পৃথিবীর সবচেয়ে ভেজা স্থান বলে পরিচিত মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে এ ঝরনার অবস্থান। উঁচু স্থানের একটি মালভূমি থেকে এই বৃষ্টির পানি হাজার ফুট নিচে একটি পুকুরের মতো স্থানে পড়ে।
খাসিয়া শব্দ ‘জাম্প অব কা লিকাই’ থেকে এই ঝরনার নামের উৎপত্তি। এই ঝরনার ওপরের একটি বাঁধ থেকে স্থানীয় রমনী কা লিকাই ঝাঁপ দিয়েছিলেন। লিকাইয়ের নামেই ঝরনাটির নামকরণ হয়েছে। খাসিয়া মেয়েদের নামের পূর্বে ‘কা’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়।
এই ঝরনা অবলোকন করতে হলে আপনাকে শিলং শহর থেকে ট্যাক্সি নিয়েই যেতে হবে। তবে এখানে পর্যটকরা খুব বেশি যান না।
প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরত্ব পাড়ি দিয়ে জৈন্তা পাহাড়ের ভেতরে চলে যেতে হবে আপনাকে। সঙ্গে স্থানীয় গাইড না থাকলে ওই স্থানটা চেনাটা মুশকিল হয়ে যাবে। পাহাড় বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখা যায় খাসিয়া নারী-পুরুষরা পথ তৈরির জন্যে পাথর ভাঙছেন।
যেমনটা আগে আমাদের পথের ধারে ইট ভাঙতে দেখা যেতো। কয়েকশো ফুট ওপরে ওঠা-নামা করার পর একটি ছোট লেক চোখে পড়ে। নিচে পাথরের স্রোত ধারা বয়ে গেছে। পানির ঠাণ্ডা আর কলকল শব্দ ছমছম করে তোলে চারিদিক। নিস্তব্দতাকে যেন ভেঙে ফেলতে চায়। এখানে একটি লোহার সাঁকো রয়েছে। তবে ব্রিটিশ আমলে তৈরি সাঁকোটি এখন ভাঙা। ছড়ায় পানি কম থাকায় পাথর টপকেই পেরিয়ে যাওয়া যায়। এরপর খাড়া পাথড়ের সিঁড়ি বাওয়া।
এখান দিয়ে নিয়মিত পাহাড়ের ওপর থেকে নিচে আসা যাওয়া করেন খাসিয়ারা। সকালে যে খাবার নিয়ে বের হয়েছে অনেকেই ছোট ছোট গর্তের মতো স্থানে ঢুকে খেয়ে নিচ্ছেন। এতো গভীর পাহাড়ি জঙ্গলে সিঁড়ি দেখে মেঘালয় সরকারকে বাহবা দিতেই হয়। খুব বেশি লোক যে ওই অঞ্চলে নেই, তা বোঝাই যায়। সেখানে এতো দীর্ঘ সিঁড়ি সত্যি প্রশংসার দাবিদার।
দু’টি পাহাড় পেরিয়ে ওপরে উঠতে থাকলে কানে আসে ঝির ঝির শব্দ। পাহাড়ের মাঝামাঝি স্থানে পাথরের নিচ দিয়ে সাবধানে হাঁটতে হয় কুঁজো হয়ে। মাথা তুললেই পাথরের আঘাতের ভয় রয়েছে। পাথর বেয়ে চুঁয়ে পড়ছে ঝরনার পানি। একটু এগোলেই কয়েকশো ফুট নিচে সবুজ পানির পুকুর। ভয়ে শরীর শিরশির করে ওঠে। এখানেই লিকাইয়ের শরীর আছড়ে পড়েছিলো।
এই শীতে ঝরনায় পানি তেমন নেই। রোদের আলোয় চিক চিক করছে ঝরনার পানি। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, নোহকালিকাই ঝরনার ওপরের মালভূমিতে রাঞ্জিয়েরথ নামে একটি গ্রাম ছিলো। যেখানে বাস করতেন লিকাই নামে এক নারী। প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর দ্বিতীয় বিয়ে দেওয়া হয় লিকাইকে। কা লিকাইয়ের প্রথম ঘরেই একজন কোলের সন্তান ছিলো। পাহাড় থেকে উপরে-নিচে মাল বেয়ে ওঠানোর কাজ করতেন লিকাই।
ফলে দীর্ঘক্ষণ লিকাই ঘরের বাইরে থাকতেন ও সন্তানের দেখভাল করতে পারতেন না। ফলে যখন ঘরে ফেরন পুরো সময়টুকুই নিজের সন্তানকে দিতেন। তবে দ্বিতীয় স্বামীকে সময় দিতে পারতেন না। প্রথম ঘরের সন্তানের ওপর এতো বেশি সময় দেওয়ায় লিকাইয়ের দ্বিতীয় স্বামী শিশুটিকে হিংসা করতে শুরু করেন। একদিন লিকাই ঘরে ছিলেন না। নৃশংস কাজ করে বসেন স্বামী। শিশুটিকে হত্যা করে তার মাংস রান্না করে আর মাথা ও হাড্ডি ছুড়ে ফেলেন। ক্লান্ত কা লিকাই ঘরে এসে ক্ষুধা অনুভব করেন। কিন্তু নিজের সন্তানকে আশ-পাশে খুঁজতেও থাকেন। একসময় ক্ষুধার তীব্রতায় রান্না করা মাংস খেয়ে নেন লিকাই। খাবারের পর কা লিকাইয়ের পান খাওয়ার অভ্যাস ছিলো। কিন্তু যেখানে সে সুপারি কাটতো সেখানে যেয়ে কিছু আঙুল পড়ে থাকতে দেখে।
কা লিকাই বুঝতে পারেন, কী ঘটেছে। দিগ্বিদিক হয়ে ছুটতে থাকেন লিকাই। হাতে ছিলো একটি কুঠার। সে মালভূমির একেবারে প্রান্তে পৌঁছে যায় ও ঝাঁপ দিয়ে সেই পুকুরে পড়েন।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৭, ২০১৭
এএটি/এমজেএফ