মস্কো (রাশিয়া) থেকে ফিরে: সাধারণত মিউজিয়ামে মোবাইল ফোন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু মস্কোর ‘ট্রেটইয়াকভ গ্যালারি’তে দর্শনার্থী অনেকের কানেই মোবাইল সদৃশ্য বস্তু দেখে বিস্ময় জাগল।
দেখতে অনেকটা মটোরোলা প্রথম দিককার ঢাউস সাইজের মোবাইলের মতো। সবাই কানে লাগিয়ে নি:শব্দে ছবির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। খানিকটা খটকা লাগল বিষয়টিতে। আমাদের সঙ্গে গাইড ছিলেন কেসনিয়া ঝাদানোভা। তাকে জিজ্ঞেস করলাম এগুলো কি? ঝটপট জবাব দিলেন, ‘অডিও গাইড’।
এর আগে অডিও গাইডের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না। তাই বিষয়টিতে গভীর মনোযোগ তৈরি হয়।
অডিও গাইড সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছিলাম আমাদের লাইফ গাইডের কাছে। আমার আগ্রহ দেখে অডিও গাইড আনতে পা বাড়ালেন কেসনিয়া ঝাদানোভা। কয়েক মিনিট পরেই একটি অডিও গাইড হাতে নিয়ে ফিরে এলেন।
বাটম চেপে কানের কাছে ধরতে বললেন। আর বললেন, দু’টি চ্যানেল রয়েছে একটি রুশ ভাষা অপরটি ইংরেজিতে। আমি যে ভাষায় শুনতে চাই সেই চ্যানেল পুশ করার জন্য। চ্যানেল পরিবর্তনের সুইচটি রিমোর্ট কন্ট্রোলের ভলিয়ম বাটমের মতো। উল্টোদিকে ভলিয়মও রয়েছে, ইচ্ছামতো সাউন্ড বাড়ানো কমানো যায়।
আগেই লক্ষ্য করেছিলাম অনেক ছবির পাশে কোড নম্বর রয়েছে। সেই কোর্ড নম্বর চাপ দিতেই কানে ভেসে এলো ছবির সবিস্তার বর্ণনা। কোড নম্বরের পাশে হেড ফোনের সিম্বল এঁকে দেওয়া হয়েছে যাতে বুঝতে কষ্ট না হয়। বেশ ভালো লাগল পদ্ধতি দেখে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসহ অনেক দুর্ভল কালেকশন রয়েছে গ্যালারিটিতে। চৌদ্দ শতকের বিচার কার্য, জল রঙে আঁকা হিটলার বাহিনীর নৃশংসতাও ঠাঁই করে নিয়েছে। গ্যালারিটির সংগ্রহের সংখ্যা ১ লাখ ৭০ হাজারে গিয়ে ঠেকেছে। সবগুলোতে অবশ্য কোড নম্বর নেই। শুধু ঐতিহাসিক ছবিগুলোর পাশে কোড নম্বর রয়েছে। যাতে অডিও গাইড ব্যবহার করে খুব সহজেই জানতে পারছে ঘটনার বিবরণ।
৩২১ নম্বর কোডের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, উর্দিপরা এক পদস্থ সেনা অফিসার দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে মুখ টিপে হাসছেন। আর একটি মেয়েকে ঘর থেকে টেনে সেদিকে নেওয়ার চেষ্টা করছেন একজন নারী। গাউন পরা মেয়েটি তখন ঘরের মধ্যে থাকা অপর নারীর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছিলেন। পাশে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছেন একজন প্রবীণ ব্যক্তি।
শিল্পীর তুলিতে আঁকা আঠারো শতাব্দীর কৃষ্টি-কালচার ও গ্রামীণ যানবাহন সবই রয়েছে সেখানে। দুই ধরনের ঘোড়ার গাড়ির ব্যবহার দেখা গেলো। একটিতে চাকা বিহীন শিশুদের শুপারি গাছের পাতা দিয়ে খেলনা গাড়ির মতো। বরফের উপর দিয়ে টেনে নিচ্ছে ঘোড়া।
