ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

শুক্রবারের বিশেষ প্রতিবেদন

দত্তপাড়ার মিষ্টি পান ঠোঁট রাঙাচ্ছে সৌদিতে

আসিফ আজিজ ও শুভ্রনীল সাগর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৫৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০১৬
দত্তপাড়ার মিষ্টি পান ঠোঁট রাঙাচ্ছে সৌদিতে শুভ্রনীল সাগর/ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

দত্তপাড়া (নাটোর) থেকে ফিরে: গ্রামের নাম গোকুলনগর। নাটোর থেকে ঢাকা-রাজশাহী হাইওয়ে ধরে চার কিলোমিটার পাড়ি দিলেই হালশা ইউনিয়নের গ্রাম দত্তপাড়া।

মোড় থেকে উত্তরদিকে ঢুকে যাওয়া পাকা সড়ক ধরে দু’কিলোমিটার গেলেই পানের রাজ্য। দত্তপাড়া-গোকুলনগরজুড়ে অন্তত শ’পাঁচেক পরিবারের রুটি-রুজি পাটকাঠিঘেরা ছায়াঘর। রোদ সেখানে শুধু লুকোচুরিই খেলে।

মধুকবির ‘বরজে সজারু পশি বারুইর যথা’র কাল এখন আর নেই। বরজে সজারু ঢোকে না বটে, বারুইকে (পান ব্যবসায়ী) ভয়েও থাকতে হয় না অসাবধানতায় কাঁটা বেঁধার। তবে পান আছে। শুধু আছে বললে ভুল হবে, দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে পাড়ি জমিয়েছে সুদূর সৌদিতে। সেখানে বড় বড় মিষ্টি পান ঠোঁট রাঙাচ্ছে আরবের শেখদের।

যদিও সৌদি আরবেই এখন পানের ব্যাপক চাষ। মধ্যপ্রাচ্যের আর সব দেশে মূল পানের সাপ্লাই সৌদি থেকেই যায়। কিন্তু নিজেদের উৎপাদিত পানের চেয়ে বাংলায় উৎপাদিত পানই নিজেরা খেতে পছন্দ করে তারা।

ভোরে বসবে উত্তরাঞ্চলের বিখ্যাত গোকুলনগর-দত্তপাড়ার পানের হাট। তাই আলো ফোটার পরেই রওয়ানা হওয়া। হাড়কাঁপুনি শীতে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় চেপে সোজা দত্তপাড়া। হাটে তখন পান আসতে শুরু করেছে। হাট জমতে জমতেই ঢুঁ মারা গোকুলনগরে। রাস্তার পাশে অন্ধকারাচ্ছন্ন পাটকাঠি ঘেরা ঘর। বুঝতে অসুবিধা হলো না এটিই বরজ, যেখানে পান জন্মায় অতি যত্নে।

পান লতাজাতীয় গাছ। তাই আঁকড়ে ধরে উপরপানে যাওয়ার জন্য মাটিতে গাঁথা বাঁশ-কঞ্চি। কঞ্চি বেয়ে ওঠা পান সারি সারি। আকাশ দেখার সুযোগ নেই তাদের। কারণ পানের জন্য ছায়া আবশ্যক।

নাকে মিষ্টি পানের ঘ্রাণ নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই দত্তপাড়া হাটে। ততক্ষণে জমে উঠেছে বিকিকিনির হাঁকডাক। ছোটবড় আটটি আড়ৎ এখানে। প্রতি ‍আড়তে আবার কয়েকজন করে আড়তদার বা মহাজন। একজন হিসাব লিখছেন তো আরেকজন কথা চালিয়ে যাচ্ছেন বিক্রেতার সঙ্গে। কেউ আবার ব্যস্ত সৌদিতে রপ্তানির জন্য হাটের সেরা পান বাছাইয়ে।

কথা বলার ফুরসৎ নেই কারও। তবু ঢাকা থেকে এসেছি শুনে আড়তদার আতাউর সব ঘুরিয়ে দেখালেন, জানালেন। হাটের বিশেষত্ব জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানকার পান মিষ্টি। মানে ঝাঁঝ কম। চুন না হলেও চলে। আর বাছাই করা বড় পান যায় সুদূর সৌদি আরবে।

