ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

ডাকে নিঝুম দ্বীপ, ভেঙচি কাটে অবহেলিত সড়ক

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪২৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৭
ডাকে নিঝুম দ্বীপ, ভেঙচি কাটে অবহেলিত সড়ক নিঝুম দ্বীপের সৌন্দর্য হাতছানি দিয়ে ডাকলেও ভেঙচি কাটে যেন হাতিয়ার এই অবহেলিত সড়ক। ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

মেঘনা পার হয়ে সি-ট্রাক বঙ্গোপসাগরের ঈষৎ নোনা-জলে যখন এসে পড়লো, নিঃসঙ্গ গাঙচিলটি ছোট্ট মাছের জন্য জাহাজের পেছনে উড়ে উড়ে ক্লান্ত হয়ে ফেরার পথ ধরলো।

সকালের কুয়াশা মিলিয়ে গেছে আরো আগেই। সাগরের বিস্তৃত বুকে আচল বিছিয়ে দিয়েছে দিনের প্রথম আলো।

আধঘণ্টা বাদেই জাহাজ হাতিয়ার মাটি স্পর্শ করবে। পাশে বসে থাকা ইসমাইল চাচা জানালেন সে কথা। সেই আধঘণ্টা শেষ হতে আরো প্রায় সোয়া ঘণ্টা লেগে গেলো। জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে তিনি শুধু একটি চওড়া হাসি দিলেন। হাতিয়া ঘাটে নামতে নামতে বাজলো বেলা প্রায় সাড়ে ১১টা।  

মাইজদী চেয়ারম্যান ঘাট থেকে সহযাত্রী হয়েছেন ইসমাইল চাচা। মোটেই কয়েক ঘণ্টার পরিচয়। এরই মধ্যে যেনো লোকাল গার্ডিয়ান হয়ে উঠেছেন তিনি। হাতিয়া নেমে এলাকার আরো কয়েকজনকে নিয়ে ঢাকাবাসীদের অনেকটা কর্ডোন করে একটি খাবার হোটেলে ঢোকালেন। একরকম জোর করেই নাস্তা করালেন, চা পান করালেন। হাতিয়ায় এভাবে স্বাগত হয়ে নিজেকে আর ‘মুসাফির’ বলা যাচ্ছি না।  

তখনও দায়িত্ব ছেড়ে দেননি ইসমাইল চাচা। তিনিই নিঝুম দ্বীপ যাওয়া-আসার জন্য ঢাকাবাসীকে একটি মোটরসাইকেল ঠিক করে দিলেন। সারাদিনের জন্যই ওই মোটরসাইকেল চালক থাকবেন সঙ্গে। মোটামুটি সারাদিনের জন্যই নিশ্চিন্ত হওয়া গেল- অন্তত বাহন নিয়ে ভাবনা থাকলো না। বলে রাখা ভালো, হাতিয়া ও নিঝুম দ্বীপ দু’টিই মোটরসাইকেলে যোগাযোগ নির্ভর জনপদ। এছাড়া চলাচলের জন্য ব্যাটারিচালিত রিকশা ও বাস আছে। তবে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলের আধিক্য এখানে অনেক বেশি।  হাতিয়ার ফসলের মাঠ।  ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমচায়ে শেষ চুমুক দিয়েই মোটরসাইকেলে উঠে বসলাম। চালকসহ তিনজন হাতিয়ার বুক চিরে এগিয়ে চললাম নিঝুম দ্বীপের দিকে।  

ভুগোলে নজর দিলে দেখা যাবে, দেশের দুই প্রান্ত থেকে দু’টি নদী পদ্মা ও যমুনা দেশের ভূখণ্ডের প্রায় মধ্যভাগে এসে মিলিত হয়েছে গোয়ালন্দে। ভারতের আসাম, গৌহাটি, মেঘালয় হয়ে কুড়িগ্রাম-জামালপুরের বুক চিরে এগিয়ে আসা ব্রহ্মপুত্র গোয়ালন্দে পৌঁছেছে যমুনা হয়ে।

ভারতেরই বিহার-পশ্চিমবঙ্গ থেকে গঙ্গা হয়ে আসা নদী রাজশাহীতে ঢুকে পদ্মা নাম নিয়ে পাবনার বুক চিরে নেমেছে পদ্মায়। এই দুই নদীর মিলিত স্রোতধারা পদ্মা নামে আরও নিম্নগামী হয়ে চাঁদপুরে এসে মেঘনার সঙ্গে মিলে মেঘনা চূড়ান্ত নাম নিয়েই বঙ্গোপসাগরের বিশাল জলরাশিতে মিশে গেছে।  

