প্রচুর পর্বত ও হাল্কা বনানীতে পূর্ণ আফ্রিকার ছোট্ট রাজ্য লিসোটো- তে কিছুদিন হলো আমি বাস করছি। লিসোটোর রাজধানী হচ্ছে মাসেরু।
মি. নাকানের ব্যাপারে আমার আগ্রহ কম। আজ আমি মূলত মিসেস বনেলোর সাথে দেখা করতে তার পার্মিশন নিতে এসেছি। কয়েক বছর আগে মিসেস বনেলোকে যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন বিভাগ কাগজপত্রে জালিয়াতীর অভিযোগে দেশত্যাগে বাধ্য করে। তিনি ফিরে আসেন তার পৈতিক নিবাস লিসোটোর মাসেরু শহরে। আমি লিসোটোতে মূলত ফিরে এসেছি আমার জানাশোনা মানুষজন, মি. মোজাফেলা, কিংবা মিসেস বনেলো সবই- কে কেমন আছেন তা সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে। আমার আগ্রহ সময়ের চলমান প্রবাহে তারা কে কতোটা বদলে গেছেন তার একটি পরিষ্কার খতিয়ান পেতে।
রাখাল ছেলে ও টাট্টুঘোড়া
আমার সাথে প্রাইভেট ডিটেকটিভ মি. মোজাফেলাও এসেছেন। আমি মি. নাকানের সাথে যোগাযোগ করতে চাচ্ছি জানতে পেরে মি. মোজাফেলা তার গেল বারো চৌদ্ধ বছরে ব্যবসার বিস্তার সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করে লাল ফিতা দিয়ে পেচিয়ে একটি ফাইল তৈরী করেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আমহার্স্ট শহরে মিসেস বনেলোর জীবনযাপন সম্পর্কে জানতে ব্যাপকভাবে আগ্রহী। আমি তাঁকে কথা দিয়েছি যে তথ্যগুলো গুছিয়ে লিখে তাঁর হাতে দেবো মি. নাকানের সাথে দেখাসাক্ষাৎ হওয়ার আগেই। তাহলে তিনি বিশ্লেষন করতে পারবেন আদতে কোন পরিস্থিতিতে মিসেস বনেলোর জীবনে কী ঘটেছে?
মি. নাকানের সাথে আমাদের দেখা করার ডাক আসছে না, তার অপেক্ষায় আমাদের আগে এসে আরো কয়েকজন মানুষ অনেকটা ডাক্তারের চেম্বারে অপেক্ষা করার মতো হলরুমে বসে আছেন। হাতে সময় আছে, তাই এ সুযোগে আমি মিসেস বনেলো সম্পর্কে স্মৃতিভিত্তিক যে রিপোর্ট তৈরী করেছি তা খতিয়ে দেখি। অনেক বছর আগে যখন মিসেস বনেলো আমহার্স্ট শহরে প্রশিক্ষণে আসেন তখন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর সন্ধেবেলা ডান্সের আয়োজন হলে তিনি শুধু নৃত্যকলাই নয়, সঙ্গী ডান্সপার্টনার পুরুষটিকে সুযোগ মতো একাধিকবার চুমো খেয়ে ঈষৎ আলোচিত হয়েছিলেন। সে যুগে তার শরীরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অঙ্গ ছিলো দীর্ঘ পা জোড়া। তিনি সাপের মোটিফ আঁকা টাইটস্ পরে আসরে নেমেছিলেন। নৃত্যকলায় তার ঊরু যুগলের কাজ এতোই অসাধারণ ছিলো যে-ডিসকো বাতির বর্ণাঢ্য আলোয় মনে হচ্ছিলো যুগল শঙ্খচুড় যেন মেতেছে মিথুন মুদ্রায়। ডানসিং ঈভেন্টের পর আমরা রাত কাটাই একটি ডরমিটরিতে। রাত বারোটার দিকে কামরায় ফেরার সময় দেখি মিসেস বনেলো লাটভিয়া থেকে আগত আরেক সুপুরুষের বাহুলগ্না হয়ে টেবিলল্যাম্প নিভিয়ে বসেছেন লবির কাউচে। আমার সাথে চোখাচুখি হতেই তিনি ভোদকার বোতল হাতে নিয়ে গোলাপপাশ থেকে সুরভিত জল ঝরানোর মতো ছিটিয়ে দিয়েছিলেন কড়া ধাচের কিছু সুরা।
