ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

ইতালি ভ্রমণ-১

ভেরোনো শহরে জুলিয়েটের বাড়ি

মুনশী আরিফ রশীদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০১৬
ভেরোনো শহরে জুলিয়েটের বাড়ি

বাবা-মা দু’জনই ভ্রমণপ্রিয়। তাই জিনগতভাবেই আমার মধ্যে ঘুরে বেড়ানোর নেশাটা পূর্ণরূপে।

দেশে থাকাকালীন টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া চষে বেড়িয়েছি। সেসব ভ্রমণে কখনো ছিলো বন্ধু, কখনো পরিবার।

২০১৫ সালের এপ্রিলে মাস্টার্স করার জন্য যখন জার্মানির জারল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে এসেছি, তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি এই দুই বছরে ইউরোপের যতটুকু পারা যায় চষে ফেলতে হবে। ভার্সিটির একদিনের এস্কারশনগুলো এবং বন্ধুরা মিলে চারমাসে জার্মানির চারটা শহর, ফ্রান্সের ছোটো তিন শহর আর লুক্সেমবার্গে একটা মিনি ট্রিপ দিয়ে ওয়ার্মআপ হয়ে গেছে। তবে বড় কোনো ট্রিপ দেওয়া হয়নি।

প্ল্যান ছিলো সামার ব্রেকে শুরু করার। ব্যাপারটা আগুনে ঘি পড়ার মতো। আরও উসকে যায় যখন আসার তিনমাস পরেই আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুদের একজন হাসনাইন জার্মানিতে চলে আসে। এক্সাম শেষ, সামার ব্রেক শুরু হয়ে গেছে। প্রজেক্টের কাজ করতে করতে হঠাৎ একরাতে মাথায় চাপলো ঠিক যা করার আজই করতে হবে।

সবচেয়ে কাছে প্যারিস, কিন্তু ইরাসমুসের বন্ধু ইজ্জু প্যারিস দেখাবার দায়িত্ব নিয়েছে। তাই সে প্যারিস না থাকায় প্যারিস বাদ। বন্ধু হাসনাইনকে ফোন দিয়ে জানতে চাইলাম, ইতালি নাকি স্পেন? সে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিলো আগের মতোই ম্যানেজার হিসেবে সে খরচের ব্যাপারগুলো দেখবে এবং বরাবরের মতোই ট্যুর প্ল্যানের কাজ আমাকেই করতে হবে, তাই সিদ্ধান্তটাও আমাকেই নিতে হবে।

চিন্তা করে দেখলাম চাচতো বোন পরিবার নিয়ে যেহেতু ভেনিসের কাছেই থাকে তাহলে ইতালিই যাই। যেই ভাবা সেই কাজ। প্রজেক্টের কাজের ফাঁকে ফাঁকে গুগলে অনুসন্ধান করা শুরু করলাম।

খরচ কমাতে প্রথমে চিন্তা করেছিলাম বাসে যাবো, পরে দেখলাম ফ্রাঙ্কফুট হান এয়ারপোর্ট থেকে মাত্র ১৫ ইউরো দিয়ে রায়ান এয়ারে করে ভেনিস যাওয়া যাবে। সিদ্ধান্ত হলো আমি চারদিন আগে গিয়ে মিলান ঘুরে আমার বোনের সঙ্গে দেখা করে ভেনিস চলে আসবো।

হাসনাইন চতুর্থ দিনে আমার সঙ্গে যোগ দেবে। এরপর আমরা একসঙ্গে ভেনিস, ফ্লোরেন্স ও রোম ঘুরবো। যেহেতু রায়ান এয়ারের অফারের টিকিট শেষ হয়ে যাচ্ছিল এবং ইউরোপের বড় বড় শহরগুলোকে সংযুক্ত করা মেগাবাসের টিকিট একটু আগে কাটলে এক ইউরোতেও ৫০০ কিমি দ‍ূরত্বের টিটিটও পাওয়া যায়, তাই টিকিটগুলো আগেই কেটে ফেললাম।
 