আতাউরের মতো আড়তদার এখানে প্রায় ৭০-৭৫ জন। আড়ত আছে আটটি। হাট বসে সপ্তাহের পাঁচদিন। সকাল ৭টা থেকে চলে দুপুর ২টা পর্যন্ত। এছাড়া শুক্র ও সোমবার গোকুলনগরে বসে মোকাম। একসময় দত্তপাড়া, গোকুলনগরের পানই শুধু এখানে বিকিকিনি হতো। তবে এখন দুর্গাপুর, বাগমারা, ভবানিগঞ্জ, তাহেরপুর, মোহনপুর, নাজিরপুর থেকেও পান আসে।

সৌদি আরবে পান রপ্তানি হয় শুনে বিশেষ আগ্রহ জাগলো। জানতে চাইলাম কীভাবে কোন পানগুলো সৌদিতে যায়। আতাউর বললেন, সৌদিতে যে পান যায় সেগুলোর ক্রেতা আসেন ঢাকার শ্যামবাজার থেকে। প্রথমে মোকাম বা হাটের সবচেয়ে বড় ও ফ্রেশ দাগমুক্ত পান বাছাই করা হয়। তারপর সেগুলো বিশেষভাবে কলাপাতা মুড়ে নিয়ে যান ক্রেতারা।

পুরো হাট ঘুরে দেখা গেলো, কয়েক ধাপে চলছে পান যাচাই-বাছাই ও বিকিকিনির প্রক্রিয়া।

প্রতিটি আড়তের রয়েছে আলাদা খোলা ঘর। পাইকারি বিক্রেতারা আড়তে পান এনে পাইকারি দরে বিক্রি করেন। কেনার আগে পোয়া (২৮ বিড়ায় ১ পোয়া) খুলে দেখা হয় পানের মান, আকার। সে অনুযায়ী নির্ধারণ করা হয় দাম। পানগুলো পোয়ায় সাজানো থাকে বিড়া (৬৪টি পানে ১ বিড়া) হিসেবে। পাইকাররা একসঙ্গে ৩ থেকে ৮-১০ বিড়া পান এক গাঁটিতে বেঁধে বাজারে আনেন।

দত্তপাড়ার এ পান প্রধানত যায় ঢাকা, রংপুর, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, শেরপুর, কক্সবাজার প্রভৃতি জেলায়। তবে সৌদিতে রপ্তানির জন্য ঢাকার শ্যামবাজার থেকে বড় পার্টি আসেন, জানান আতাউর। এছাড়া কক্সবাজার পানের বড় খরিদ্দার বলেও জানান তিনি।

পানের দাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, সৌদি আরবে যে পান যায় সেগুলো প্রতি বিড়া পাইকারি বিক্রি হয় ১৫০-৬০ টাকা। তবে মৌসুম ভেদে দাম কমবেশি হয়। এখন কিছুটা বেশি। এছাড়া পানের মান, আকার অনাযায়ী বিড়া প্রতি বিক্রি হয় ৩০ থেকে ১৫০-৬০ টাকা। পচে গেলে বা দাগ পড়লে দাম আরও কমে যায়।

আতাউর আরও জানান, প্রতিদিন এখানে ৮-১০ লাখ টাকার লেনদেন হয়। প্রতি আড়তে বিকিকিনি হয় দেড় থেকে আড়াই-তিন লাখ টাকা পর্যন্ত।

বাজার ঘুরতে ঘুরতে দেখা হলো পানচাষি মো. সালাম মণ্ডলের সঙ্গে। তিনি এসেছেন তাহেরপুর থেকে। দুটি বরজ আছে তার। প্রতিটি ১০ শতক জমির উপর। চাষ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পান চাষের জন্য প্রধানত একটু উঁচু জমি প্রয়োজন হয়। আশ্বিন-কার্তিক মাসের দিকে লাগানো হয় চারা। গাছ লাগানোর ১১ মাস পর থেকে পান সংগ্রহ করা যায়। পরিবেশ অনুকূলে থাকলে একটি গাছ অনেকদিন পর্যন্ত বাঁচে।

খরচ এবং লাভ সম্পর্কে তিনি জানান, একটি বরজের জন্য তার খরচ হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া আর কোনো খরচ নেই। খরচ শুধু পান তোলা, বহন প্রভৃতি কাজে। সপ্তাহে তিনি দুটি বরজ থেকে ১৫-২০ হাজার পান বিক্রি করতে পারেন। দামের ওঠা-নামা হয়। এভাবে মাসে তার আয় হয় ৭০ হাজার থেকে একলাখ টাকা পর্যন্ত।