গাছে ঝুলছে পাখির বাসা
বাকুকুকু নামে রেস্তোরাঁটি খুলেন তিনি বছর দুয়েক পরে। ওয়ার্ক পারমিট পেয়ে তিনি প্রথম কাজে নামেন একটি নাইট ক্লাবের টপলেস বারে। তার দৈহিক সৌন্দর্য্যের মুগ্ধ দর্শক আমিও ছিলাম, তবে দূর থেকে তাকে চাক্ষুষ করেছি, খুব কাছে ভিড়িনি কখনো। আমার পরিচিত এক সুহৃদ একদিন নাইটক্লাব থেকে ফিরে এসে বলেছিলো, পরিচিতা বলে নগ্নবক্ষা মিসেস বনেলোর দিকে তাকাতে তার লজ্জা হচ্ছিলো। তিনি পানপাত্রে জামাইকান রামের সাথে ডাবের জল মিশিয়ে তাকে পরিবেশন করতে আসলে সে অন্যদিকে মুখ ফেরায়, তখন নাকি মিসেস বনেলো তার গালে মৃদু ঠোনা মেরে বলেছিলেন,‘ হানি, ইউ ক্যান লুক অ্যাট মি, আফ্রিকান মেয়েদের বুকের গড়ন এ রকমই হয়। ’ বাকুকুকুতে জমজমাট ব্যবসা তার চলেছিলো অনেক বছর। তারপর একদিন পুলিশ নাইটক্লাবে মুখোশ নৃত্যের আসরে হানা দেয়। কয়েকটি মুখোশ কেটে গোয়েন্দারা ভেতর থেকে বের করে আনে ড্রাগসের চালান। মিসেস বনেলো গ্রেফতার হন। কিন্তু এ মুখোশটি যে তার দোকান থেকে বিক্রি হয়েছে পুলিশ তা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়। উকিলের শক্ত সওয়াল জবাবের পর মিসেস বনেলো বেকসুর খালাস পেয়ে আবার বাকুকুকুর ক্যাশ কাউন্টারের বসেন। কিন্তু এক সপ্তাহের ভেতর ইমিগ্রেসন বিভাগ পুরানো নথিপত্র ঘাঁটিয়ে আবিষ্কার করে -গ্রীনকার্ড পাওয়ার জন্য তিনি যে সব কাগজপত্র জমা দিয়েছিলেন তার অনেকগুলোই ছিলো জালিয়াতি। তো মিসেস বনেলোকে প্লেনে তুলে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করা হয়।
মি. মোজাফেলাকে দেয়ার জন্য আমি মিসেস বনেলো’র আমহার্স্টের দিনযাপন নিয়ে যে নোট করেছি তা দেখছিলাম। একজন কর্মচারী এসে আমাদের ডেকে নিয়ে অন্য একটি কামরায় বসায়। সাথে সাথে পরিবেশিত হয় লেবানিজ কফি ও সুমিষ্ট বাকলবা। এ হলরুমটি আকারে আরো বড়। আমরা যেখানে বসেছি তার চার দিকে জড়ো করে রাখা খুব পুরানো ডিজাইনের সোফা, কাউচ, মার্বেল পাথরের টেবিল, গ্রান্ড পিয়ানো, সোনার গিল্টি করা দেয়াল ঘড়ি ও কাড়ি কাড়ি তৈলচিত্র। মনে হয় আমরা চলে এসেছি পুরানো কোন এন্টিক বা কিউরিও’র আড়তখানায়। ঠিক বুঝতে পারি না মি. নাকানে এ ধরনের বিচিত্র মালমাত্তা কীভাবে যোগাড় করলেন? আরো আশ্চর্য এ বাসোটো গোত্রের ভদ্রলোকের বৈঠকখানায় লেবানিজ কেতার কফি ও স্ন্যাকস্ পরিবেশিত হচ্ছে দেখে। মি. মোজাফেলা আমার দেয়া উপহার ভারী ও মোটা সোনালি রঙের বলপয়েন্ট কলমটি খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে ম্যানুয়েলে ছোট্ট হরফে লেখা তার ব্যবহারবিধি পড়ছেন আতশি কাচে। কলমটিতে গুপ্ত আছে একটি টেপরেকোর্ডার। যেহেতু মি. মোজাফেলা প্রাইভেট ডিটেকটিভ হিসাবে কিছু কাজকর্ম করার উদ্যোগ নিয়েছেন, সুতরাং আমি তাকে এ গুপ্ত টেপরেকোর্ডারটি উপহার দিয়েছি। বস্তুটি আমি ক্রয় করি বছর কয়েক আগে আমার মেয়ে কাজরিকে নিয়ে স্পাই মিউজিয়াম দেখতে গিয়ে। কারো সাথে কথা বলতে বলতে নোট নেয়ার জন্য কলমের ডগা টিপে দিয়ে লেখার ভান করলে তা আপনা আপনি রেকর্ড করে কথাবার্তা। মি. মোজাফেলা আমাকে সকল কাজে সহায়তা দিচ্ছেন, সুতরাং কলমটি যদি তার কোন কাজে লাগে আমি খুব খুশি হবো। তিনি স্পাই টেপ রেকোর্ডার নিয়ে মেতে আছেন দেখে আমি ব্যাকপ্যাক থেকে মি. নাকানেকে নিয়ে করা ফাইল বের করে টাইপ করা পৃষ্টাগুলো পড়ি।
লালচে কাদামাটির কুটির
স্ত্রী মিসেস বনেলো যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেগুলার টাকা পাঠাতেন মি. নাকানেকে। সে মূলধনে পাড়ার মুদির দোকানকে তিনি আধুনিক ডিপার্টমেন্ট স্টোরে রূপান্তরিত করেন। ক্রয় করেন একটি পেট্রোল পাম্প। তারপর মাসেরু শহরের চীনা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে রায়ট হলে, তিনি লুটপাটে অংশ নেন। তখন থেকে তার বিত্ত বিস্তারিত হতে থাকে বিপুলভাবে। মাসেরু শহরের কৃষ্ণাঙ্গ বাসোটো সম্প্রদায়ের লোকজনের ব্যবসা বাণিজ্যে পুজি খাটানোর কোন আগ্রহ নেই। এ শূণ্যতা পুরণ করছে মাঝারি মাপের অভিবাসি চীনা ব্যবসায়ীরা। বাজারে চালু গুজব হচ্ছে- মি. নাকানে একটি কৃষ্ণাঙ্গ যুবকদের গ্যাং এর অভিবাবক। এ গ্যাং এর কাজ হচ্ছে যাদুটোনা তুকতাকের উপাচার- যেমন মৃত শেয়ালের রঞ্জিত অন্ডকোষ, মেষের নাড়িভুড়ি বা বেজায় দুর্গন্ধ ছড়ানো কোন ভেষজ রাতের অন্ধকারে চীনা ব্যবসায়ীদের বাড়ি বা দোকানপাটের আঙ্গিনায় ছুড়ে দিয়ে ত্রাসের সঞ্চার করা। পরে এ সব উৎপাত বন্ধ করার বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে লাভের একাংশ আদায় করা। কিছু চীনা ব্যবসায়ীরা গ্যাং এর যুবকদের টাকা পয়সা দিতে অস্বীকার করলে শহরে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রেতা বনাম চীনা ব্যবসায়ীদের মধ্যে রায়ট বাঁধানো হয়। রায়ট করনেওয়ালা কিছু বাসোটো যুবককে পুলিশ ধরে নিয়ে গেলে মি. নাকানে তাদের জামিনের ব্যবস্থা করেন।
