ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৭)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৪ ঘণ্টা, মার্চ ৪, ২০২০
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৭)

বাবর আলী। পেশায় একজন ডাক্তার। নেশা ভ্রমণ। তবে শুধু ভ্রমণ করেন না, ভ্রমণ মানে তার কাছে সচেতনতা বৃদ্ধিও। ভালোবাসেন ট্রেকিং, মানুষের সেবা করতে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের এই ডাক্তার হেঁটে ভ্রমণ করেছেন দেশের ৬৪ জেলা। সেটা আবার ৬৪ দিনে। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা? সেটা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন বাংলানিউজের ট্রাভেলার্স নোটবুকে। ৬৪ দিনে থাকবে ৬৪ দিনের ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা।

দিন ৩৭

আহলাদীপুর/গোয়ালন্দ মোড় (গোয়ালন্দ, রাজবাড়ি)-মধুখালী (ফরিদপুর) - মাগুরা= ৫০.১০ কিমি

নান্নু ভাইয়ের শ্বশুরালয়টা মহাসড়কের একদম লাগোয়া। রাতে ঘুমানোর সময়ভাবছিলাম মাঝরাতে না আবার গাড়ির হর্নে ঘুম ভেঙে যায়।

ক্লান্তিকে ধন্যবাদ। এই ক্লান্তির জন্যই মাঝরাতে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটেনি। সকালে বেশ তাড়াতাড়ি পথেনামার তাড়া থাকলেও নান্নু ভাইয়ের শাশুড়ির কারণে সেটা আর হলো না। নাশতা ছাড়াভদ্রমহিলা বেরোতেই দেবেন না।

খোকনদাকে বিদায় দিয়ে আহলাদীপুর তথা গোয়ালন্দমোড় থেকেই শুরু করলাম আজকের দিনের হাঁটা৷ মোড় থেকে একটা রাস্তা এগিয়েছেরাজবাড়ী অভিমুখে, অন্যটার গন্তব্য ফরিদপুর। আমি বামের ফরিদপুরগামী রাস্তাধরলাম। কিছুদূর পরপরই রাস্তার অনিন্দ্যসুন্দর সব বাঁক। আর বাঁকের শেষমাথাগুলো সুড়ঙ্গের শেষাংশ থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসা আলোর অনুভূতি দিচ্ছে। এসবদৃশ্যের কারণে হাঁটতে হাঁটতে ছবি না তুলে আজ ছবি তুলতে তুলতে হাঁটতেহচ্ছে।

মহাসড়ক ছেড়ে নিমতলার কাছ থেকে নেমে পড়লাম ছোট রাস্তায়। লোকালয়ের কাছেই দুটো প্রকাণ্ড ইটভাটা। থেকে থেকেই দেখা মিলছে ভ্যানের। উত্তরবঙ্গ ছাড়ার পর আজ আবারো ভ্যানে দেখলাম। ধুলদী জয়পুরের পরে পূর্বমহারাজাপুর। বসতবাড়ির একদম উঠোনে কবর দেওয়ার রীতিটা এদিকেও বেশ প্রচলিত। শেরপুরেও দেখেছিলাম এই রীতি। উদয়পুর ছাড়াতেই প্রচুর ছাত্র-ছাত্রী রাস্তাজুড়ে। আজ অবশ্য কারো কাঁধেই ব্যাগ নেই, তার বদলে স্বচ্ছ ফাইল কিংবা বক্স। বুঝলাম স্কুলগুলোতে শুরু হয়ে গেছে বার্ষিক পরীক্ষা।

ঘোর লাগা ভোর।  ছবি: বাংলানিউজ

ঘোড়াচালিত যাত্রীবাহীগাড়ির দেখা হরহামেশা মিললেও ঘোড়াচালিত মাল টানার গাড়ি এদিকে বেশি। রাজাপুর হয়ে ধর্মশী পার হতেই কমে গেলো লোকালয়। দু’পাশে এখন বিশাল সব বিল। এসববিলে ধান চাষ হয় না, চাষ হয় নানান রকম সবজির।

