অনুসরণ দেখতে পাই অপরাপর সম্রাটদের সমাধি-উদ্যানগুলোতেও।
এ সমাধির চারপাশে রয়েছে একই রকম চারটি ফটক। বর্তমানে শুধু একটি খোলা। বাকি ফটক বা গেটগুলো বন্ধই থাকে।
লাল ও সাদা বেলেপাথর দিয়েই তৈরি এ সমাধিক্ষেত্র। সর্বশেষ গেটটি পার হওয়ার পরও অনেকটা পথ হেটে তবেই পৌঁছা যাবে মূল সমাধি ভবনে। মূল ভবনের চারপাশে রয়েছে অনেকের কবর। এর ওপরের ছাদে রয়েছে তিন-চারটি কবর।
চারপাশের ছাদের ঠিক মধ্যদিয়ে বেড়ে উঠেছে আরেকটি বর্ধিত ভবন বা মিনার। এর ঠিক মাঝখানেই হুমায়ুনের সমাধি। হুমায়ুনের কবরের চারপাশে রয়েছে আরো কয়েকটি কবর। যা তার স্ত্রী ও অন্যান্য মুঘল পরিবারের সদস্যদের। মূল গম্বুজটিও দু’তলা বিশিষ্ট। কবরের চারপাশে আটটি গেট আছে। চারপাশ থেই এখানে আলো ও বাতাসের আনাগোনা। একই স্থাপত্যরীতি ও প্রযুক্তি তাজমহলেও লক্ষ্য করা যায়। সমাধির বাইরে কোনো বাতাস নেই। অথচ ভবনের ঠিক ভেতরেই হুহু বাতাস।
এখানে আছে হুমায়ুনের পত্নী হামিদা বেগমের কবরও।
ঠিক যেভাবে মমতাজ মহালের পাশেই সমাহিত শাহজাহান। হুমায়ুনের পাশে সেভাবেই হামিদা বানু। শাহজাহানের পুত্র দারাশিকো, আছে জাহান্দার শাহ, ফারুক শিয়ার, ও দ্বিতীয় আলমগীরের সমাধিও আছে এখানে। শাহজাহান যে হুমায়ুনের ভক্ত ছিলেন তারই নজির তার এক কন্যা ও এক পুত্রের কবর এখানে।
যে কেউ তাজমহল ও হুমায়ুনের সমাধিক্ষেত্র ভ্রমণ করলে সহজেই বুঝতে পারবেন শাহজাহান তাজমহলের অনুপ্রেরণাটি কোত্থেকে পেয়েছেন। হ্যাঁ, শাহজাহান তার দাদার (আকবর) মায়ের কাছেই পেয়েছেন এ অনুপ্রেরণা।
হুমায়ুনের কবর মুঘল সাম্রাজ্যের আরো অনেক রাজকীয় স্থাত্রের পূর্বসূরি।
তাজমহল গড়েছিলেন শাহজাহান। মুঘল সাম্রাজ্যের সূর্য যখন মধ্য গগনে, আকবরের মাধ্যমে বিস্তৃত সাম্রাজ্য যখন আরো প্রসারিত, ভোগ-বিলাস-জৌলুস ও প্রাচুর্যের শীর্ষে যখন অবস্থান, দিল্লির রাজকোষ যখন পূর্ণ, তখনই শাহজাহান তাজমহলে হাত দেন। দিল্লির রাজকোষ প্রায় খালি করে তিনি তাজমহল নির্মাণ করন। তাজমহল নির্মাণ করতে গিয়ে শাহজাহান ভাবেন নি তার উত্তর পুরুষদের কথা, ভাবেননি কী হবে মুঘল সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত।
কিন্তু হামিদা বানু বেগমকে সদ্য প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত চিন্তা করতে হয়েছে। আর দিল্লির রাজকোষও তখন পূর্ণ হয়নি। তাই তাজমহলের জৌলুস আর বিলাসিতায় তিনি হুমায়ুনের সমাধি গড়তে পারেননি। পারেননি বলেই হয়তো এ সাম্রাজ্য টিকে ছিল পরবর্তী তিনশ’ বছর। শাহজাহান গড়ে তুলতে পেরেছিল তাজমহল।
তাই শ্বেত-শুভ্র তাজমহল নির্মিত হয়েছ আলো ছড়িয়েছে শাহজাহান-মমতাজের ভালোবাস। কিন্তু মুঘল সাম্রাজ্যের সূর্য অস্ত যেতে বেশি সময় লাগেনি।
তাজমহল নিঃসন্দেহে অমর প্রেমের সাক্ষী। কিন্তু যমুনায় প্রেমের যে স্রোতপ্রবাহটি বইছে-পাশে যার তাজমহল, কান পেতে শুনুন ফল্গুধারাটি বইছে দিল্লিতে হুমায়ুনের সমাধিক্ষেত্র থেকেই। তাজমহলের যে আলোকচ্ছটায় আচ্ছন্ন পুরো ভারত বর্ষ, তার দ্যুতিটি আসছে হুমায়ুনের সমাধি থেকেই।
বাংলাদেশ সময়: ১২৫৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১৫
এএ
** পলাশী থেকে ভিক্টোরিয়া
** সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড, কলকাতা ইন অক্টোবর