ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৩)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০০৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২০
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৩) পথে পথে

বাবর আলী। পেশায় একজন ডাক্তার। নেশা ভ্রমণ। তবে শুধু ভ্রমণ করেন না, ভ্রমণ মানে তার কাছে সচেতনতা বৃদ্ধিও। ভালোবাসেন ট্রেকিং, মানুষের সেবা করতে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের এই ডাক্তার হেঁটে ভ্রমণ করেছেন দেশের ৬৪ জেলা। সেটা আবার ৬৪ দিনে। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা? সেটা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন বাংলানিউজের ট্রাভেলার্স নোটবুকে। ৬৪ দিনে থাকবে ৬৪ দিনের ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা।

দিন ২৩

রামের কান্দি বাজার (নকলা, শেরপুর)-ময়মনসিংহ= ৩৮.০৯ কিমি

আগের দিনই বুঝে নিয়েছিলাম এই রাস্তাটা দারুণ উপভোগ্য হবে। গতকালের এগিয়ে রাখা পথটা অটোতে চেপে চলে এলাম।

রামের কান্দি বাজার থেকে দু'পায়ে পথচলা শুরু। হাঁটতে যখন শুরু করেছি তখন কুয়াশার বড় বড় ফোঁটা পড়তেই আছে টুপটাপ। সকালের নরম আলোতে মধ্য পোয়াভাগ পেরিয়ে ফুলপুর।

রামের কান্দি বাজারগাছের ফাঁক-ফোকড় গলে আসা সূর্যরশ্মির মোহময় রূপ দেখতে দেখতেই পথচলা। এসব দৃশ্য দু-চারবার ফোনের ক্যামেরায় আনার বৃথা চেষ্টা করে মানসপটেই এদের জায়গা দেওয়া শ্রেয় মনে হলো। খোকন দা অভিমত দিলেন গতকালের রাস্তাটা স্বর্গে যাওয়ার রাস্তা হলে এটা নিশ্চিতভাবে স্বর্গেরই রাস্তা।

বেলা আরেকটু বাড়তেই কিছু জায়গায় দেখলাম রাস্তা পুরোটা ভেজা। প্রথম দর্শনে মনে হয় এ জায়গায় খানিক আগেই একপশলা বৃষ্টি হয়েছে। কুয়াশার বড় বড় ফোঁটার অবদান সব৷ অল্প পরেই পিচঢালা রাস্তা ছেড়ে মাটির রাস্তায়। 'কই যাইবাইন?'- শীর্ষক প্রশ্ন শুনেই বুঝে নিলাম প্রবেশ করেছি ময়মনসিংহে৷ 

খড়িয়াপাড়া ভাইটকান্দি থেকে প্রবেশ করলাম ফুলপুর উপজেলায়। এদিকের লোকের প্রচুর কৌতূহল দেখলাম আমাদের নিয়ে। কেউ হাঁ করে দেখছে কিংবা কেউ অসীম কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ছে। খোকন দা আগেই বলে দিয়েছেন এই কদিন লোকের সব প্রশ্নের উত্তর উনিই দেবেন। উনি সেই দায়িত্ব বড় আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করে যাচ্ছেন। মানিকনগর বাজারের কাছে এসে মাথায় হাত। চা পানের বিরতি নিয়েছিলাম পথিমধ্যে। তারপর ভুলে গিয়েছি এন্ডোমন্ডো অ্যাপটাচালু করতে। গুগল ম্যাপের সাহায্যে দূরত্বটা নির্ণয় করে আবার পদযুগলের উপর ভরসা।

নারকেলী বাজারের মিনি সিনেমা হলএতক্ষণ লোকের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেও আসাম পাড়া হয়ে নারকেলী বাজারে এসে আমাদের দিকে কেউ ন্যূনতম মনোযোগও দিল না। গ্রাম্য কোনো ছোট বাজারে এরকমটা হয় না সাধারণত। বিচিত্র বেশভূষা নিয়ে হেঁটে আসা দু’জনকে কোনো প্রশ্নেরও সম্মুখীন হতে হলো না। এখানে সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু টিভিপর্দায় কারাতের কারিশমা দেখানো চিত্রনায়ক রুবেল। সবাই হাঁ করে রুবেলের বিচিত্র ভঙ্গির মারপিট দেখছে। এই বাজারের প্রত্যেকটা দোকান একেকটা মিনি সিনেমা হল। ছেলে-বুড়ো সবাই কারাতে মাস্টার রুবেলে মশগুল। খুব ছোটবেলায় আমি নিজেও তার ফ্যান ছিলাম। জয়া আহসানের সাম্প্রতিক সিনেমা কণ্ঠ দেখতে না পারার আফসোস রুবেলের সিনেমা দেখে খানিকটা প্রশমন করার চেষ্টা চালালাম।