রাজবাড়ী সদর উপজেলারশেষ সীমানা কৈজুরী বাজার। বেলেশ্বর বাজার থেকে ঢুকে পড়লাম ফরিদপুর জেলায়। উপজেলার নাম মধুখালী। এই উপজেলায় প্রচুর গরু-ছাগল পালন হয়। রাস্তা দিয়েহাঁটতে গিয়ে হাম্বা,ম্যা ডাকে কানে তালা লাগার জোগাড়। ব্যাসদী পাড়া অতিক্রমকরার পর থেকে হাঁটার আর জো নেই৷ রাস্তার একপাশে গর্ত খুঁড়ে রাখা আরঅন্যপাশে রাখা আছে অবিন্যস্ত খোয়া৷ নানান সবজি ক্ষেত ছাড়াও আখক্ষেত আছেপ্রচুর৷ ভাটিকান্দী মথুরাপুর পার হয়ে মধুখালী সদরের কাছেই ফরিদপুর চিনিকল৷আমার ধারণা ছিল দেশের সব চিনিকল বুঝি উত্তরবঙ্গেই। চিনিকলের জীর্ণকোয়ার্টারগুলো পেরিয়ে আকাশনি গাছে ঘেরা ছোট রাস্তা ধরে মধুখালী। কেয়া আপুঅপেক্ষা করছিলেন মধুখালী থানার সামনেই। হাঁটার জন্য ফরিদপুর থেকে চলেএসেছেন উনি।

আবার যাত্রা শুরুর আগে এক কাপ চায়ে চুমুক দিয়ে নামলামপথে। বেশ কিছুক্ষণ দিন-দুনিয়া, চিকিৎসা পেশা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনার পরেকোড়কদী বাজারের কাছ থেকে বিদায় নিলেন উনি। রাস্তার পাশে পাটখড়ি জমিয়ে জমিয়েবানিয়েছে পাটখড়ির বিশাল স্তূপ। এইদিকের ভ্যানগুলো শুধু যাত্রী পরিবহনেরকাজ করে না। বেশির ভাগই ব্যবহার করা হয় অন্য কাজে। ডাক্তারের প্রচারণা, ব্রয়লার মুরগির মূল্য হ্রাস, এনার্জি লাইট ইত্যাদি কাজেই ভ্যানের ব্যবহারবেশি। এরকমই এক ভ্যানে বসা দুই যাত্রী আমাকে দেখে নিজেদের কথোপকথনে আমাকেসন্দেহভাজন রোহিঙ্গা হিসেবে অভিহিত করল। লোকে কত সহজেই কোনো কিছু নাজেনে-বুঝে আরেকজনকে বিচার করে ফেলতে পারে।

রাস্তা তো নয় যেন টানেল।  ছবি: বাংলানিউজ

মধ্য আড়পাড়া হয়ে আবারমহাসড়কে আসলাম আড়াইটা নাগাদ। কামারখালীর পরেই গড়াই সেতুর টোল প্লাজা। সেতুরএত আগে কোনো টোলপ্লাজা সাধারণত চোখে পড়ে না। দুপুরে খেতে বসে কানে আসছিলদুই ট্রাক ডাইভারের কথোপকথন। একজন এখনো ভাড়ার গাড়ি চালালেও অন্যজনকোম্পানির গাড়ি চালায়। এক ড্রাইভার কোম্পানিতে নানান সুযোগ-সুবিধার কথাব্যাখ্যা করলেও অন্যজন উত্তর দিল 'কারো কমান্ড শুনতে পারবি না নে। '

পাটবোঝাই ভ্যান খানিক বাদে বাদে অতিক্রম করছে। রাজধরপুর পার থেকেই মধুমতি নদী। এই নদীর উপর নির্মিত সেতুর নাম আবার গড়াই সেতু। স্থানীয়রা বলে আবারকামারখালী সেতু। একই অঙ্গে কত যে রূপ! নদীর মাঝে জেগেছে চর। আর তার পাশেইহাঁটু পানিতে হ্যান্ডবল টাইপ কি যেন খেলা খেলছে বেশ ক'জন তরুণ। আর কজনব্যস্ত মাঝনদীতে বিচিত্র ভঙ্গিতে সেলফি তুলতে। সেতুর উপর থেকে এসব দৃশ্যদেখতে দেখতে সেতু পার হয়েই মাগুরা জেলা। সেতু লাগোয়া উপজেলার নাম শ্রীপুর।