তার দ্রুত সম্পদ বৃদ্ধির আরেকটি সূত্র হচ্ছে-কমদামে সাউথ আফ্রিকান শ্বেতাঙ্গ বুয়ারদের ফার্নিচার, গাড়ি, আর্ট অবজেক্ট ইত্যাদি কিনে নিয়ে তা পরে বেশী দামে মূলত সদ্য পয়সাওয়ালা সাউথ আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ বা পর্যটকদের কাছে বিক্রি করা। পাশের দেশে নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে এপারটাইট নামক বর্ণ বিভাজনী প্রথার অবসান হলে বেশ কিছু শ্বেতাঙ্গ বুয়ার পরিবার সীমান্ত অতিক্রম করে লিসোটোতে এসে বাস করতে শুরু করে। এদের অনেকেই এপারটাইট আমলে খুন, জখম বা ধর্ষণ জাতীয় ক্রাইমের সাথে যুক্ত ছিলো। এদের জন্য সাউথ আফ্রিকায় বসবাস করা আজকাল নিরাপদ নয়। লিসোটো ভিন্ন দেশ, এখানকার নিরাপত্তায় বসবাস করে বুয়াররা এজেন্টদের মাধ্যমে বিক্রি করাচ্ছে সাউথ আফ্রিকায় তাদের সয় সম্পত্তি। তারপর মি.নাকানের আড়তে ঘটিবাটি ফার্নিচার সস্তায় বিক্রি করে তারা পাড়ি দিচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, হলান্ড বা কানাডায়। এরা রেগুলার বিমান বন্দর ব্যবহার করছে না। লিসোটোর রাজ পরিবারের এক সদস্যের আছে ছোট্ট একটি বিমান। মি.নাকানে নাকি যোগাযোগ ঘটিয়ে দিচ্ছেন, যাতে ক্রিমিনাল গোছের বুয়াররা রয়েল প্লেনে চেপে পাড়ি দিতে পারে পাশের অন্য একটি থার্ড কানট্রিতে।
পাহাড়ি পথে ল্যান্ডরোভার
ফাইলে লাল কালিতে হাইলাইট করা পৃষ্টাগুলোতে আছে মিসেস বুনেলোর মাসেরুতে আসার পরের ঘটনাগুলোর বিবরণ। তিনি যখন যুক্তরাষ্ট্রের আমহার্স্টে বাস করছিলেন তখন তার স্বামী পর পর আরো দুটি বাসোটো তরুণীকে বিয়ে করেন। লিসোটো সমাজে পুরুষদের মধ্যে বহুবিবাহের প্রচলন আছে। পরবর্তী স্ত্রীদের মাধ্যমে তার নয়টি পুত্রকন্যা জন্ম নেয়। এতে তুষ্ট না হয়ে মি. নাকানে একটি আফ্রো-লেবানীজ মেয়েকে কেপ্ট হিসাবে রাখেন। এ নারী চেহারা সুরতে খুবই সুদর্শনা। তার সাথে নিয়ত সঙ্গম করার অভিপ্রায়ে পয়ষট্টি বছর বয়সের মি. নাকানে নাকি আজকাল এক চীনা বনাজি ওষুধের ডাক্তারের পরামর্শে আফ্রোদিসিয়াক হিসাবে গন্ডারের খগড় চূর্ণ এস্তেমাল করছেন। মাসেরুতে ফেরার পর প্রথম সপ্তাহ দশদিন মিসেস বুনেলো স্বামীর এসব হালচাল নীরবে পর্যবেক্ষণ করেন। অবশেষে এক রাতে খেপে গিয়ে তাকে কাঁটাওয়ালা হাইহিল স্যান্ডেল দিয়ে প্রহার করেন। যুক্তরাষ্ট্রে সেল্ফ ডিফেন্স টেকনিক হিসাবে মিসেস বুনেলো থাইকোয়ান্ড বা জুজুৎসুর মারপ্যাচ শিখে এসেছেন। যা তিনি স্বামীর উপর অবলীলায় প্রয়োগ করলে মি.নাকানে ব্যাপকভাবে জখম হন। এক পর্যায়ে মিসেস কাপড় কাটা কাঁচি দিয়ে মি.নাকানের প্রজননের প্রত্যঙ্গ কেটে নেয়ার চেষ্টা করলে, অন্য স্ত্রীরা কর্মচারীদের সহায়তায় তাকে ধরে-বেঁধে পুলিশে এত্তেলা দেয়। রাজকীয় কানুনে স্বামীকে প্রহার করা খুবই গর্হিত কাজ। তো মিসেস দু বছরের কারাদণ্ড পান। জেলখানায় মাস ছয়েক কাটনোর পর স্ট্রোক হলে স্বামী মি. নাকানে কলকাঠি নাড়িয়ে তাকে বের করে আনেন। বর্তমানে মিসেস বুনেলো বাস করছেন একাকী মাসেরু শহর থেকে বেশ দূরে পার্বত্য অঞ্চলের একটি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন গ্রামে। তিনি একেবারে নীরব হয়ে গেছেন। কারো সাথে আজকাল আর মিসেস বুনেলো কথাবার্তা কিছু বলেন না।
