কোনো এক অমোঘ আকর্ষণে মৃত্যু-ভয় তুচ্ছ করে আমরা এগিয়ে চলছি। চোখের সামনেই শিখর; কিন্তু শরীর এতোই ক্লান্ত যে পা আর চলতে চায় না।
পেম্বা উপর থেকে বলছেন, আবহাওয়া খারাপ হওয়ার আগেই নামতে হবে, তাড়াতাড়ি ওঠো। অবশেষে সকাল পৌনে নয়টায় আমি শিখরে উঠে আনন্দে পেম্বাকে জড়িয়ে ধরলাম। চোখে আনন্দাশ্রু ছল ছল করছে। কিছুক্ষণ পর নিশু শিখরে পা রাখলো। তারপর এলো নুর ও সজল। আমরা চারজন উপর-নিচে আগ-পিছ করে কোনোমতে ছবি তুললাম। শিখরে আর দাঁড়াবার জায়গা নেই, তাই বিপ্লবকে একটু নিচে দড়িতে ঝুলে থাকতে হলো। শিখরটুকু খুবই নড়বড়ে, যে-কোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে। পেম্বা তার আইস-অ্যাক্স দিয়ে রিজের বরফ ভেঙে কোনোমতে একজন বসতে পারে এমন একটি জায়গা তৈরি করেছেন। সেখানে বসে বুকপকেট থেকে জাতীয় পতাকা বের করে আইস-অ্যাক্সে বেঁধে উড়িয়ে দিলাম। গত দু‘বছর ধরে আমরা যে স্বপ্ন লালন করে আসছি আজ তা বাস্তবে পরিণত হলো। ’
দু’বারের এভারেস্ট আরোহণকারী প্রথম বাঙালি পর্বতারোহী এম এ মুহিতের কাছে এভারেস্ট আরোহণের চেয়েও গৌরবের এ পর্বত অভিযানটি।
বাংলানিউজের কাছে শিখর আরোহণের সে মুহূর্তটির বর্ণনা যখন দিচ্ছিলেন তার চোখে-মুখে বিশ্বজয়ীর হাসি। পৃথিবীর সব পর্বতারোহীর কাছেই অবিজিত কোনো চূড়ায় আরোহন করা সবচেয়ে গৌরবের। আর সেটি আরোহণের পর যদি চূড়াটির নাম চিরদিনের মতো নিজ দেশের নামে হয়ে যায়, সে গৌরবের মহিমা ছোঁয় আকাশের উচ্চতা।
২০১০ সালের ১৮ অক্টোবর বাংলাদেশি পর্বতারোহণের সবচেয়ে গৌরবের মুহূর্তটি এসেছিলো। ২০,৫২৮ ফুট (৬২৫৭ মিটার) উঁচু মাউন্ট চেকিগো নামের অবিজিত শিখরটি বাংলাদেশ-নেপাল ফ্রেন্ডশিপ পিক নামে নামকরণ হয়। দেশের অনেকেরই জানা নেই গৌরবময় এ ঘটনার কথা।
স্বপ্ন দেখা শুরু..
