ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

এক টুকরো আফ্রিকা (পর্ব ৩)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৭
এক টুকরো আফ্রিকা (পর্ব ৩) কেনিয়ার রুক্ষ পরিবেশ। ছবি: লেখক

কেনিয়ার কিউসো এলাকার প্রকৃতি ভীষণ বৈরী। আমরা সেখানে গিয়েছিলাম সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে। দীর্ঘ খরা শেষে ক্লান্ত প্রকৃতি বৃষ্টির অপেক্ষায় দিন গুনছে। এখানে দিনেরবেলা প্রচণ্ড তাপদাহ আর সন্ধ্যার পর থেকেই বইতে শুরু করে ঠাণ্ডা হাওয়া। ঠিক যেন মরু অঞ্চলের আবহাওয়া। 

রোদে জ্বলে যাওয়া প্রকৃতি ধূলার আস্তরণের নিচে ঢাকা পড়ে আছে। যতবার আমাদের গাড়ি পানিশূন্য নদীগুলোকে রাস্তা হিসেবে ব্যবহার করছিল, আমার বুক অজানা ব্যথায় মোচড় দিয়ে উঠছিল।

 

রুক্ষ কেনিয়ায় পানি সংগ্রহের চেষ্টা।  ছবি: লেখক এর মাঝেও কিউসোর প্রকৃতি সুন্দর। এখানে রয়েছে বিশাল পাথুরে পাহাড়। কেনিয়ার আরেকটি প্রত্যন্ত অঞ্চল মারালাতে যাওয়ার পথেও অদ্ভুত আকৃতির পাথুরে পাহাড় চোখে পড়েছে। এখানে সমতল এলাকাতেও মাটির নিচ থেকে শক্ত কালো পাথর মাথা বের করে থাকে। এই পাথর ব্যবহৃত হয় ঘরের দেয়াল তৈরিতে। পাথর কুঁদে তৈরি হয় নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী। তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা আদিবাসী জীবন এবং আফ্রিকার জঙ্গল ও পশু-পাখি শোভিত এসব সামগ্রী পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ।

পাহাড়ের উপর থেকে দিগন্ত বিস্তৃত মালভূমি দেখার অভিজ্ঞতাও ভুলবার নয়। সবচেয়ে বিস্ময়কর ছিল এ এলাকার বাতাস। দারুণ নির্মল আর শীতল বাতাস শরীরে শান্তির পরশ বুলিয়েছে। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে অল্প সবুজ পাতা অবশিষ্ট আছে এরকম একটা গাছের নিচে স্থানীয় অতিদরিদ্র মানুষের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলেছি। গনগনে সূর্যের তাপ আমাদের স্পর্শই করতে পারেনি। পুরো কেনিয়া সফরেই এখানকার দূষণমুক্ত মিষ্টি বাতাস আমাকে মোহিত করেছে।  

গবাদি পশুকে খাওয়াচ্ছেন রাখাল।  ছবি: লেখককিউসো ও তার আশপাশের এলাকা ভ্রমণের সময় আরেকটি অদেখার দেখা পেয়ে জীবন ধন্য হয়েছে, তার নাম বাওবাব গাছ। বাওবাব পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা এবং দীর্ঘজীবী প্রজাতির গাছ। এর রয়েছে প্রশস্ত কাণ্ড, যেখানে গাছটি প্রচুর পরিমাণ পানি ধারণ করে রাখে। কেনিয়াসহ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার শুষ্ক অঞ্চলে এই গাছ পাওয়া যায়। পশু-পাখির অন্যতম আশ্রয় বাওবাব গাছ আফ্রিকার আদিবাসী সংস্কৃতির সঙ্গেও ওতোপ্রোতভাবে জড়িত।  


এখানকার মানুষ ভীষণ আমুদে। বৈরী প্রকৃতিও অন্যের জমি চাষ, ঘর-বাড়ি তৈরি, জঙ্গল পরিষ্কার করা ইত্যাদি অনিয়মিত পেশায় শ্রমিকের কাজ করে খেয়ে না খেয়ে থাকা মানুষদের মুখের হাসি মুছতে পারে না। এই মানুষগুলোর শতচ্ছিন্ন পোশাক, আসবাবহীন এক রুমের ছোট্ট কুটির, অপরিচ্ছন্ন শরীর দেখে মনে হচ্ছিল বাংলাদেশ আসলেই দারিদ্র্য মোকাবেলায় অনেক এগিয়ে গেছে।

