বান্দরবান থেকে ফিরে: আবার রেমাক্রি ধরে বাজারের দিকে এগোনো। টানা চারদিন ধরে হাঁটছি।
একসময় নিজেকে আবিষ্কার করলাম রেমাক্রি মুখের সামনে। এবার একটু রেমাক্রি নিয়ে বলি। নির্দ্বিধায় বলতে পারি আমার দেখা বাংলাদেশের সুন্দরতম খালটির নাম রেমাক্রি। এর শুরু সেই রুমার সুংসাং পাড়ার কাছে ডবল ফলস থেকে। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে যত জলরাশি মিশেছে এ খালের জলে, তত রূপ বদল করছে রেমাক্রি।
বাংলাদেশের সুন্দরতম দুই ঝরনাধারা আমিয়াখুম আর নাফাখুম হয়ে যে স্থানটিতে সুন্দরীতমা রেমাক্রি মিশেছে সুন্দর নদী শঙ্খের সঙ্গে- সেটিই রেমাক্রি মুখ। এটিও আরেক অসাধারণ জায়গা। ধাপে ধাপে পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসা জলের ক্যানভাসে এখানে সৃষ্টি হয়েছে জলপ্রপাতের। রেমাক্রি মুখও এ রুটের অবশ্য গন্তব্য একটি জায়গা।
এখান থেকে বাজারে যেতে হলে আমাদের নৌকার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। প্রচণ্ড রোদে আমরা রেমাক্রি মুখে খানিক অপেক্ষার পর এক ইঞ্জিন বোটে করে বাজারে এসে পৌঁছালাম তখন প্রায় আড়াইটার মতো বাজে। ঘাটে নেমেই আগে পেট পুরে খেলাম ভাত, মুরগির মাংস আর ডাল। এতো তৃপ্তি করে বোধহয় বহুদিন খাইনি।
আগামীকাল থানচি ফেরার বোটও এখান থেকে ঠিক করলাম। এরপর সোজা লাল পিয়ান দা’র কটেজে। রেমাক্রিতে বেড়াতে আসা সবাই জানেন লাল পিয়ান বমকে। ঢালা বিছানা, জনপ্রতি দেড়শো থাকা। খাওয়াও এখানে বেশ সস্তা। আমরা বাদে আর কেউ নেই। আসলে বেশ কয়েকদিন ধরেই কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পর্যটকদের এ এলাকায় আসতে দেওয়া হয়নি।
কটেজে ব্যাগপ্যাক রেখে এক ছুটে চলে এলাম ঘাটে। পুরো চার দিনের যত ময়লা জমেছিলো শরীরে শঙ্খের পূণ্য জলে সব ধুয়ে শুদ্ধ করে নিলাম। জীবনের এ এক আশ্চর্য আনন্দ। শঙ্খের কোলে শরীর গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে সান বাথের সময় মনে হলো আমার আর কোথাও না গেলেও হবে। সখ্য হলো দুই পাহাড়ি শিশুর সঙ্গেও। তারা গাছের লাল পেয়ারা খাওয়ালো।
কটেজে ফিরে বারান্দা বসে খোশগল্প করার ফাঁকে দেখতে পেলাম নৌকা ভরে সব পর্যটকরা আসছে রেমাক্রি বাজারে। এতদিন বন্ধ থাকার পর রুট খুলে দিতেই এ অবস্থা। দেখতে দেখতে পুরো বাজার ভরে গেলো পর্যটকে। তৌহিদকে বললাম সুখের দিন শেষ। যাকগে সন্ধ্যা হলো। জমজমাট রেমাক্রিতে চরম আড্ডাবাজির সাথে হলো সুপার মুন দর্শন। চাঁদের আলো কুয়াশার জলে মিশতে মিশতে শুনিয়ে গেলো হারিয়ে যাওয়ার ইন্দ্র ধ্বনি। যুদ্ধ শেষে ক্লান্ত আমাদেরও ঘুমের দেশে হারিয়ে যাবার সময় হলো।
খুব সকালে ঘুম ভেঙে দেখি চারদিক কুয়াশায় ঢেকে আছে। এই শরৎ সকালে হালকা শীতের আঁচড় শরীরে। আমাদের রেমাক্রি ছাড়ার ক্ষণ। আগের দিন ঠিক করে রাখা বোটে রওয়ানা দিলাম শহরের পথে। কিন্তু বুঝতে পারিনি কিছু চ্যালেঞ্জ তখনও বাকি। রেমাক্রি থেকে থানচির দিকে নৌকা যত এগোতে লাগলো বিভিন্ন বাঁকে কঠিন সব জল ঝঞ্ছাটের সামনে পড়তে লাগলাম।
উজান থেকে প্রচণ্ড বেগে ধেয়ে চলা স্রোতে ভেসে যাচ্ছি আমরা নীচের ভাটির দিকে। ফলে বাক যেখানে অত্যন্ত সংকীর্ণ সেখানে বোটে ঠিকমতো বসে থাকাটাই একটি চ্যালেঞ্জ। রাজা পাথর এলাকা পার হওয়ার সময় রীতিমতো ভয় করতে লাগলো। বিশাল সব পাথরের ফাঁক গলে নৌকার বেরিয়ে যাওয়ার ক্ষণে দেখে নিলাম রাজা আর তার সৈন্য সামন্তদের।
রাজা পাথরকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এক মিথ। সেই কোন যুগে এখানে রাজত্ব করতো তিন্দু রাজা আর দোতং রাজা। একবার তাদের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ হলো। পরাজিত হলো তিন্দু রাজা। তিনি ঠিক করলেন রাজ্য ছেড়ে পালাবেন না। কিন্তু কীভাবে নিজ রাজ্যে থাকবেন? বুদ্ধি এলো মাথায়। পরিবার পরিজন, মন্ত্রী, উজির, সৈন্য সামন্ত নিয়ে শঙ্খের জলে দিলেন ঝাঁপ। শোনা যায় সেই থেকে পাথুরে ফসিল হয়ে নিজ রাজ্যেই বহাল তবিয়তে আছেন তিন্দু রাজ।
পদ্মমুখ ঝিরি ছুঁয়ে বোট যখন তিন্দু বাজারের কাছাকাছি এলো সোনালি রোদে আকাশ ছোঁয়া পাহাড়ের পটভূমিতে তার রূপ দেখে আমার মূর্ছা যাবার যোগাড়! সাদা মেঘের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যাচ্ছিলো বিশাল চিম্বুক রেঞ্জের দাম্ভিক উপস্থিতি। প্রশ্ন করলাম নিজেকে, সেই দম্ভকে চূর্ণ করতেই কি পাহাড়ের কাছে আসি? আবার নিজেই উত্তর দিলাম, আসলে ভালোবাসার টানেই ছুটে আসা, আসবো আজীবন। আজ হয়তো চলে যেতে হচ্ছে। কিন্তু ফিরছি খুব শিগগিরই। ভালো থেকো ত্লাংময়।
বাংলাদেশ সময়: ০১০৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১৫
এএ
** নাফাখুমের অমিয় সুধায়