ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

লাউয়াছড়ার বুক চিরে ট্রেন ভেঙে দিয়ে যায় নির্জনতা

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০১ ঘণ্টা, জুলাই ১৫, ২০১৬
লাউয়াছড়ার বুক চিরে ট্রেন ভেঙে দিয়ে যায় নির্জনতা ছবি: আবু বক্কর সিদ্দিকী

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান (শ্রীমঙ্গল) থেকে: রাত ১টায় বন বিভাগের বাংলো থেকে বের হওয়ার আগেই সিনিয়র আউটপুট এডিটর জাকারিয়া মন্ডল বেশ কিছু শর্ত জুড়ে দিলেন। প্রথম শর্ত ছিলো, কোনোরকম শব্দ করা যাবে না।

কোনো প্রাণীর ডাক নকল করা যাবে না।

যদি কেউ শর্ত ভঙ্গ করে তাকে সেখান থেকে একাই দুর্গম বনের ভেতর দিয়ে রুমে ফিরে যেতে হবে। সবাই একবাক্যে মেনে নিলেন এই সিদ্ধান্ত। উদ্দেশ্য- উন্মুক্ত বনে বিচরণ করা, নানান জাতের বিপন্ন প্রায় প্রাণীকে স্বচক্ষে দেখা। সঙ্গে মধ্যরাতের নির্জনতা উপভোগ করা।

লাউড়াছড়া রেস্ট হাউজ থেকে (বনের ঠিক মাঝামাঝি অবস্থিত) পা বাড়াতেই চারদিকে ঝিঁঝি পোকার ডাক, মাঝে মধ্যে ব্যাঙয়ের হাঁক, কখনও দূর থেকে ভেসে আসছিলো মায়া বা কাঁকর হরিণের কর্কষ স্বর। এর মধ্যে বন্য শূকরের বিদঘুটে গন্ধ এসে নাকে ঝাপ্টা দিচ্ছিলো। সঙ্গে থাকা বন প্রহরীও শূকরের উপস্থিতির আভাস দিলেন।

সহকর্মী বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন, এই বন্যশূকরগুলো কিন্তু ভয়ঙ্কর প্রকৃতির।



রাত দেড়টায় গিয়ে পৌঁছাই বনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলা শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সড়কের জানকিছড়ায়। সবাই অন্যরকম একটি রোমাঞ্চকর অনুভূতিতে নিমজ্জিত হচ্ছিলাম। কেউ জোরে নিঃশ্বাসও নিচ্ছিলেন না, যেনো নিস্তব্ধতায় ছেদ না পড়ে। কিন্তু ঠিক তখনই বিদ্যুৎবেগে পাশ দিয়ে ছুটে গেলো একটি প্রাইভেট কার।

গাড়িটি চলে যাওয়ার পর আবার যখন নির্জনতা নামতে শুরু করেছে, তখন মনে হচ্ছিলো, একটি শক্তিশালী ঝড় সব গাছপালা ভেঙে চুরমার করে বনের দিকে ধেয়ে আসছে। একটু পরে শব্দটা আরও স্পষ্ট হতে থাকলো, তখন আর বুঝতে বাঁকি থাকলো না, ট্রেন আসছে।

বনের ভেতরে টানা হুইসেল বাজলো কয়েকবার। সঙ্গে কু ঝিক ঝিক শব্দ সব নির্জনতাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়ে গেলো কয়েক মুহূর্তে। ঝিঁঝি পোকা ছাড়া আর সব ডাকই যেনো উবে গেলো। এই শব্দ যে প্রাণীগুলোকেও ভয় পাইয়ে দিয়েছে- তা সহজেই অনুমেয়।

জানা গেলো, ট্রেনে ঢাকা থেকে সিলেট যাওয়ার একমাত্র পথ এটি। দিনরাত বিরামহীনভাবে হুসহুস করে ছুটে চলেছে ট্রেন। সেই ট্রেনের চাকায় পিষে যায় বিরল প্রজাতির অনেক প্রাণী।

শুধু ট্রেনই নয় শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সড়কও বনের ভেতর দিয়ে (উত্তর-পূর্বদিক থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে) চলে গেছে। রেলের পাশাপাশি সড়কেও গাড়ির চাকায় পিষে মারা যায় অনেক প্রাণী। এর মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির বানর, সাপ, বিলুপ্তির পথে থাকা চশমা পরা হনুমানও রয়েছে।

রাত ২টায় জানকিছড়ায় (লাউয়াছড়ার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ) দিয়ে যাচ্ছিলেন সহকারী বন সংরক্ষক তাবিবুর রহমান। আগে থেকে পরিচয় থাকায় কয়েক মুহূর্তেই আলাপ জমে উঠলো আমাদের।



তাবিবুর রহমান বলেন, আমি জানি আমার সব স্টাফ সৎ নন। কিন্তু জেনেও তাকে বদলি করতে পারছি না। কারণ, কাউকে বদলি করলে সেই পদটি ফাঁকাই পড়ে থাকবে। জনবল সঙ্কট চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

আমাদের পাশ দিয়ে আবারও শো-শো করে বেরিয়ে গেলো বেশ কয়েকটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা। বললেন, এই অটোরিকশাগুলো কাঠ চুরির কাজে ব্যবহৃত হয়। মধ্যরাতে এখানে এসে বনচোরদের নামিয়ে দিয়ে যায়। আর ঠিক যখন ট্রেন যাতায়াত করে তখন গাছ কেটে মাটিতে ফেলছে। কোনোভাবেই শব্দ পাওয়ার সুযোগ নেই। যদিও আগের তুলনায় গাছ চুরি শতকরা ৮৫ ভাগ কমেছে।

কয়েকশো ফুট লম্বা একটি গাছে টর্চের আলো ফেলে তিনি বলেন, দেখেন এই গাছটি। এই গাছটি যদি চুরি করা হয়, তাহলে কোনোভাবে কি পূরণ করা সম্ভব! একদিকে যেমন গাছ চোররা ব্যবহার করছে এই যানবাহন, অন্যদিকে চাকায় পিষে মরছে অনেক প্রাণী।

আমরা প্রস্তাব দিয়েছিলাম, রাত ১০টার পরে এই রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ করে দিতে বা বনের ভেতরের এই সড়কটি বাইপাস করে দিতে। কিন্তু স্থানীয়রা অনেকে এর বিরোধিতা করছেন।

সর্বোচ্চ অনুমোদিত গতি ২০ কিলোমিটার নির্ধারিত থাকলেও কোনো যানবাহনই তা মানছে না। রাস্তা ফাঁকা পেলে গতি আরও বাড়িয়ে দেয়। আমরা দাবি করেছিলাম, গতিরোধক বসাতে। সওজ বলেছে, এটি মহাসড়ক, এখানে গতিরোধক বসানো যাবে না, বলেন তাবিবুর রহমান।



বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৬ ঘণ্টা, জুলাই ১৫, ২০১৬
এসআই/এটি/এসএনএস

**
হ-য-ব-র-ল বগিতে ভোগান্তির পারাবত!

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