আরেকটি আমাদের দেশের গরুর গাড়ির মতো চার চাকা বিশিষ্ট। তবে সামনের অংশের প্যাটার্ন কলকাতা শহরের মানুষে টানা রিকশার মতো। ঘোড়া দিয়ে টানানো হতো। চাকাগুলো অবিকল গরুর গাড়ির মতো। আরও অনেক ছবি সম্পর্কে সহজেই জেনে নিলাম অডিও গাইডের সাহায্যে। চমৎকার লাগল তাদের এই আইডিয়াটি।
জানতে চাইলাম, অডিও গাইড সেবা পাওয়ার উপায় কি। জবাবে গাইড জানালেন, রুশ ভাষার জন্য ৩৫০, আর ইংলিস, ফার্সি, স্প্যানিশ, ইতালিয়ান, চীনা ভাষার জন্য ৫শ’ রুবল। সারাদিন খুঁটে খুঁটে জানতে পারবেন সব ছবির বিবরণ।
তবে বেরিয়ে গিয়ে ফের ঢুকতে চাইলে আবার চার্জ দিতে হবে। একেবারে বেরসিক না হলে এখান থেকে বের হওয়া কঠিন। কারণ হাজার হাজার ঐতিহাসিক ছবি আপনাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো আটকে রাখবে। মনে হবে আরেক ধাপ এগিয়ে দেখি কি বিস্ময় অপেক্ষা করছে। শিল্পীর রংতুলির বাইরেও অনেক ভাস্কর্য আপনার ভাবনার জগতকে প্রসারিত করে তুলবে।
বাংলাদেশ যখন ট্যুরিস্ট গাইড নিয়ে হা পিতেশ করছে, তখন মস্কোবাসি কানে হেড ফোন লাগিয়ে নীরবে গাইডের কাজ সারিয়ে নিচ্ছে। আমাদের কর্তারা বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ান। তাদের চোখে কি এসব পড়ে না? স্বল্প খরচে জাতীয় জাদুঘর ও অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থাপনায় তো অডিও গাইড ব্যবহার করা যেতে পারে। তাতে একদিকে যেমন গাইড নিয়ে হা পিত্যেষ করতে হয় না, তেমনি যারা চাইবেন পূর্ণাঙ্গ ধারণা পাবেন।
মস্কোর প্রাণ কেন্দ্র রেড স্কয়ার-ক্রেমলিন থেকে দক্ষিণে পায়ে হাঁটা দূরত্বে লাভরস্কি লেনে অবস্থিত এই গ্যালারিটির নাম মস্কোবাসি গর্বের সঙ্গে উচ্চারণ করে থাকে। ১৮৫০ সালে যার গোড়া পত্তন করেছিলেন ধর্ণাঢ্য ব্যবসায়ী পাভেল ট্রেটইয়াকভ। তার ছিলো ছবি সংগ্রহের শখ। যেখানে যেতেন ভালো ছবি পেলে কিনে আনতেন।
১৮৫৬ সালে ছবির জন্য পৃথক সংগ্রহশালা তৈরি করেন তিনি। ১৮৯২ সালে এসে রাশিয়া সরকার তার নামে গ্যালারি প্রতিষ্ঠা করলে সেখানে ১ হাজার ৩৬২ পেইন্টিং, ৫২৬টি ড্রয়িং ও ৯টি ভাস্কর্য উপহার হিসেবে প্রদান করেন। তার নামেই নামকরণ করা হয় স্টেট ট্রেটইয়াকভ গ্যালারি।
চাইলেই বাঁধাহীনভাবে ছবি তুলতে পারবেন এখানে। ভেতরে বেশ কয়েকটি বিশ্রাম পয়েন্ট রয়েছে। ক্লান্ত হয়ে পড়লে যেখানে বসে খানিকটা জিরিয়ে নিয়ে আবার পা চালাতে পারবেন। গ্যালারির বাইরে চারদিকে ঝকঝকে প্রশস্ত রাস্তা। বাহারী ফুলের সমাহার রোমাঞ্চিত করে তুলবে আপনার ভ্রমণ পিপাসু মনকে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২০ ঘণ্টা, আগস্ট ১৬, ২০১৬
এসআই/জেডএম