ফাইল পড়ে বেশ কিছু জরুরী তথ্য জানা যায়, তবে এন্টিকের আড়তখানায় বসে বসে বেজায় একঘেঁয়ে লাগে। তাই উঠে দাঁড়িয়ে বুয়ারদের ফেলা যাওয়া আসবাব পত্র ও শিল্পদ্রব্য খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করি। প্রচুর পোটট্রেট পেইনটিং থেকে শ্বেতাঙ্গ সাহেবদের পূর্বপুরুষরা তাকিয়ে আছেন ড্যাবড্যাব করে। আন্দাজ করি- পয়সাওয়ালা কোন পর্যটক এসব পেইনটিং কিনে তা ধারালো ছুরি দিয়ে কেটে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে ওখানে লাগাবে তার প্রিয় শ্যালিকার বিমূর্ত স্কেচ বা আপন শ্বশুরের তৈলচিত্র।
মাসেরু শহরের লাগোয়া উপত্যকা
বেল বেজে ওঠলে কর্মচারী আমাদের নিয়ে উপরের তলায় আসে। রিভলভিং চেয়ারে বসে আছেন ওলের স্যুট পরা মি. নাকানে। তার চাঁদির তাবৎ চুল পেকে দেখাচ্ছে শোঁয়াপোকার তুলতুলে রোয়ার মতো। বাটনহৌলে টকটকে লাল গোলাপ গুঁজে ভদ্রলোক শিশা-হুঁকায় ধুমপান করছেন। তার বেশবাস দেখে মনে হয় তিনি যেন ককটেল পার্টিতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে বসে আছেন। আমাকে চিনতে পারেন, তবে তেমন কোন উচ্চাস দেখান না। আমি মিসেস বনেলোর বিষয় জানতে চাইলে তিনি জানান যে-স্ট্রোক হাওয়ার পর থেকে তিনি আর কারো সাথে কথাবার্তা কিছু বলেন না। স্বাস্থ্যগত কারণে গেল কয়েক বছর হয় তিনি বেশ দূরের একটি গ্রামের নিরিবিলিতে বাস করছেন। তার কী ধরনের চিকিৎসা চলছে জানতে চাইলে মি.নাকানে জবাব দেন,‘মাসেরুতে আমেরিকার মতো মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসার কোন সুযোগ নেই, তার প্রয়োজনও নেই। মিসেস বনেলো মূলত নির্ভর করছেন দেশী বনাজী চিকিৎসার উপর। ’ আমি এবার তাকে চাক্ষুষ দেখার পার্মিশন চাই। তিনি শিশা-হুঁকার নল মুখ থেকে সরিয়ে মাথা হেলিয়ে রাজি হন। প্যাড থেকে এক টুকরা কাগজ ছিড়ে খসখসিয়ে তাতে লিখেন গ্রামের নাম ‘মালাতালেই’, এবং কোন সড়ক ধরে যেতে হবে তার সামান্য ডিরেকশন। লিখে তা মি. মোজাফেলার হাতে ধরিয়ে দিতেই আমরা হাত-টাত মিলিয়ে বিদায় নিয়ে নিচে নেমে কাউন্টারে আসি। গাড়ি বারান্দায় আসতেই দেখি দাঁড়িয়ে আছে একটি ল্যান্ডরাবার। ড্রাইভার মি. মোজাফেলাকে স্যালুট দিয়ে বলে তার উপর অর্ডার হয়েছে আমাদের নিয়ে মালাতালেই গ্রামে যাওয়ার।