নদীর বর্ণনা এ কারণেই যে, দেখে যেনো মনে হয় ওপর থেকে আসা তিনটি নদী তাদের শক্তির দাপটে হাতিয়াকে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে বঙ্গোপসাগরের বুকে নিক্ষেপ করেছে।  মেঘনার স্রোতধারা হাতিয়ার উত্তরে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে দুই দিক দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলেছে। হাতিয়া উত্তর-দক্ষিণে লম্বা একটি দ্বীপ, যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৭০ কি.মি. ও পূর্ব-পশ্চিমে কোথাও কোথাও ৩০ কি.মি। বর্গকিলোমিটার হিসাব করলে দেড় হাজারের কিছু বেশি।

হাতিয়া আর নিঝুম দ্বীপের প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম মোটরসাইকেল।  ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সেজন্যই যাত্রা আরো দক্ষিণে, প্রায় ৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ মোটরসাইকেল। এ পথের শেষ পানেই নিঝুম দ্বীপ। হাতিয়াকে মাঝে রেখে চলে গেছে এই সড়ক। হাতিয়া সদর থেকে জাহাজমারা ঘাট পর্যন্ত পাকা সড়ক মোটরসাইকেলে চলতে কোনো সমস্যাই হলো না।

দু’দিকে সবুজকে ভেদ করে এগিয়ে চলেছি নিঝুম দ্বীপের দিকে। যেখানে সবুজ নেই সেখানে কৃষকের সোনালী শস্যের ক্ষেত। সবুজ আর সোনালী মাঠের মধ্য দিয়েই সরল সড়ক পথ ধরে মোটরসাইকেল আরো এগিয়ে চললো। মাঝে মাঝে বাজার। প্রায় পুরো রাস্তার দু’পাশেই মানুষের বসত-বাড়ি, নয়তো ক্ষেত-খামার। বোঝা গেল, হাতিয়ায় লোক বসতি যথেষ্টই আছে। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব ২১৬ জন।

জাহাজমারা বাজার পর্যন্ত রাস্তা মোটামুটি ভালোই। কিন্তু এর পরই শুরু হলো খানাখন্দ। বাকি পুরোটা রাস্তা খানাখন্দে ভরপুর। মোটরসাইকেলের চাকাও সে খানাখন্দ এড়িয়ে যেতে পারে না। তাই সর্বোচ্চ গতি ৭ কিলোমিটারে নেমে এলো। জাহাজমারা পর্যন্ত আসতে লাগলো প্রায় দুই ঘণ্টা। কিন্তু বাকি ১৫ মিনিটের রাস্তা যেতে আরো একঘণ্টা লাগলো।  

স্থানীয় লোকজন এতে অভ্যস্ত। কিন্তু যারা মোটরসাইকেলের দীর্ঘ যাত্রায় অভ্যস্ত নন, তাদের জন্য এ পথ বড়ই কঠিন। এই কঠিনেরে ভালোবেসেই নিঝুম দ্বীপে যেতে হয়। পর্যটকদেরও পাড়ি দিতে হয় এ সড়ক। প্রতি স্পটে স্পটে বোঝা যায় সড়কটির ওপর অবহেলার ছাপ। ইটের রাস্তা মেরামত করার কোনো গরজ নেই, পিচ ঢালাতো দূরের কথা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি নেক নজর দেয়, তবে রাস্তা প্রাণ ফিরে পেতে পারে, এতে যাত্রী ও পর্যটকরাও একটু স্বস্তি পাবে।

হাতিয়ার পথ ঘাটও মোহিত করবে পর্যটককে।  ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমকিছুদূর এগিয়ে গিয়ে রাস্তা এবার ধান ক্ষেতের মধ্য দিয়ে সামনে যেতে শুরু করলো। ক্ষেতের মধ্য দিয়ে ইটের সড়ক এগিয়ে চললো মুক্তারিয়া ঘাটের দিকে। মুক্তারিয়া ঘাট পার হলেই নিঝুম দ্বীপ।  

ঘাটে এসে দেখা গেল, এই মোটরসাইকেলের আগে অন্তত আরো অর্ধশত মোটরসাইকেল এসে পৌঁছেছে। এসেছেন ১০০ যাত্রী। তারাও নিঝুম দ্বীপ যাবেন। বেশির ভাগই স্থানীয়। পযর্টক বলতে, মোটরসাইকেলের দু’জনই। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ ঘাট থেকেই মানুষ নিঝুম দ্বীপে যায়।  

যাত্রীদের আনাগোনা থাকায় রাস্তার দু’পাশে গড়ে উঠেছে ছোট কয়েকটি চায়ের দোকান, খাবার দোকান আর মুদির দোকান। নদীর ওপারে দৃষ্টি প্রসারিত করে তাকিয়ে অনুভূতি নেওয়ার চেষ্টা। ওই যে দূরে নদীর ওপারেই দেখা যায় স্বপ্নের দ্বীপ, সোনার হরিণের দ্বীপ- নিঝুম দ্বীপ।

বাংলাদেশ সময়: ১০১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৭
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।