চংপলাশিয়াচংপলাশিয়া পার হয়ে রাস্তার দু'ধারে শাপলা পেলাম বেশ অনেকগুলো। সাইকেলে বসা এক চাচা ইংরেজিতে জগাখিচুড়ি মিশিয়ে আমাদের বেশ কিছু প্রশ্ন করলেন। খোকনদা ঠাণ্ডা মাথায় উত্তর দিয়ে খুশি করতে চাইলেন ভদ্রলোককে। 'ইউ স্পিক নট গুড'- বলে ভদ্রলোক অদৃশ্য হলেন। এর মধ্যেই বেশ ক'বার ফোন করলো রেদোয়ান। ও আজও মাঝপথে যুক্ত হতে চায়। পরাণগঞ্জে এসে পুরি খেতে খেতে এক ছেলে আমাদের কাছে এটা-সেটা জানতে চাইলো।  

আজ কোথা থেকে শুরু করেছি, কোথায় যাবো ইত্যাদি। খোকন দা উত্তর দিলেন শেরপুরের নকলা থেকে শুরু করে আজ জয় বাংলা বাজার পর্যন্ত যাবো। সে উত্তর শুনেই ছেলে যথেষ্ট অবাক। তাকে আরো অবাক করার নিয়তে আজকের মূল গন্তব্য ময়মনসিংহের ব্যাপারে জানানো হলো। শুনে তার চক্ষু চড়কগাছ। পরে যখন খোকন দা তাকে জানালো আমি গত ২৩ দিন ধরে হাঁটছি, ততক্ষণে ওই ছেলের ঝুলে পড়া চোয়াল দেখতে পেলাম।

অম্বিকাগঞ্জ বাজারের পরপরই কড়ই গাছে ছাওয়া সুন্দর ছায়ামায় এক রাস্তা। কিছুদূর গিয়েই ডানে বাঁক ঘুরতেই মাটির পথ। এদিকে অনেকগুলা বাড়িতেই মিলছিল ঘোড়ার দেখা৷ ঘোড়া পোষাটা বেশ স্বাভাবিক ব্যাপার এদিকে। টানা হাসাদিয়া বাজার ছাড়িয়ে সিরতা বাজার থেকে যুক্ত হলো রেদোয়ান। ওকে আমাদের এই লোকেশন জানাতে রীতিমতো গলদঘর্ম হতে হয়েছিল।  

এদিকের বাজারগুলো ছোটখাট হওয়ায় গুগল ম্যাপে এর কোনো অস্তিত্বই পাওয়া যাচ্ছিল না। এমতাবস্থায় রেদোয়ানকে ঠিক কোথায় অপেক্ষা করতে বলবো সেটা নিয়ে বেগ পেতে হচ্ছিল। 'কোন কোম্পানির লোক আপনেরা?' - এহেন প্রশ্নের জবাবে খোকন দা দিলেন চমকপ্রদ উত্তর। বাবর অ্যান্ড ব্রাদার্স কোম্পানির নাম বলে দিলেন তিনি। খানিক এগিয়েই পিচঢালা রাস্তা শেষে ইটের সলিংয়ের রাস্তা। খোকন দা খানিকটা পিছিয়ে পড়েছিলেন আমার আর রেদোয়ানের তুলনায়। আমাদের এগিয়ে যেতে বলে জানালেন উনি ধীরে ধীরে আসবেন। আধা কিলোমিটার অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই মাটির রাস্তা। একজন হেঁটে যাওয়ার মতো সরু ট্রেইল ধরেই এগোনো। এ রাস্তা খানিকটা বান্দরবানের অনুভূতি জোগালো।

ব্রহ্মপূত্র নদবামে বিশাল ধানক্ষেত আর ডান পাশে কিছুটা দূরত্বে অল্প পানির ব্রহ্মপুত্র নদ৷ ক্ষেতের উপর দিয়ে মাঝে মধ্যেই মাথা উঁচিয়ে নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছে শহরের অট্টালিকাগুলো। নীরবে ঘোষণা করতে চাইছে শহর সন্নিকটে। এদিকের লোকেরা ভয়াবহ বামপন্থী! খাইবাম, যাইবাম, করবাম ইত্যাদি শব্দে এদের বামপন্থা প্রকাশ পাচ্ছে! 