বিএমটিসির প্রতিষ্ঠাতা অ্যান্টার্কটিকা ও উত্তর-মেরু অভিযাত্রী প্রথম বাংলাদেশি অভিযাত্রী ইনাম আল হকের স্বপ্ন ছিলো হিমালয়ের কোনো চূড়ায় চিরদিনের জন্য বাংলাদেশের নামটি স্থাপন করা। ২০০৯ সালে আসে সে স্বপ্ন পূরণের সুযোগ। সবচেয়ে কম সময়ে এভারেস্ট আরোহণকারী শেরপা পেম্বা দর্জি কোনো অপারজেয় শৃঙ্গে দু’দেশের যৌথ অভিযানের প্রস্তাব দেন। এর আগে চীন ও জাপানের সঙ্গে এ ধরনের দু’টি সফল অভিযানে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু প্রক্রিয়াটি সহজ ছিলো না।
নেপাল মাউন্টেনিয়রিং অ্যাসোসিয়েশন এন এম একে এ ব্যাপারে চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু নেপালের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্য সে প্রস্তাবের তাৎক্ষণিক সম্মতি মেলেনি। হতাশ না হয়ে যোগাযোগ অব্যাহত রাখা হয়। অবশেষে ২০১০ সালের আগস্ট মাসে এনএমএ-সভাপতির কাছ থেকে প্রতীক্ষিত ই-মেইল পান ইনাম আল হক। এনএমএ-সভাপতি ‘জিম্বা জাংবু শেরপা’ লিখেছেন, নেপাল-তিব্বত সীমান্তে অবস্থিত ২০,৫২৮ ফুট (৬২৫৭ মিটার) উঁচু ‘চেকিগো’ নামের অবিজিত শিখরে বাংলাদেশ-নেপাল যৌথ অভিযান পরিচালনা করা যেতে পারে। এনএমএর তথ্যমতে চেকিগো শিখরে ইতোপূর্বে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ১৩টি অভিযান পরিচালিত হয়েছে, কিন্তু সবই ব্যর্থ।
প্রস্তুতি পর্ব
বাংলাদেশ থেকে ছয়জন ও নেপাল থেকে সাতজন অভিযাত্রীর অংশগ্রহণের পরিকল্পনা হলো। নেপালি দলের নেতৃত্ব দেবেন পেম্বা দর্জি শেরপা। বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দেবেন এম এ মুহিত। বাংলাদেশি দলের অপর সদস্য ছিলেন নিশাত মজুমদার, সাদিয়া সুলতানা সম্পা, সজল খালেদ, নুর মোহাম্মদ ও কাজী বাহলুল মজনু বিপ্লব। নেপালি দলের সদস্য ছিলেন মিংমা গ্যালজে শেরপা, দা-কিপা শেরপা,মিংমা দর্জি শেরপা, দাওয়া ইয়াংজুম শেরপা, সুস্মিতা মাসকে এবং নাওয়াং ফুটি শেরপা।
অভিযান হলো শুরু....
সে অভিযানের বর্ণনা দিচ্ছিলেন অভিযাত্রী এম এ মুহিত। ৮ অক্টোবর পৌঁছালাম ১২ হাজার ১৪০ ফুট উচ্চতার বেদিং গ্রামে। ১০ অক্টোবর সকাল ১০টায় আমরা বেদিং ছাড়লাম। আমাদের গন্তব্য বি-সি। বিকেল সোয়া-তিনটায় আমরা বি-সিতে পৌঁছালাম। আগামীকাল আমরা অ্যাডভান্সড বেস-ক্যাম্প (এ-বি-সি) যাব। ১১ অক্টোবর ২০১০। সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে আমাদের ট্রেকিং শুরু হলো। পথের এক জায়গায় চোখে পড়লো অজেয় চেকিগোর দু’টি মাথা। প্রায় তিন ঘণ্টা ট্রেকিং শেষে আমরা এ-বি-সি পৌঁছে গেলাম। এ-বি-সির উচ্চতা প্রায় ১৬ হাজার ৪শ ফুট।
১২ অক্টোবর থেকে আরও উপরে রুট ওপেনিংয়ের কাজ শুরু হলো। আবহাওয়ার মর্জির উপর নির্ভর করে উপরে খাড়া পথে দড়ি লাগানোর কাজ চলতে লাগলো। বিরূপ আবহাওয়া সত্ত্বেও ১৮ হাজার ৩৭০ ফুট উচ্চতায় হাই-ক্যাম্প স্থাপন করা হলো। ১৪ অক্টোবর নেওয়া হলো বিশ্রাম। ১৫ অক্টোবর ভোর ৫টায় ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে আমরা হাই ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। সুস্থ থাকলেও সম্পার হাঁটার গতি কিছুটা ধীর ছিলো। দলের সাফল্যের কথা চিন্তা করে সম্পা এ-বি-সিতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। এর মধ্যে প্রায় ৩০-৪০ ডিগ্রি ঢালে দড়ি ও জুমার ছাড়াই উঠতে হচ্ছিলো। হঠাৎ নিশুর চিৎকার শুনে চেয়ে দেখি বিপ্লব নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে এবং আইস-অ্যাক্স দিয়ে পতন ঠেকানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। আইস-অ্যাক্স দিয়ে একের পর এক হিমবাহে আঘাত করতে করতে অবশেষে বিপ্লব বড় ধরনের বিপদ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারলো।
