বহুভূজী দেওয়ালের তাকে তাকে বসানো বিগ্রহ গুচ্ছে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, পার্বতী, কৃষ্ণ, গণেশ, নারায়ণসহ অগণিত দেব-দেবীর মেলা। যেনোবা খাঁজ খাঁজ দেওয়ালের ভাঁজে পারিবারিক বৈঠকে বসেছেন দেবতারা।
মাঝের বিশাল চত্বরটার এক কোণায় পুরনো মন্দির। ওটার পাশ দিয়ে আর এক প্রস্থ সিঁড়ি বাইলে মূল মন্দির। উপরে প্রায় গোলাকার ফোঁকর দিয়ে আকাশ দেখা যায়। ভাসমান মেঘের নিচে ঝিরঝির বৃষ্টিও দেখা যায় এখান থেকে। কিন্তু ফোকরটা কি এক অদ্ভূত রকম বেঁকে থাকায় আকাশ দেখা গেলেও মেঘ গলা পানি কমই পড়ে গুহার মেঝেতে। ফোঁকর জুড়ে সবুজ গাছের দাপট। হুট করে মনে হবে বনের ফাঁকে আকাশ বুঝি।
বাঁধানো মেঝের ঠিক মাঝখানটায় মূল মন্দিরে মুরুগানের মূর্তি। চারপাশে দেওয়ালের খাঁজে খাঁজে জায়গা হয়ে গেছে প্রায় সব দেব-দেবীরই। একপাশে চার হাতের নানন্দিক মুদ্রায় নটরাজ নাচছেন। কবুতর আর মুরগি নির্ভয়ে খুঁটে খুঁটে খাবার খাচ্ছে মেঝেতে। গুহার বাইরে তো রীতিমতো বানর দলেরই দাপট। পূজারিদের আনা খাবারের কিছুটা তো ওরাও পাচ্ছে। এখানে আসা মানুষগুলো যে ক্ষতি করবে না তা বেশ বুঝে গেছে ওরা।
গুহাজুড়ে মুরুগানের গান অন্যরকম এক আবহের জন্ম দিয়েছে। সব মিলিয়ে প্রাগৈতিহাসিক এই গুহা যতোটা ধর্মীয় তীর্থ, তার চেয়েও বেশী ট্যুরিস্ট স্পট। পূজারি ছাড়াও নানা দেশের মানুষে তাই সরগরম বাতু কেভস। কেউ মালয়েশিয়ায় বেড়াতে গেলে তাদের ভ্রমণ তালিকায় এই স্পটটা থাকেই।
যদিও মূলত এটা তামিল ভাষী হিন্দুদের তীর্থস্থান। ৪০ কোটি বছর আগে প্রাকৃতিকভাবে গঠন হওয়া এ গুহায় একসময় বসবাস করতো তেমুয়ান নামে এক আদিবাসী গোষ্ঠী। ওরা ছিলো মালয়েশিয়ার আদিমানব ওরাং অ্যাসলিদেরই একটা অংশ। শেষ কবে ওরা এখানে ছিলো তা আর এখন নিশ্চিত করে বলার জো নেই। তবে উনিশ শতকে টিন খনিতে কাজ করতে আসা চাইনিজরা এ গুহার ইতিহাস একেবারেই ঘুরিয়ে দেয়।
সবজি চাষের জন্য সারের প্রয়োজনে চুনা পাথরের এ পাহাড়ে এখানে ওখানে খুঁড়তে থাকে তারা। এভাবে ১৮৬০ সালেই বাতু কেভের সন্ধান পেয়ে যায় চাইনিজরা। তবে মার্কিন প্রকৃতিবিদ উইলিয়াম হর্নাদে ১৮৭৮ সালে এ গুহার পরিচিতি ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেন।
১৮৯০ সালে ভেল আকৃতির গুহামুখ আবিষ্কার করেন ভারতীয় ব্যবসায়ী থাম্বুসামী পিল্লাই। এই ভেল মুরুগানের অস্ত্র হওয়ায় এখানে তার নামে মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু করেন তিনি। ১৮৯২ সালে শেষ হয় মন্দির নির্মাণ কাজ। ১৯২০ সালে কাঠের সিঁড়ি নির্মাণ হয় গুহায় ওঠার জন্য। এ শতকের শুরুতে কাঠের সিঁড়ির স্থলে বসে কংক্রিটের ২৭২টি সিঁড়ি।
সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা ১৪০ ফুট উঁচু মুরুগান মূর্তিটা ২০০৬ সালে গড়া। ২৪ মিলিয়ন ভারতীয় রূপী খরচে নির্মিত আকাশ ছোঁয়া মূর্তিটায় আছে ১৫৫০ ঘনফুট কংক্রিট আর ২৫০ টন স্টিলের বার। মূর্তিটাকে সোনারঙে মোড়াতে ৩শ’ লিটার গোল্ড পেইন্ট আনা হয় থাইল্যান্ড থেকে।
প্রতি তামিল থাই মাসে থাইপুসাম উৎসব হয় এখানে। জানুয়ারির শেষ ভাগ আর ফেব্রুয়ারির প্রথম ভাগ মিলিয়ে এই থাই মাস। তামিল মাস থাই এর সঙ্গে পোসাম নামে তারকা শব্দটি জুড়েই মূলত থাইপুসাম শব্দের উৎপত্তি।
থাই মাসের কোনো এক সময়ে পোসাম নামক তারকাটি সর্বোচ্চ উচ্চতায় উঠে যায়। একই সঙ্গে ওই দিন থাকে ভরা পূর্ণিমা। সে সময় উদযাপিত হয় থাইপুসাম উৎসব। এর মাধ্যমে সেই মুহূর্তটিকে স্মরণ করা হয় যখন দেবী পার্বতী তার সন্তান মুরুগানকে ভেল তুলে দেন অপশক্তি অসুরকে বধের জন্য।
এই দেবী পার্বতী আর শিবের সন্তানই মুরুগান। ভারতীয়রা যাকে চেনেন কার্তিক নামে। তিনি যুদ্ধ ও জয়ের দেবতা। দেবতাদের প্রধান সেনাপতি। এখানে গড়া আকাশ ছোঁয়া মূর্তিটি সারাবিশ্বের মধ্যেই মুরুগানের সর্বোচ্চ মূর্তি। মুরুগান বা কার্তিকের ১০ তীর্থের অন্যতম এই তীর্থ। তার ১০ তীর্থের ৬টিই ভারতে। বাকি ৪টি মালয়েশিয়ায়। এখানকার আইপোহ, পেনাং ও মালাক্কা শহরেও তীর্থ রয়েছে মুরুগানের।
থাইপুসাম উৎসবে শোভাযাত্রা এসে শেষ হয় বাতু কেভের সামনে। ভক্তরা তখন দুধ নিয়ে আসে মাটির বা কাঠের তৈরি গাবলার মতো দেখতে কাভাদিতে, পিঠের মধ্যে হুক বা শূল বেঁধে। কাভাদি আনার পর পূজার জন্য টেম্পল কেভে যায় ভক্তরা। বাতু কেভ এলাকা তখন হয়ে ওঠে লাখো মানুষের মিলনমেলা।
এই বাতু কেভের অবস্থান কুয়ালালামপুর শহর থেকে উত্তরে গমবাক জেলায়। কুয়ালালামপুর সিটি সেন্টার বা কেএলসিসি থেকে এখানকার দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার। ট্যাক্সিতে ভাড়া ওঠে ৪০ থেকে ৫০ রিঙ্গিত (১ রিঙ্গিতে ১৯ টাকা)। তবে রাঙালি অধ্যুষিত কোতারায়া থেকে বাসে এখানে আসতে ভাড়া পড়ে মাত্র আড়াই রিঙ্গিত। কেএল সেন্ট্রাল থেকে কমিউটার ট্রেনে প্রায় ৩ রিঙ্গিত ভাড়ায় এসে নামা যায় বাতু কেভ স্টেশনে।
ক্ল্যাং ভ্যালির অন্যতম বৃহৎ পাইকারি বাজার সেলায়াংও এর অবস্থান বাতু কেভ পাহাড়ের কাছেই। সুনগাই বাতু নামে একটি নদীও আছে পাহাড়ের ওপাশে। ওই নদীর নামেই বাতু কেভ নাম হয়ে যায় প্রাগৈতিহাসিক গুহাগুচ্ছের।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৮, ২০১৭
জেডএম/