ঘোড়সওয়ারপাশের বিলে এক দঙ্গল নারী-পুরুষকে সারা গায়ে কাদা মাখিয়ে মাছ ধরতে দেখা গেলো। চর জেলখানায় পেলাম দুই পিচ্চি ঘোড়াচালককে। গান গাইতে গাইতে ধূলা উড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো নিমিষেই। চরঈশ্বরদিয়া পার হয়ে পাওয়ার স্টেশন রোড। ব্রহ্মপুত্র নদের এই তীরে সব জায়গার নামে চরের উপস্থিতি লক্ষণীয়। আরো পেলাম চর কালিবাড়ী। লাল কুঠিবাড়ী দরবার শরীফের পরই নদী থেকে ড্রেজার দিয়ে তোলা বালির স্তূপ দেখলাম৷ বালি কম, প্লাস্টিকের পরিমাণ বেশি। ব্রহ্মপুত্র ব্রিজের খানিক আগে এগিয়ে এসে সঙ্গ দিলেন প্রান্ত ভাই আর তামিম ভাই। এটা-সেটা নিয়ে গল্প করতে করতে ব্রিজ পেরিয়ে ওপাশে।

হাঁটা শেষ করেই সিদ্ধান্ত নিলাম শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালাটা এক ফাঁকে ঘুরে আসবো। ততক্ষণে খোকন দাও চলে এসেছেন। প্রান্ত ভাই আর রেদোয়ান লোকাল গাইডের দায়িত্ব পালন করে শহরের এটা-ওটা চেনাচ্ছেন আর ধারাভাষ্য দিয়ে যাচ্ছেন। সংগ্রহশালার আগে পড়লো জয়নুল পার্ক। দারুণ গোছানো পার্কে প্রচুর মানুষের ভিড় এই শেষ বিকেলে। কপোত-কপোতীর সংখ্যাই বেশি। দারুণ সমৃদ্ধ সংগ্রহশালাটা দেখে মুগ্ধ। তবে পেন্সিল স্কেচগুলো সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কোনো একটা ত্রুটি আছে বলে মনে হল। স্কেচ আর তেলরংগুলো দিন দিন বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে বলে জানান দিলেন খোকন দা। বেরিয়ে পাশের গাছতলায় চায়ে চুমুক দিতে দিতে রেদোয়ান জানালো, কদিন আগেই ময়মনসিংহকে পলিথিনমুক্ত জেলা ঘোষণা করেছেন মেয়র। শহরের কোথাও এখন পলিথিন পাওয়া যায় না। এমনকি মাছ বিক্রেতারাও পলিথিন ব্যবহার করেন না। শুনেই মন ছেয়ে গেলো ভালোলাগায়।

ময়মনসিংহ মেডিক্যালের কাছেই দেখা হলো স্নিগ্ধ আর সোহানের সঙ্গে। স্নিগ্ধ থাকাতে হাঁটতে এসেও দৌড় নিয়ে প্রচুর কথা-বার্তা হলো অবধারিতভাবেই। ওর সঙ্গে প্রথম পরিচয়টা আমার খুব মনে আছে। বছরখানেক আগে আমাদের একটা ক্লাইম্বিং ওয়ার্কশপে এসেছিল ও। দেরিতে আসায় একাই বেশ কিছু পথ আসতে হয় তাকে। অচেনা ওই পথে পুরো পথ দৌড়ে এসেছিল সে। একটু পরেই আমাদের নিতে এলেন ছোটভাই ও এক্স কলিগ কাম ফ্ল্যাটমেট জুবায়েরের বাবা।  

আংকেল আসতেই ওনার পিছুপিছু ওনাদের চরপাড়ার বাড়িতে। প্রচুর গল্প হল ওনার সঙ্গে। চাকরিসূত্রে উনিও কম জায়গা ঘোরেননি। আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করছিলেন আগের জেলাগুলোর কথা। চট্টগ্রাম, কক্সবাজারে চাকরি করেছেন দীর্ঘদিন। সেসব নিয়ে স্মৃতিচারণের পর রাতে ভরপেট খাওয়া-দাওয়া। জুবায়ের আগে থেকেই বলে রেখেছিল আমি মিষ্টি খেতে পছন্দ করি। সেই সূত্রে খাবার শেষ হতেই চলে এলো বিখ্যাত মণ্ডা।

চলবে...

আরও পড়ুন>>

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২২)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২১)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২০)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৯)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৮)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৭)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৬)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৫)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৪)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১২)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১১)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১০)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৯)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৮)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৭)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৬)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৫)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (দিনাজপুর-৩)

পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (ঠাকুরগাঁও-২)

পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (পঞ্চগড়-১)

বাংলাদেশ সময়: ১৯০৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২০
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।