ল্যান্ডরাবার হাঁকিয়ে মাসেরু শহরের ঘরবাড়িতে পূর্ণ উপত্যকা অতিক্রম করে আমরা চলে আসি হ্যাট মাউন্টেনের কাছে। গাড়ির জানালা দিয়ে পরিষ্কার দেখা যায় বিচিত্র পাহাড়টির উপর পাথরের মিনারের মতো কৌণিক শেপের চূড়া। ওখানে সড়ক বাঁক নেয়। ঘন্টা দেড়েক ড্রাইভ করার পর আমরা চলে আসি মাসেরু শহর থেকে বেশ দূরে আরেকটি পাহাড়ি উপত্যকায়। পাহাড়ের পর পাহাড় পেচিয়ে কাঁচা সড়ক চলে গেছে এঁকেবেঁকে। কোন জায়গায় ল্যান্ডরাবারকে পাহাড়ের কার্নিশ বেয়ে উঠে যেতে হয় অনেক উপরে। ধুলা উড়িয়ে নির্জন সড়কে ড্রাইভ করতে করতে এক জায়গায় দেখি পথের পাশ ধরে তিনটি টাট্টু ঘোড়ায় সামান চাপিয়ে হেঁটে যাচ্ছে কম্বল পরা দুটি রাখাল বালক। মি. মোজাফেলা ফিসফিস করে বলেন, এদের সাথে কথাবার্তা বলতে পারলে হয়তো জানা যাবে কিছু ক্রিটিক্যাল তথ্য। আমি ড্রাইভারকে গাড়ি রুকতে বলি। নেমে এসে এদিক ওদিক তাকিয়ে তুলি একটি দুটি ছবি। রাখাল ছেলেরা বেশ আগ্রহ নিয়ে ক্যামেরার স্ক্রিনে তাদের ছবি দেখে। এ সুযোগে মি. মোজাফেলা তাদের সিসোটো ভাষায় কিছু প্রশ্ন করেন। গাড়িতে ফিরে আসলে নোটপ্যাডে প্রশ্নগুলোর জবাব গুছিয়ে লিখে আমাকে দেখান। ছেলে দুটি উপত্যকার বেশ গভীরে গবাধি পশু চরালেও তদের হেঁটে যেতে হয় মালাতালেই গ্রামের পাশ দিয়ে। মিসেস বনেলোর বিষয় আশয় সম্পর্কে তারা অবগত। তাদের হেঁটে যেতে হয় তার কুটিরের পাশ দিয়ে। তাদের ধারনা মহিলা মূলত একজন ডাইনি। তিনি কারো খারাপ কিছু করেন না। তবে বেশ কতগুলো পাখি তার বশ হয়েছে। তারা তার কুটিরের পেছনে একটি গাছে নীড় বেঁধেছে। শোনা যাচ্ছে যে- এসব নীড়ের খড়বিচালিতে আছে ওষধিগুন। তাই কয়েক দিন আগে কারা যেন গাছ থেকে পেড়ে নিয়ে গেছে বেশ কয়েকটি পাখির বাসা।
কলোনিয়েল কেতার ভিলা
মালাতালেই গ্রামে জনসংখ্যা খুবই কম। পাহাড়ের ঢালে বেশ দূরে দূরে দেখা যায় একটি দুটি কুটির। আমরা গাছের তলায় ল্যান্ডরাবার দাঁড় করিয়ে সামনে বাড়ি। মিসেস বনেলোর কুটিরটি একেবারে বিচ্ছিন্ন, একটি টিলার অন্য পাশে। ছনে ছাওয়া তার ঘর লাল কাদামাটি দিয়ে লেপাপুছা। উঠানটিও সুন্দর করে নিকানো। কিন্তু কোথাও কাউকে দেখতে না পেয়ে আমরা দ্বিধাগ্রস্থ ভাবে দাঁড়িয়ে থাকি একটুক্ষণ। কুটিরের ওপাশ থেকে ভেসে আসছে তারের বাদ্যযন্ত্রের মৃদু আওয়াজ। মি. মোজাফেলা গলা খাকারি দিয়ে জানান দেন। কিন্তু কোন সাড়াশব্দ আসে না। তখনই আমি খেয়াল করি আঙিনা থেকে একটু দূরে একটি বড়সড় গাছ। তাতে ঝুলছে অনেকগুলো পাখির বাসা। দেখতে অনেকটা বাবুই পাখির নীড়ের মতো। মৃদু হাওয়ায় গাছের সবুজ পাতায় যেন এক সাথে অজ¯্র চোখে পলক পড়ছে।
