ঢাকা, বুধবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আগরতলা

হারিয়ে যাচ্ছে ত্রিপুরার তারানগরের ঐতিহ্যের তাঁতশিল্প

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১৭
হারিয়ে যাচ্ছে ত্রিপুরার তারানগরের ঐতিহ্যের তাঁতশিল্প জীর্ণ দশায় তারানগরের তাঁত শিল্প

ত্রিপুরার পশ্চিম জেলার মোহনপুর মহকুমার তারানগর গ্রামে যাওয়ার পথে অনেকটা দূর থেকেই তাঁতের ঠক ঠক আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়। গ্রামটিতে প্রায় ৫শ’ তাঁতির বসবাস। গ্রামের প্রায় দুই হাজারেরও বেশি মানুষ এক সময় তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তারানগরের তাঁতের কাপড়ের কদর এলাকার গণ্ডি ছাড়িয়ে গোটা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা হারিয়ে যেতে বসেছে।

আগে গ্রামটিতে দুই হাজারেরও বেশি মানুষ তাঁতের কাজ করলেও বর্তমানে মাত্র ৫শ’ তাঁতি এ পেশায় যুক্ত রয়েছেন। বাকিরা ঐতিহ্যগত এ পেশা পেশা ছেড়ে যুক্ত হয়ে পড়ছেন বিভিন্ন কাজে।

একটা সময় দিন-রাত তাঁতিদের কর্মব্যস্ততায় গমগম করতো পুরো তারানগর। এখন নেই সেই কর্মচাঞ্চল্য, তবে তাঁতি বাড়িতে গেলে দেখা যায় রংবেরঙের সুতা, কাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে। এখনও শুনতে পাওয়া যায় তাঁতের ঠক ঠক আওয়াজ। তবে এখন আর এই রঙিন সুতা যেন আর রঙিন স্বপ্ন বোনে না তাঁতির চোখে। তাঁতগুলি যেন জীবনের গান ভুলে এখন গায় শোকগাথা!

কাপড়ের সঙ্গে রঙিন স্বপ্ন বোনা তাঁতিদের জীবনে কেন এই দুরবস্থা নেমে এলো? বাংলানিউজের এমন প্রশ্নের জবাবে বারান্দায় বসে চরকা ঘুরাতে ঘুরাতে বেলা দেবনাথ জানান, তাঁত কাজে এখন আর লাভ নেই, নেই কোনো সরকারি সহায়তা। এ কারণে পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকেই। আর যারা এখনও টিকে আছেন তারা বেসরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কোনো মতে তাঁত কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
জীর্ণ দশায় তারানগরের তাঁত শিল্পতাঁতের কাপড়ের চাহিদা দিন দিন কমে যাচ্ছে কেন প্রশ্নে জবাবে তাঁত শ্রমিক বাবুল দেবনাথ জানান, এখন সব কাপড় তৈরি হয় যন্ত্রচালিত তাঁতে, যন্ত্রচালিত তাঁতের তৈরি কাপড়ের মতো ফিনিশিং হস্তচালিত তাঁতের কাপড়ে হয় না। এ কারণে মানুষ তাঁতের কাপড় থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। তবে আদিবাসী মানুষের মধ্যে এখনও কিছুটা তাঁতের কাপড়ের চাহিদা রয়েছে তাই অনেক তাঁতি শাড়ি বা গামছার মতো কাপড় তৈরি করা ছেড়ে দিয়ে আদিবাসীদের চিরাচরিত কাপড় বুনছেন।

কাপড় তৈরির পাশাপাশি তাঁতিরা চিকিৎসার প্রয়োজনীয় গজ কাপড়ও তৈরি করেন। কিন্তু এক্ষেত্রেও সমস্যা রয়েছে। কাপড় নিয়ে যাওয়ার পর দীর্ঘদিন পাওয়া যায় না বরাতের মূল্য, আবার অনেক সময় গজ কাপড় তৈরির অর্ডার দিয়ে পরে তা নেয় না। ফলে এই ব্যান্ডেজের জন্য তৈরি গজ কাপড় ঘরে পচে নষ্ট হচ্ছে বলেও জানান বাবুল দেবনাথ।
জীর্ণ দশায় তারানগরের তাঁতশিল্প
তাঁত শিল্পের যখন দুরবস্থার সূত্রপাত তখন তারা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে এই শিল্পকে বাঁচাতে এবং তাঁতিরা যাতে তাদের উৎপাদিত কাপড় সঠিকভাবে বিপণন করতে পারে সেজন্য ১৯৭৯ সালে তৈরি করা হয়েছিল ‘তারানগর তাঁত সমবায় সমিতি লিমিটেড’। কিন্তু এই সমিতিও তাঁতিদের সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। সমিতি কুক্ষিগত হয়ে আছে কয়েকজন ক্ষমতাবানের হাতে। ফলে উল্টো সমিতির কাছে অনেক তাঁতির পাওনা জমে আছে এমনটা অভিযোগ তারানগরের তাঁত শ্রমিকদের।

৬৫  বছর বয়সী গৌরাঙ্গ দেবনাথ গত প্রায় ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে তাঁতের কাপড় বুনছেন। তিনি জানান, প্রতিদিন খুব বেশি কাজ করলে দুটি কাপড় তৈরি করা যায়, রুপির হিসেবে ২শ’ রুপি দৈনিক রোজগারও কষ্টকর হয়ে পড়েছে। তাই পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

মুনাফ‍া কমে যাওয়ায় তরুণ প্রজন্মের কেউ তাঁতের পেশায় আসতে চায় না, অভিভাবকর‍াও চান না অনিশ্চিত ভবিষ্যতের এই কাজে জড়িয়ে পড়ুক ছেলে-মেয়েরা। সব মিলিয়ে এক সময়ের তাঁত শিল্পের জমজমাট এলাকা তারানগর কেবলই ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিতে চলেছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৫০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১৭
এসসিএন/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।