সিলেট থেকে: গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে যখন ঘিলাছড়া বাজারে পৌঁছে যাই তখন উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে হাকালুকির জিরো পয়েন্টের পাড়ে। শতবর্ষী পাকুর গাছের তলায় তখন বাতাসের শন শন আওয়াজের সঙ্গে একতালে বইছে জলের গর্জন।
বৈরী আবহাওয়ার কারণে হাওর ভ্রমণ বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা দেখে শঙ্কিত হয়ে পড়ি। সারাটা দিন হাকালুকি হাওরের জলরাশির ওপর ভেসে বেড়াবো বলেই ফেঞ্চুগঞ্জের ঘিলাছড়া বাজারে আসি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে। কিন্তু স্থানীয়রা এমন সময়ে হাকালুকির গহীনে যেতে কিছুটা নিরুৎসাহী করেন। হাওরের গভীরে যাওয়া যাবে না শর্তে আমাদের নিয়ে যাত্রা শুরু করেন জলযান চালক মোজাহিদ।
যাত্রা শুরুর আগেই মন খুশিতে ভরে ওঠে ইঞ্জিনচালিত নৌযানটি দেখে। ক্যাপসুল আকৃতির নৌযানটি ফাইবার বোর্ডে তৈরি। দেখেই বোঝা যায় এ বস্তু উল্টে গেলেও ডুবে যাবে না। একে একে দলের সবাই প্রমোদতরীতে চড়ে বসার পর চালু হয় ক্যাপসুল বোটের ইঞ্জিন। নদী ভ্রমণে ট্রলার জাতীয় ছোট নৌযানে চড়লে বরাবরই বিরক্ত হতে হয় তার একঘেঁয়ে শব্দে। কিন্তু হাকালুকিতে সদ্য চালু হওয়া আধুনিক এই নৌযানের শব্দ কানের পর্দায় তেমন কোনো নির্যাতন করেনি। বোটের পাটাতনের নিচে ইঞ্জিনটি সম্পূর্ণ আবৃত থাকায় জলসংগীতের সুরে সুরেই চলতে থাকে আমাদের হাওর ভ্রমণ। পাড়ের দিকের ছোট-মাঝারি ঢেউ পেরিয়ে যতই বড় বড় ঢেউয়ের দিকে এগুতে থাকে দুলে ওঠা ক্যাপসুল বোট, আনন্দের মাত্রা যায় আরও বেড়ে। জলযানটির চলার ঢঙের সঙ্গে দারুণ মিল আছে ব্যাঙ লাফের সঙ্গে। এক একটি বড় বড় ঢেউ পেরোনোর সময় হালকা বাহনটির সামনের দিকের অংশ লাফিয়ে ওঠে অনেকটা। একটি ঢেউ পেরিয়ে যাবার পর তা আবার আছড়ে পড়ে জলের বুকে।
ছেলেবেলায় যারা পুকুরে বা নদীতে মাটির চ্যাপ্টা ঢিল বা হাঁড়ির ভাঙা খাপড়া দিয়ে ব্যাঙ লাফানোর প্রতিযোগিতায় মেতেছেন তাদের মনে পড়ে যাবে সেই দৃশ্য প্রমোদতরীর এমন দুলকি চাল দেখে। শুধু সামনে পিছনে লাফিয়ে চলাই নয়, ডানে-বায়েও দুলতে থাকে নৌযানটি, অনেকটা নাগরদোলায় চড়ার অভিজ্ঞতার মতো। তবে এতে ভয় লাগবে না মোটেও, বরঞ্চ নৌ ভ্রমণের যুক্ত হবে ভিন্নমাত্রা।
প্রমোদতরীর মুগ্ধতা কাটিয়ে তাকিয়ে দেখি জলের সাগর হাকালুকি, মিঠা জলের আধার। দূর-দিগন্ত রেখায় গিয়ে মিশেছে সিলেট ও পার্শ্ববর্তী জেলা মৌলভীবাজারের গ্রাম-গঞ্জ-বসতি। চালক মোজাহিদ সতর্ক ভঙিতে জেলে গ্রামগুলোকে দৃষ্টিসীমায় রেখে চালাচ্ছেন তার জলের ঘোড়া। কিছুদূর যেতেই চোখে পড়ে জলে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া কয়েক ঘর জেলে বসতি। বাড়ি-ঘরগুলোর চতুর্দিকে জমা কচুরিপানার তলে ঠোঁট ডুবিয়ে আহার্যের সন্ধানে ব্যস্ত হাঁসের দল। জলপ্রিয় শিশুরা ইচ্ছেমতো নাইছে বাড়ির পাশের ঘোলা জলে। ইতস্তত ছড়ানো ছিটানো জেলে নৌকাও দেখা যায় বেশ কয়েকটি। ছোট্ট এক একটি ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে জেলেরা চলে যাচ্ছেন গভীর হাকালুকির দিকে। সারি সারি জেলেপাড়া পেরিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ে বুকভাঙা লাল টিলা। উঁচু টিলাটির আধেকটাই ধ্বসে গেছে হাকালুকির আগ্রাসী ঢেউয়ের ছোবলে। আরও কিছুটা পথ পেরিয়ে পৌঁছে যাই মোকামের বাজার। আমাদের যাত্রা বিরতি সেই বাজারে। এককালে বাজারটি ছিল এ অঞ্চলের অন্যতম বৃহৎ বাজার। এখন সেখানে কেবল দু’একটি দোকান, হাকালুকি গিলে খেয়েছে মোকাম বাজারের সৌর্যবীর্য।
মোকাম বাজারের পাড় থেকে দেখা যায় দূরে হাকালুকির গহীনে হিজল বনের সবুজাভ রেখা। যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল সেখানেও কিন্তু বিরূপ হাওয়া সেই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে বাধ সাধে। তাই অনেকটা অপূর্ণই রয়ে যায় হাকালুকি ভ্রমণ। আশা করি, পরেরবার যতদূর পারা যায় হাকালুকির জলরাশি ছুঁয়ে আসতে পারবো।
কীভাবে যাবেন: সিলেট কোর্ট পয়েন্ট থেকে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা সদরের দূরত্ব মাত্র ২৩ কিলোমিটার। যাত্রীবাহী বাসে ভাড়া নেয় ২৫ টাকা। আর সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ৩০ টাকা। সময় লাগে প্রায় আধাঘণ্টা। আর ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে হাকালুকি জিরো পয়েন্টের দূরত্ব আরও ৯ কিলোমিটার। সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ১শ’ টাকা রিজার্ভ ভাড়ায় যেতে পারেন ঘিলাছড়া জিরো পয়েন্টে। যেখানে মিশে গেছে হাকালুকি হাওরের পশ্চিম তীরের গন্তব্য।
আরও পড়ুন...
**ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানায় স্মৃতির ধূলো
**টিলার ওপর দৃষ্টিনন্দন ফ্রুটস ভ্যালি
**পোস্টার-ব্যানারে ঢাকা এম এ রব চত্বরের নামফলক
** শীতল বনের খোঁজে বোকা বনে যাওয়া
**দিনের যাত্রী আসনই রাতের বিছানা
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৫ ঘণ্টা, জুলাই ১৯, ২০১৬
এমজেএফ/জেডএস