আমরা অবশেষে বাজনার সুরলয় নিশানা করে চলে আসি পিছনের আঙিনায়। ওদিকে আরেকখানা কুটির। মনে হয় মিসেস বনেলোকে দেখভাল করার কোন কাজের মহিলা ওখানে বাস করেন। তাকে পাওয়া যায় সে কুটিরের পেছনে, বসে আছেন এক চিলতে আঙিনায় বেতের একটি মোড়ায়। তিনি গায়ে কম্বল জড়িয়ে আছেন, তাতে গাছপালার নকশা আঁকা। তার মুখ কাঠের মুখোশের আড়ালে বলে আমরা তার চোখ দেখতে পাই না। মিসেস বনেলোর সামনে রোদে দাঁড়িয়ে কম্বল গায়ে একটি মেয়ে বাজিয়ে যাচ্ছে তারের বাদ্যযন্ত্র। তার মাথায় পশুর চামড়ায় তৈরী টুপি। তাতে সেলাই করে গাঁথা কোন পাখির দীর্ঘ পালক। তার বাদ্যযন্ত্রটি একটি গাছের ডালে শুধুমাত্র তার জড়িয়ে তৈরী করা। কিন্তু তা থেকে বেরোচ্ছে রহস্যময় সুরলহরি। আমাদের আগমনে মিসেস বনেলোর মাঝে কোন ভাবান্তর দেখা যায় না। তিনি স্থির হয়ে বাজনা শুনতে শুনতে যেন বুঁদ হয়ে আছেন অন্য কোন জগতে। লিসোটোর সমাজে প্রতিটি আচার অনুষ্ঠানে পরার জন্য আছে বিশেষ রকমের নকশা করা কম্বল। মিসেস বনেলো যে কম্বলটি পরে আছেন তার নাম ‘সেফাতে’ অর্থাৎ বৃক্ষ। মানুষ যখন বয়সের প্রান্তিকে এসে প্রকৃতির অংশ হয়ে উঠতে চায় তখন তারা এ ধরনের কম্বল গায়ে জড়িয়ে বনানীর গভীরে এসে প্রতীক্ষা করে মৃত্যুর। কিন্তু তার তো তত বয়স হয়নি। হয়তো জীবনের এ পর্বে এসে নীরবতা তার কাম্য হয়ে ওঠেছে। কিন্তু সম্পূর্ণ নির্বাক হয়ে গেলেন কেন মহিলা, তা ঠিক বুঝতে পারি না। দেখতে দেখতে গাছ থেকে উড়ে এসে তার শরীরে বসে সাত আটটি ছোট ছোট হলুদিয়া পাখি। পাখিগুলো কম্বলের উপর দিয়ে হাঁটছে। চিঁউ চিঁউ শব্দে ছড়াচ্ছে কৌতূহল। মিসেস বনেলো তাদের আগমনেও নির্লিপ্ত থাকেন। পাখিগুলো হঠাৎ বোধ করি আমাদের উপস্থিতিতে সচেতন হয়ে ফুরৎ করে একসাথে উড়ে পালায়।
মাসেরু শহরের ভিড়ভাট্টাহীন সড়ক
আমি তাকে সম্ভাষণ জানাই। কোন জবাব পাই না। কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। মিসেস বনেলো কাঠের মুখোশের দুটি ছিদ্র দিয়ে নিস্পলকভাবে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। ছিদ্র দুটি সংকীর্ণ বলে তার চোখ দুটিকে দেখায় পতঙ্গের অক্ষিগোলকের মতো ক্ষুদ্র। আমি আরো একটু কাছে গিয়ে বলি,‘আমাকে মনে পড়ে না মিসেস বনেলো, এক সময় আমহার্স্ট শহরের বাকুকুকু রোস্তোরাঁয় মাঝে মাঝে খেতে যেতাম। তার বছর দ্ুেয়ক আগে একটি প্রশিক্ষণে আমরা একসাথে নানা ধরনের এক্টিভিটিতে যুক্ত ছিলাম। ’ ফুল পাড়তে গিয়ে ঝাঁকিয়ে দেয়া গাছের মতো তার শরীর দুলে ওঠে। প্রচুর পরিশ্রম করে তিনি উঠে দাঁড়ান। কোন দিকে না তাকিয়ে তারপর হাঁটতে থাকেন তার কুটিরের দিকে। পেছন থেকে দেখি হাঁটতে হাঁটতে তার শরীর কেঁপে ওঠছে থেকে থেকে।