চারিদিকে ক্রেভাস, হিমবাহে ফাটলের শেষ নেই। কখনও জিগ-জ্যাগভাবে দড়িতে জুমারের সাহায্যে আবার কখনও লাফ দিয়ে এ সব মৃত্যু-কূপ পার হচ্ছি। এরই মধ্যে ভারী তুষারপাত শুরু হয়ে গেলো বেলা পৌনে-তিনটায় আমরা হাই-ক্যাম্পে পৌঁছাতে সক্ষম হলাম। হাই-ক্যাম্পে মোট তিনটি তাঁবু পাতা হয়েছে। এক তাঁবুতে চারজন করে আমরা ১২ জন এখানেই বিশ্রাম করবো।
১৮ অক্টোবর ২০১০। রাত ১টার দিকে আমার ঘুম ভাঙলো। তাঁবুর উপর তুষার পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে না। তাঁবুর জিপার খুলে বাইরে তাকাতেই দেখি আকাশ তারায় ভরা। তাড়াতাড়ি তাঁবু থেকে বেরিয়ে এসে পেম্বাকে ঘুম থেকে জাগালাম। আবহাওয়া ভালো; যত দ্রুত সম্ভব চূড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করা উচিত। ঘুম থেকে উঠে সবাই দ্রুত তৈরি হতে থাকলো। ফ্রাইড-রাইস ও চা খেয়ে সবাই তাঁবুর বাইরে এসে দাঁড়ালাম। তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে। নেপালি দুই সদস্য সুস্মিতা ও ভুটিক অসুস্থতার জন্য হাই-ক্যাম্পে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। আমরা বাকি ১০ জন রাত ৩টায় হেড-লাইটের আলোতে শিখরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।
মৈত্রী শিখর....
২৫ অক্টোবর কাঠমান্ডুর পাঁচ তারকা হোটেল ‘ইয়াক অ্যান্ড ইয়েতি’-তে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নেপাল মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে চেকিগো পর্বত-শৃঙ্গের নাম ‘নেপাল-বাংলাদেশ মৈত্রী শিখর’ ঘোষিত হলো। বিএমটিসি-প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হক নেপাল-বাংলাদেশ মৈত্রী শিখরের স্মারক গ্রহণ করেন।
এ ঘটনাকে বাংলাদেশের পর্বারোহণের সবচেয়ে গৌরবময় বলে মনে করেন দেশের পবর্তারোহণের পথিকৃত ইনাম আল হক। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, পর্বতারোহী মাত্র জানেন একটি অবিজিত চূড়ায় আরোহণের মর্যাদা কতটুকু। আমরা সেই মর্যাদার ভাগীদার হয়েছি। এ প্রজন্মের অনেকেই এখন পর্বতারোহী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু তাদের অবশ্যই নতুন পথের পথিক হতে হবে। এভারেস্টে অনেকেই গিয়েছেন। এখন সময় হয়েছে নতুন নতুন চূড়া যেখানে আগে মানুষ কোনদিন পৌঁছাতে পারেনি সেসবে আরোহণের চেষ্টা করা। শুধু পর্বতারোহণ নয়, সব ধরনের অ্যাডভেঞ্চারে এখন নতুন পথের সন্ধান করার সময় হয়েছে বাংলাদেশি অভিযাত্রীদের। ’
যতদিন পৃথিবীতে হিমালয় থাকবে ততদিন বাংলাদেশের নামে এ পর্বতশৃঙ্গ থাকবে। হয়তো নবীন কোনো বাংলাদেশি অভিযাত্রী দল আবার এ চূড়ায় পা রেখে দৃপ্ত কণ্ঠেস্বৃতি চারণ করতে পারবে পূর্বসূরি অসীম সাহসীদের।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৭
এএ