এ এলাকার পান মিষ্টি বলেই দেশব্যাপী আলাদা সুনাম ও চাহিদা রয়েছে বলে জানান তিনি।

রংপুর থেকে দত্তপাড়ায় পান কিনতে এসেছেন খুচরা বিক্রেতা সোহেল। তবে একটু বেশি কিনে কিছু পান পাইকারি দরেও ছেড়ে দেবেন বলে জানান তিনি।

খুচরা পানের বাজার সম্পর্কে তিনি বলেন, যেদিন বাজারে অন্য মোকামের পান বেশি আসে বা কম দামে ঢুকে সেদিন আমারে লস হ’য়ে যায়। এমনিতে দত্তপাড়ার মিষ্টি পানের চাহিদা বেশি। যারা এ’কবার এ পান খাছে তারা অন্য পান সোহজে খা’তে চাবি না।

পানের এ বিকিকিনির রয়েছে কয়েকটি ধাপ। শেষ ধাপ হলো ডাক (নিলাম বলা যায়)। এর আগে প্রথমে পানের পোয়া আসে দত্তপাড়া হাটে। সেগুলো পাইকাররা বিক্রি করেন আড়তে। আড়তদাররা ওই দিনের সব পান কেনা হয়ে গেলে ডাকে তোলেন। প্রতি পোয়া পানের একটি বেজ দাম ধরা হয়। সেই দামের ওপর শুরু হয় ডাক। খুচরা ক্রেতাদের প্রতি ডাকে ন্যূনতম ১০ টাকা বাড়াতে হয়। এভাবে যে সবচেয়ে বেশি দাম দিতে পারে পান বিক্রি হয় তার কাছে।

ডাক শেষ হলে পান সুন্দর করে বিড়া হিসেবে গুনে পোয়া তৈরি করা হয়। কয়েক পোয়া মিলে হয় একটি আঁটি। পোয়াগুলো প্রথমে কলা অথবা কচু পাতা দিয়ে মুড়ে বাঁধা হয়। পান যেন শুকিয়ে না যায় সেজন্য ছিঁটানো হয় হালকা পানি। সবশেষে বাঁধা হয় কাপড় দিয়ে পোটলা আকারে।

এভাবে কয়েক ধাপে কয়েক হাত ঘুরে দত্তপাড়ার পান যায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। আর সেরাটি চলে যায় সৌদি আরবে।

বাংলাদেম সময়: ০৭৫৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০১৬
এসএস/এএ/এটি/জেডএম

** একফসলি জমিতেই ভাত-কাপড়
** লাল ইটের দ্বীপগ্রাম (ভিডিওসহ)
** চলনবিলের শুটকিতে নারীর হাতের জাদু
** ‘পাকিস্তানিরাও সালাম দিতে বাধ্য হতো’
** মহিষের পিঠে নাটোর!
** চাঁপাইয়ের কালাই রুটিতে বুঁদ নাটোর
** উষ্ণতম লালপুরে শীতে কাবু পশু-পাখিও!
** পানি নেই মিনি কক্সবাজারে!
** টিনের চালে বৃষ্টি নুপুর (অডিওসহ)
** চলনবিলের রোদচকচকে মাছ শিকার (ভিডিওসহ)
** ঘরে সিরিয়াল, বাজারে তুমুল আড্ডা
** বৃষ্টিতে কনকনে শীত, প্যান্ট-লুঙ্গি একসঙ্গে!
** ভরদুপুরে কাকভোর!
** ডুবো রাস্তায় চৌচির হালতি
** হঠাৎ বৃষ্টিতে শীতের দাপট
** ঝুড়ি পাতলেই টেংরা-পুঁটি (ভিডিওসহ)
** শহীদ সাগরে আজও রক্তের চোরা স্রোত
** ‘অলৌকিক’ কুয়া, বট ও নারিকেল গাছের গল্প
** মানবতার ভাববিশ্বে পরিভ্রমণ
** সুধীরের সন্দেশ-ছানার জিলাপির টানে
** নতুন বইয়ে নতুন উদ্যম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