মিসেস বনেলো কুটিরে ঢুকে দুয়ার আটকে দিলে-আমি বিভ্রান্তির মাঝে পড়ি। তবে কী তার খোঁজ নিতে আমি যে এসেছিÑবিষয়টি তার পছন্দ হয়নি? নাকি কোন কারণে তার বিষ্মরণ এতে তীব্র যে আমাকে তিনি চিনতে পারেননি? মি. মোজাফেলা এবার তারের বাদ্যযন্ত্র বাজানো মেয়েটিকে কিছু প্রশ্ন করেন। জবাবগুলো তিনি নোটবুকে গুছিয়ে লিখেন। তার উকিলের মতো চুলচেরা সওয়ালে মেয়েটিকে সন্ত্রস্ত দেখায়। অবশেষে বিরক্ত হয়ে আমি বলি,‘মি. মোজাফেলা, লেটস্ গো ব্যাক টু দ্যা কার। মেয়েটিকে খামোকা জ্বালাতন করে ফায়দা কি? চলেন আমরা গাড়িতে ফিরে যাই। ’ মুথাঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা মিসেস বনেলোর কী হয়েছে তা নিয়ে টুকটাক কথাবার্তা বলি। মি. মোজাফেলা প্রশ্ন করে যা জেনেছেন তা হচ্ছে- মেয়েটিকে মি. নাকাকে মাসোহারা দিয়ে রেখেছেন মিসেস বনেলোকে প্রতিদিন একবার করে এসে ঔষধ খাইয়ে যেতে। তার দাদা গ্রামের নাগানগা বা তুকতাক যাদুটোনার ওঝা। অসুখ বিসুখে তিনি বনাজি ওষুধ বিষুদ দিয়ে চিকিৎসা করে থাকেন। ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় তার শরীরের তাপমাত্রা কমে যায় ঘন্টা দুয়েকের মতো। শীতের তীব্র অনুভূতিতে তার গা কাঁপতে থাকে। তখন কম্বল জড়িয়ে তিনি রোদে বসে থাকেন। মন্ত্রপূত বাদ্যবাজনা মেয়েটি তার দাদামশাই এর কাছ থেকে শিখেছে। তার বাদনে শান্ত হয়ে আসে মিসেস বনেলোর দেহ।
লিসোটোর পর্বত ও বনানী
গাড়িতে উঠার আগে মি. মোজাফেলা আমাকে তার পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে বলেন। তার ধারনা মি. নাকানে চান না মিসেস বনেলো মাসেরু শহরে তার সংসারে বাস করে উৎপাত সৃষ্টি করেন। তাই তিনি তাকে কৌশলে এখানে রীতিমতো নির্বাসনে পাঠিয়েছন। নাগানগার ওষুধ আর যাদুটোনা দিয়ে বশ করে তিনি তাকে সম্মোাহিত করে রেখেছেন যাতে মিসেস বনেলো আর সংসারের বাস্তবতায় ফিরতে না পারেন। গাড়িতে বসে আমি ভাবি-হয়তো মিসেস বনেলো ভুগছেন পর্কিনসন রোগে। অনেক বছর আগে আমি যখন তাকে চিনতাম তখন তিনি তার দৈহিক সৌন্দর্য নিয়ে ছিলেন অতিমাত্রায় সচেতন এক যুবতী। কারাগারে যখন স্ট্রোক হয় তখন অচিৎসার জন্য তবে কী তার মুখ বাঁকাচোরা হয়ে গেছে, লোপ পেয়েছে কথা বলার স্বাভাবিক শক্তি? তবে কী মিসেস বনেলো তার রোগ জনিত দৈহিক অবক্ষয় ও মোছে যাওয়া রূপকে আড়াল করতে আজকাল সর্বদা মুখোশ পরে থাকেন? গাড়ি কাঁচা সড়ক বেয়ে ধুলা উড়িয়ে উঠে আসছে একটি বৃহৎ টিলার উপর। একটি বিষয়ে আমি সচেতন হয়ে ওঠি-বছর দশেকের ব্যবধানে লিসোটোতে কীভাবে আমার জানাশোনা সকলের দেহমন ও সামাজিক অবস্থানে পরিবর্তন এসেছে। আমিও কী আগের মতো আছি? ভাবি-নিরিবিলিতে এবার খতিয়ে দেখতে হবে-আমার শরীর, মন-মানস ও সংসারে কতোটা পরিবর্তন এসেছে?
বাংলাদেশ সময়: ২২১৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২, ২০১৫
জেডএম/