অবশেষে এলো সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। ১ সেপ্টেম্বর রাতে ট্রেনে করে হানে গেলাম। কিন্তু বিধিবাম, শুরুতেই ঝামেলা। রেসিডেন্স পারমিট সঙ্গে থাকলেও পাসপোর্ট বাসায় রেখে এসেছি। তাই প্লেনে আর ওঠা হলো না। পরের দিন মানে ৩ সেপ্টেম্বর সকাল ৬টায় মিলানের বাসে উঠলাম, যেটা কার্লশ্যুয়ে, ফ্রাইবুর্গ, জ্যুরিখ হয়ে রাত ১২টায় মিলান পৌঁছালো।

সেখান থেকে আরেক বাস রাত ১টায় রওয়ানা হয়ে ভোর ৫টায় পৌঁছালো পাদুভা। বোনের স্বামী বাবলু ভাই বারবার করে বলে দিয়েছিলেন আমি যেনো তার বাসার ট্রেনে ওঠার আগে অবশ্যই তাকে ফোন দেই। যেনো তিনি আমাকে স্টেশন থেকে নিয়ে যেতে পারেন। ৫টা ৪৫ এ যখন পাদুভা থেকে ট্রেন ছাড়লো তখন তার ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছে করেনি। এমনকি ৬টা ৩০ এ যখন লনিগোতে ট্রেন আমাকে নামিয়ে দিলো তখনো না।

ভরসা স্কাউটের জিপিএস ম্যাপস অ্যান্ড নেভিগেশন। পুরো ইতালির অফলাইন ম্যাপ ডাউনলোড করে নিয়ে গেছি, তাই ইন্টারনেট ছাড়াই যেকোনো ঠিকানা খুঁজে বের করে দিতে পারে, সঙ্গে দিকনির্দেশনা তো আছেই।

স্টেশন থেকে বের হওয়ার পরেই মনে পড়লো আরেক ইরাসমুস বন্ধু কৃথকী বলেছিলো আমার ইউরোপ ভ্রমণের সময় আমি যেনো অন্তত একবার কাউচসার্ফিং থেকে কারও বাসায় কাউচ শেয়ার করি। আর অন্তত একবার যেনো হিচ হাইকিং (বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে গাড়িতে লিফট নেওয়া) করি।

স্টেশন থেকে বের হয়ে চিন্তা করলাম আজই সুযোগ হিচ হাইকিংয়ের। কিন্তু সংকোচের কারণে ৪/৫ টা গাড়ি করলেও হাইকিং করা হলো না।

পেছোন থেকে আবারো গাড়ি আসার শব্দ। সব জড়তা ঝেড়ে ফেলে ইশারা করলাম। কিন্তু হায়! গাড়িটি না দাড়িয়ে হুশ করে আমার সামনে দিয়ে চলে গেলে একটা বাঁকের আড়ালে। হতাশ হলাম না, বুঝতে পারলাম আরও কিছু চেষ্টা চালাতে হবে।

৩০ সেকেন্ড পরে উল্টো দিক থেকে একটা গাড়ি এসে পাশের ঘাসের মধ্যে সাইড করে রাখলো। আরে আজব! চালক দেখি আমাকে ইশারা করছে গাড়িতে ওঠার জন্য। ভালো করে খেয়াল করে দেখি এটা সেই গাড়ি যেটাকে ইশারা করার পরে চলে গিয়েছিলো।

আমি বেজায় খুশি, প্রথম চেস্টাতেই হিচ হাইকিংয়ে সফল। কিন্তু গাড়িতে ওঠার পরেই বুঝতে পারলাম চালক মশাই একবিন্দুও ইংরেজি পারেন না। আর আমি পারি না ইতালিয়ান। তবে তাকে ম্যাপে পিন করা অ্যাড্রেস ও রাউট দেখাতে খুব একটা কষ্ট হলো না। এরপর দু’জন দুই ভাষায় গল্প করতে করতে ১০ মিনিটের মাথায় আমি বোনের বাসার নিচে।

বাবলু ভাইকে যখন ফোন দিয়ে জানালাম আমি বাসার নিচে, তিনি বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা খেলেন। ধাক্কা সামলে নিচে এসে বাসায় নিয়ে গেলেন। বাসায় যাওয়ার পরে সবার মুখ দেখে প্রথমেই যেটা বুঝতে পারলাম আমার যাওয়াতে সবাই অত্যন্ত খুশি। এরপরে শুরু হলো চিরচরিত বাঙালি আপ্যায়ন। খুব একটা খেতে না পারার কারণে তাদের খুশি করাটা আমার জন্য বেশ কষ্টসাধ্য ছিলো।

