লাউয়াছড়া(শ্রীমঙ্গল) থেকে: উবু হয়ে বসে টর্চের আলোয় পায়ের ছাপ পরীক্ষা করছেন বিট অফিসার রেজাউল করিম। একটু আগেই বন্য শুকর গেছে এ পথে।
দু’পাশে ঘণ ঝোপ, আকাশ ছোঁয়া বৃক্ষসারির নিচে ঘুটঘুটে অন্ধকার। টর্চের আলোয় একটু স্থান আলোকিত হয়তো হচ্ছে, কিন্তু আলোর বলয়ের বাইরে আরো যেনো বেশি করে জমাট বাঁধছে অন্ধকার।
ফিতের মতো সরু ট্রেইলটার ওপরে ঝুলে মাঝেমধ্যেই বাগড়া বসিয়েছে বুনোলতা। কোন ঝোপের পেছনে লুকিয়ে কোন প্রাণী উঁকি মারছে কে জানে। আশেপাশেই যে বন্যশুকর রয়ে গেছে তা নিয়ে বিন্দু মাত্র সন্দেহ নেই বিট অফিসারের।
এরই মধ্যে অনেকটা এগিয়ে গেছে মূল দলটা। বন্দুকধারী আর লাঠি হাতের প্রহরীরা ওই দলটার সঙ্গেই আছে। তাদের আওয়াজ তো বটেই, টর্চের সিগন্যালও এখন আর নজরে আসছে না। আমাদের দু’জনের হাতে অস্ত্র বলতে কেবল দু’টো টর্চ।
ঘড়ির কাঁটা রাত একটার ঘর ছুঁইছুঁই করছে। নাহ, আর পেছনে পড়ে থাকা যায় না। এবার পা চালিয়ে মূল দলটাকে না ধরলেই নয়। এই চিন্তার সমর্থনেই হয়তো কাছেই কোথাও বিকট শব্দে ডেকে উঠলো একটা বুনো ব্যাঙ। তবে বন্য শুকরের কারণেই কি না কে জানে, এ জায়গাটায় আর কোনো প্রাণীর ডাক-চিৎকার নেই। এমনকি নীরব হয়ে আছে ঝিঁঝিপোকাগুলোও।
আর একটু এগুতেই সরু ফিতার মতো এক চিলতে ট্রেইলে কাটা কলাগাছের মতো বিঘত খানেক লম্বা অদ্ভূত এক পোকাকে তড়পাতে দেখা গেলো। ওটাকে পাশ কাটিয়ে আর একটু এগুতেই টর্চের আলো ফেলে মায়া হরিণের পায়ের তাজা ছাপ দেখালেন রেজাউল করিম। পেছনে দুপদাড় করে ঝোপ ভেঙ্গে কি যেনো ছুটে আসছে।
একটু পরই পরিস্ফট হলো টর্চের আলো, তারপর লাঠিহাতে বনকর্মী জুলহাস।
চোরাকাদা এড়িয়ে শরীর বাঁচিয়ে আর একটু সামনে এগুতেই মূল দলটার গুঞ্জন কানে এলো। একটা বাঁশঝাড় পেরুতেই আর একটা ঝড়া। ওই ঝড়াই বুকেই টর্চের আলো ফেলে কি যেনো খুঁজছে মূল টিমমা। পাড় থেকে কয়েক ফুট নিচে ছড়ার বুকে সাদা বালি, দুই থেকে তিন ইঞ্চি পরিমাণ পানি বয়ে চলেছে কুলকুল করে। তাতেই খেলা করছে চিংড়ি আর নাম না জানা ছোট ছোট কি সব মাছ।
চর্টের আলোয় দিশা হারিয়ে মাথা কাঁপিয়ে হয়তো ঘোর কাটাচ্ছে নি:সঙ্গ একটা চিংড়ি। পাশের বাঁশঝাড় থেকে হঠাৎ ডেকে উঠে ভয় পাইলে দিলো আর একটা গেছো ব্যাঙ।
ছড়া পেরিয়ে এবার ফের এগিয়ে চলা। এবার আর পেছনে ছাড়া পড়তে রাজি নাই আমরা। মাঝরাতে বনে ঢোকার পর এরইমধ্যে ঘণ্টাখানেক সময় পেরিয়ে গেছে। সরু ট্রেইলে এক সারিয়ে এবার এগিয়ে যাওয়ার পালা। আরো ঘণ্টা দুই এগুলে বেরিয়ে আসা যাবে জানকিছড়া বিট দিয়ে।
কিন্তু সে আশা বুঝি আর পূরণ হলো না। গাছের ফাঁক গলে ঝিরঝির পড়তে শুরু করলো বৃষ্টি। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় শ্রীমঙ্গলে। দেশের বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত যখন ২৩০০ সেন্টিমিটার, তখন গড়ে ৫০০০ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত হয় শ্রীমঙ্গলে। আর লাউয়াছড়াতে এ হার হয়তো আরো একটু বেশিই। সবসময়ই যেনো জল টলটলে মেঘ ভাসে লাউয়াছড়ার আকাশে।
এবার মেঘের কারণেই বুঝি সাঙ্গ হলো রাতের বন দেখার উদ্যোগ। যদিও এখন আর আগের মতো নেই লাউয়াছড়া। ৩৯ বছর ধরে বনে কাজ করা রেঞ্জ অফিসার সাহেব আলী মিয়া যেমন বলেন, ৩৫ বছর আগে এই লাউয়াছড়াকে মনে হয়েছিলো ১৪ বছরের কিশোরী। আর ৩৫ বছর পরে এসে এখন লাউয়াছড়াকে শতবর্ষী বৃদ্ধা ছাড়া আর কিছু মনে হয় না।
তবে তার কিছু মনে হোক বা না হোক, বেজায় জোঁক বেড়েছে লাউয়াছড়ায়। হঠাৎ বৃষ্টির আগমনে থমকে ফেরা দলটির সবাই যার যার পা থেকে এই জোঁক ছাড়াতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
চলবে...
** বন্যপ্রাণির বুনো গন্ধে মাতাল লাউয়াছড়ার রাত
**তপ্ত জলে মিশে আছে নির্মাইয়ের কান্না
** চায়ের রাজধানী সবুজ শীতল শ্রীমঙ্গলে
**৪ ঘণ্টায় চায়ের দেশে
**ট্রেন চলেছে চায়ের দেশে
বাংলাদেশ সময়: ২১৪৯ ঘণ্টা, জুলাই ১৬, ২০১৬
জেডএম/