অফিসের প্রয়োজনে দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াই। এরকম দারিদ্র্য কোথাও চোখে পড়েনি। একটা পরিবারকে দেখেছি যারা জায়গার অভাবে তাদের পোশাক গাছে ঝুলিয়ে রাখে। আরেকটি পরিবার পেয়েছি যেখানে দুই বোন তাদের মা এবং ১৩ সন্তান নিয়ে দু’টো ছোট্ট কুটিরে ঠাসাঠাসি করে থাকে। কিন্তু মানুষ হিসেবে তারা সত্যিই অদম্য। শত প্রতিকূলতার পরও পরিশ্রম করেই চলেছে। সন্তানদের পড়ালেখার বিষয়ে খুব সচেতন। নারী-পুরুষ সমান তালে কাজ করে। নারীরা সাহসী আর স্বনির্ভর। তবে পরিবার ব্যবস্থা এখনো পুরুষ প্রধান।  

কেনিয়ান তরুণীর কোলে তার শিশুসন্তান।  ছবি: লেখক আগেই বলেছি এই এলাকায় ভীষণ পানির কষ্ট। মানুষ পানি কিনে ব্যবহার করে। একদিন ঘুম ঘুম সকালে গেলাম ওয়াটার পয়েন্ট দেখতে। এই ওয়াটার পয়েন্টগুলো সরকারের বসানো, বহুদূর থেকে লাইনের মাধ্যমে পানি টেনে এনে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় কল বসানো হয়েছে। প্রতিদিন পূর্বনির্ধারিত সময়ে সেই কল ছাড়া হয়। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ তাদের গৃহপালিত গরু, ছাগল, গাধা, উট নিয়ে আসে।  

পশুগুলোকে সেখানেই পাত্রে করে পানি দেওয়া হয়। পরের দিন সকালে একই জায়গায় আসার পর তারা আবার পানি পানের সুযোগ পাবে। স্থানীয় বাসিন্দারা  পানি জেরি ক্যানে ভরে গাধার পিঠে চাপিয়ে নিয়ে যায়। কিছু পরিমাণ বাসার জন্য রেখে বাকিটা বিক্রি করে। পানি বিক্রি প্রত্যন্ত অঞ্চলে অন্যতম একটি আয়মূলক কাজ।

কেনিয়ার আরেকটি প্রত্যন্ত অঞ্চল মারালাতে মারালা আদিবাসীগোষ্ঠীর বসবাস। সেখানেও এ বিষয়গুলো চোখে পড়েছে। দারিদ্র্য ও কাজের অভাবের কারণে পুরো কেনিয়া জুড়েই মহাজনদের দৌরাত্ম্য।

তবে এখানে মানুষ ভীষণ ঐক্যবদ্ধ, তারা একে অপরের খোঁজ রাখে, যেকোনো প্রয়োজনে সামর্থ্য অনুযায়ী সহায়তা করে। কেনিয়াতে যৌতুকের প্রচলন আছে, তবে তা আমাদের ঠিক উল্টো। ছেলেদের মেয়ের পরিবারকে গরু-ছাগল ইত্যাদি গৃহপালিত পশু দিতে হয়।  

কেনিয়ার সমাজে যার যত বেশি গরু থাকে সে তত বড়লোক। অতএব যে যত বেশি গরু যৌতুক দিতে পারে, সে তত ভালো বউ পায়। এখানে দ্বিতীয় বিয়েকে নিরুৎসাহিত করা হয়, আরও একবার যৌতুক দিতে পুরুষরাও তেমন আগ্রহী হয় না। তবে প্রচুর সিঙ্গেল মা পেয়েছি যারা একাই অনেকগুলো সন্তানের দায়িত্ব পালন করছেন। প্রথম পরিচয়ের সংকোচ এবং সময়ের স্বল্পতার কারণে এ বিষয়টির গভীরে যাওয়া সম্ভব হয়নি।  

কেনিয়ার রুক্ষ পরিবেশে লেখক।  তিন সংখ্যা জুড়ে শুধু মানুষ আর তাদের জীবন নিয়েই লিখলাম। এরপর বলবো সাফারির গল্প। তবে তা পরের পর্বে।  

উপমা মাহবুব
উন্নয়ন কর্মজীবী

আগের পর্ব
** 
এক টুকরো আফ্রিকা (পর্ব-১)
** এক টুকরো আফ্রিকা (পর্ব-২)

বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৭
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।