সকালের দিকটাতে ঘুরে দেখলাম লনিগো, এরপরে দুপুরে লনিগোর বাংলাদেশি কমিউনাল মসজিদে জুমার নামাজ পড়লাম।

বিকেলে সবাই মিলে বের হলাম ভেরোনার উদ্দেশ্যে। ভেরোনা বিখ্যাত এর শৈল্পিক ঐতিহ্য, একটি রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটার ও শেক্সপিয়ারের তিনটি নাটকের পটভূমিকা ভেরোনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠায়। নাটক তিনটির মধ্যে অবশ্যই বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় রোমিও অ্যান্ড জ়ুলিয়েটের কথা। মজার ব্যাপার এই শহরে আপনি এখনো টিকিট কেটে জুলিয়েটের বাসা ঘুরে দেখতে পারেন।

অবাক হচ্ছেন! জুলিয়েটের বাসা কোথা থেকে এলো! আমি নিজেও অবাক হয়েছিলাম। পরে জানতে পারি সেখানে ১৫শ শতকের একটি বাসাকে জুলিয়েটের বাসা ঘোষণা করা হয়েছে, যেটার সঙ্গে গল্পের জুলিয়েটের বাসার অনেক মিল। এমনকি জুলিয়েটের সেই বিখ্যাত ব্যালকনিটাও অবস্থানগতভাবে প্রায় একই রকম।

সত্যিটা জানা থাকলেও ১৫শ শতকের একটা বাসা ঘুরে দেখা, আসবাব, তৈজসপত্র এসব দেখার মধ্যেও যথেষ্ট রোমাঞ্চ আছে। জুলিয়েটের বাসা দেখা শেষ করে কিছুক্ষণ হেঁটে বেড়ালাম শহরের মধ্য দিয়ে। খুব অবাক হয়ে দেখতে থাকলাম ১৫শ শতকের স্থাপত্য যেগুলোতে এখনো মানুষ বসবাস করে। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার মাধ্যমে এলে অনেক কিছুই সম্ভব। সেখানে আমাদের দেশে আমরা লালবাগের কেল্লার দেওয়াল ভেঙে পার্কিং বানাই।

যাইহোক হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম অ্যাম্ফিথিয়েটার/অ্যারেনার সামনে। যেটা এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আর ঘোষণা করে যাচ্ছে হাজার বছর আগেকার রোমান শৌর্যবীর্যের কথা।

যারা অ্যাম্ফিথিয়েটার/অ্যারেনার নামের সঙ্গে পরিচিত নন তাদের বলে রাখি, এটা অনেকটা আজকের দিনের স্টেডিয়ামের মতো। অনেকেই হতো দেখেছেন গ্লাডিয়েটরেরা একটা মাঠের মতো যায়গায় একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধ করছে আর চারপাশে হাজার হাজার দর্শক উল্লাস করছে, সেটাই মূলত অ্যাম্ফিথিয়েটার।
অ্যাম্ফিথিয়েটার ঘুরে দেখে ভেরোনাকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলাম ভিসেঞ্জারের দিকে। পাহাড়ের ওপর থেকে রাতের ভিসেঞ্জা উপভোগ করলাম বেশ কিছুক্ষণ এবং অবশেষে রাত ১২টায় ঘরে ফেরা।

পরদিনটা কেটে গেলো শপিং আর লনিগো ঘুরে। তার পরেরদিন মানে ৬ সেপ্টেম্বর সকালে বোন, ভাগ্নি, বোনের শ্বশুর থেকে বিদায় নিয়ে আমি আর বাবলু ভাই গেলাম লনিগোর প্রখ্যাত রেস্টুরেন্টে ইতালির ঐতিহ্যবাহী সকালের নাস্তা ব্রিওশ আর ক্যাপাচিনো কফি খেতে। নাস্তা করে বাবলু ভাইয়ের থেকে বিদায় নিয়ে ট্রেনে ভেনিসের দিকে যাত্রার মাধ্যমে শেষ হলো আমার লনিগো ও ভেরোনা ভ্রমণ।

আগামী পর্বে থাকছে ভেনিসের গল্প

বাংলাদেশ সময়: ০০৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০১৬
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।