মাঝনদীতে জেগেছে চর।  ছবি: বাংলানিউজ

শ্রীপুরে মনে হলো ভ্যানের সংখ্যা আরো খানিকটা বেশি। এদিকের প্রথম বড় বাজারপড়ল ওয়াপদা বাজার। বাজার পেরিয়ে কড়ই গাছে ছাওয়া দারুণ একটা রাস্তা। বিশালএক কড়ই গাছের নিচে হাইওয়ে পুলিশের বেশ ক'জন সদস্য৷ ওদের অতিক্রম করারসময়েই থামানো হলো একটি ট্রাক। ট্রাকের হেল্পারের হাত বাড়িয়ে করমর্দন করেপুলিশের হাতে হাদিয়া গুঁজে দেওয়ার দৃশ্য দেখলাম ফুট পাঁচেক দূরত্বে থেকেই। কছুন্দি বাজার থেকে প্রবেশ করলাম সদর উপজেলায়। ভিক্ষুক ও বাল্য বিবাহমুক্তঘোষণা করা হয়েছে এই উপজেলাকে।

একটা সাইনবোর্ড জানাচ্ছে তেমনটাই। বেলনগর হয়েচলে এলাম পারনান্দুয়ালী। আরেকটু এগিয়ে বাসটার্মিনাল। ব্যাপারী পাড়ার কাছেমহাসড়ক ছেড়ে মোড় নিলাম ডানে। খানিক যেতেই নবগঙ্গা নদী। নদীর ওপার থেকেশহরটাকে লাগছে সাঙ্গু ব্রিজ লাগোয়া বান্দরবান শহরের মতো৷ নদীর কূল সংলগ্নরাস্তা ধরে হেঁটে শহরের মূল কেন্দ্র চৌরঙ্গীতে পৌঁছে দিনের ইতি টানলাম।

ফোন দিলাম সজীব ভাইকে। উনি বললেন চৌরঙ্গী মোড়ের হোটেল চৌরঙ্গীতেই থাকারব্যবস্থা করেছেন উনি। হোটেলে থাকতে হবে শুনে আমার মন খানিকটা খারাপ হলো। এইপুরো যাত্রায় একবারও হোটেলে থাকিনি। সজীব ভাই বুঝতে পেরে বললেন এটা ওনারআপন মামার হোটেল। এখানে কোনো অসুবিধাই হবে না। হোটেলের সব কর্মচারীকে আমারব্যাপারে বলে দেওয়া আছে। হোটেলে ঢুকে ফ্রেশ হওয়ার আগেই ম্যানেজার সাহেবকেদিয়ে খাবার পাঠিয়ে দিয়েছেন সজীব ভাই।

মাগুরা সদর উপজেলা।  ছবি: বাংলানিউজ

ম্যানেজার একটু বাদে বাদেই খোঁজনিচ্ছেন কিছু লাগবে কিনা। এখানের এই খাবার ভালো, ওখানের ওটা এসব তথ্যদিয়েই যাচ্ছিলেন। এ তো দেখি বাড়ির থেকেও বেশি খাতিরদারি হচ্ছে। একটু পরেইসজীব ভাইয়ের বড় ভাই সাহারুল ভাই চলে এলেন বাইক নিয়ে। প্রথমেই দু-তিন চক্করেমাগুরা শহর দেখা হয়ে গেলো। শীতের পিঠা খাওয়াতে কাছেই এক দোকানে নিয়ে গেলেন। ভরপেট রাতের খাবার খাওয়া সত্ত্বেও চিতই আর ভাপা পিঠা দেখে লোভ সামলানো গেলোনা। বাইকে চক্কর দিতেই দেখা হয়ে গেলো সাহারুল ভাইয়ের সিনিয়র এক ভাইয়ের সঙ্গে। উনি বাসায় নিয়ে গেলেন ওনার বাবার সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে দেবেন বলে।

পরিচয় হলোআবু নাসির বাবলু চাচার সঙ্গে। উনি বর্তমানে সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। সত্তরের উপর বয়স হয়ে গেলেও বেশ বলিষ্ঠ কণ্ঠ। আমার উদ্দেশ্য শুনে দারুণউৎসাহ দিলেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেককিছু জিজ্ঞেস করলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ওনার হেঁটে ভারতের বনগাঁ যাওয়ার গল্প শুনে বেশ রোমাঞ্চিত হলাম। মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলার সময় তার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসা আলোর ঝলকানি অনেকদিনমনে থাকবে।

চলবে...

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৫)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩০)​
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৬)​
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (দিনাজপুর-৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (ঠাকুরগাঁও-২)

পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (পঞ্চগড়-১)

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৩ ঘণ্টা, মার্চ ০৪, ২০২০
এএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।