লাউয়াছড়া (শ্রীমঙ্গল) থেকে: বন বিভাগের বাংলো থেকে বাইরে নামতেই বেজিটার সঙ্গে চোখাচোখি। ঘাসবন থেকে সবে বেরিয়েছে।
ঠিক তখনই টিলা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোতে ধুপধাড় শব্দ। মগডালে বসে পাতা খাচ্ছে মুখপোড়া হনুমান। একটা নয়, বেশ কয়েকটা। একটার কোলে তো বাচ্চাও আছে। শেষ বিকেলে দলবেঁধেই খাবারের খোঁজে বেরিয়েছে ওরা। দু’তিন জন মানুষকে পাত্তা দিতে বয়েই গেছে ওদের। বরং সময় নিয়ে ছবির জন্য পোঁজ দিলো কমলা রঙা গোটা দুই হনুমান। কালো মুখে একটু ভেংচিও কাটলো বোধহয়। তারপর এ ডাল, ও ডাল, এ গাছ ওগাছে ভালোই সার্কাস দেখালো বিনে পয়সায়। কখনো উঠে গেলো মগডালে। পর মুহূর্তে চিকন ডাল ধরে ঝাঁপ দিলো টারজানের মতো। ছবির জন্য পোঁজও দিলো। তারপর ফের মনোযোগ দিলো পাতা খাওয়ায়।
ঘড়ির কাঁটা সাড়ে পাঁচটার ঘরে থির থির করছে। বনের ভেতর থেকে দর্শনার্থীদের হই-হল্লা শোনা যাচ্ছে না আর। লাউয়াছড়ায় আজকের মতো প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছে বন বিভাগ। আর এই সুযোগেই খাবারের খোঁজে বেরিয়েছে বেপরোয়া হনুমানের দল।
বন্য প্রাণীদের বড় একটা অংশই এ সময় খাবার খোঁজে। টিলা বেয়ে নামতে নামতে কানো এলো হরেক পাখির ডাক। কাছে কোথাও উল্লুক ডাকছে। সেই সাত সকালে একবার খাবারের খোঁজে বেরিয়েছিলো প্রাণীর দল। তারপর ধীরে-ধীরে দর্শনার্থীর শোরগোল বাড়লে লুকিয়ে পড়েছিলো যার যার ডেরায়। সন্ধ্যার মুখে আর একবার বেরিয়েছে দিবাচরেরা। এরপর নিশাচর প্রাণীরা বেরুবে।
খাসিয়া পুঞ্জির পথ ধরে কিছুটা এগুতেই বাঁশঝাড়ে যেনো ঝড় উঠলো। ছোট লেজের এক দল কুলু বানর খেলা করছে। কখনো শীত পোহানো বুড়োর মতো চিকন বাঁশে বসছে পিঠ কুঁজো করে। পরক্ষণেই বাঁশ বাইছে অসাধারণ দক্ষতায়। মুখপোড়া হনুমানের মতো এরাও ঘুরে বেড়ায় দল বেঁধে।
লেজ ছোট বলে এদেরকে ছোট লেজি বানর বলেও ডাকে কেউ কেউ। অনেকটা শুকরের মতো দেখতে লেজ উঁচিয়ে পিঠের দিকে খাড়া করা। এরা মূলত বৃক্ষবাসী হলেও ভূ-চারীও বটে। দল বেঁধে ঘুরতেই পছন্দ করে তারা। বাঁশঝাড়, গাছের উঁচু ডাল, মিশ্র পাতাঝরা আর চিরসবুজ বনেই এদের বাস। এদিক দিয়ে চিন্তা করলে লাউয়াছড়া তাদের আদর্শ স্থান। লাউয়াছড়াসহ বৃহত্তর সিলেটের সবুজ বন ভারি পছন্দ এসব বানরের। এরা ফলমূল আর পাতা ছাড়াও বিভিন্ন পতঙ্গ খেয়ে বাঁচে।
কাছেই কোথাও চড়া গলায় কি যেনো ডাকছে। পাখি নাকি প্রাণী ঠিক বুঝা গেলো না। পরতে পরতে বিপুল বিস্ময় ছড়িয়ে থাকা এই বনে এখনো কতো কিছু তো অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেছে। আর একটু এগুতেই আকাশ ছোঁয়া গাছগুলোর মগডালে দেখা গেলো পাখির দল খেলছে। কালো শরীরের একটা পাখির মাথায় যেনো সুন্দর করে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে হলুদ মাথা। পাশের মগডালে বিরল প্রজাতির একটা কালো কাঠবিড়ালি খেলছে। এরা গাছের মগডালে পাতা আর ডাল দিয়ে ঘর বানায়। কচি পাতা, শাক-সবজি আর বাদাম ভারি পছন্দ তাদের। কেবল বাংলাদেশেই পাওয়া যায় এমন কালো কাঠবিড়ালী।
খাসিয়া পুঞ্জির পথ ছেড়ে ঘন ঝোপের ট্রেইলে কিছু দূর এগুতেই সন্ধ্যা ঘনালো। ডানে খাড়া টিলা, বাঁয়ে আরো গভীর বন। ফেরার পথ ধরা ছাড়া উপায় নেই আর। নিশাচর প্রাণীর দল বের হতে শুরু করবে একটু পর।
গোটা বনে সুনসান নীরবতা। চেনা-অচেনা পতঙ্গ, পাখি-প্রাণীর ডাক বাড়ছে। লাউয়াছড়া এখন ওদেরই দখলে। সকাল হওয়ার আগে আর মানুষ আসবে না তাদের আবাসে। কাছে কোথাও উল্লুক ডাকছে। মায়া হরিণের দল কোথায় লুকিয়েছে কে জানে। তবে বুনো শুকরের বেপরোয়া বিচরণ শুরু হবে একটু পরই।
**বেটা-বেটির পুঞ্জি ঘুরে বীজহীন বাগানে
** রাত দুপুরে গভীর বনে ভয়ের সঙ্গে পাঞ্জা
** বন্যপ্রাণির বুনো গন্ধে মাতাল লাউয়াছড়ার রাত
**তপ্ত জলে মিশে আছে নির্মাইয়ের কান্না
** চায়ের রাজধানী সবুজ শীতল শ্রীমঙ্গলে
**৪ ঘণ্টায় চায়ের দেশে
**ট্রেন চলেছে চায়ের দেশে
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৮ ঘণ্টা, জুলাই ১৭, ২০১৬
জেডএম