রহস্যময় গুহা (আলুটিলা) ঘু্রে: মশালটা দপ করে নিভে যেতেই জপ করে কবরের অন্ধকার নামলো পাতাল গুহায়। পায়ের পাতার ওপর দিয়ে বয়ে চলা পানির ধারা যেনো শীতল হয়ে উঠলো আরো।
লাইটারের আগুনে ফের মশাল জ্বালিয়ে একটু কাত করতেই উস্কে উঠলো আগুন। অনভ্যস্ত হাতে মশাল জ্বালিয়ে রেখে অনেকটা হামাগুড়ির ভঙ্গিমায় এগুতে হলো এবার। গুহার পাথুরে ছাদ এখানে নিচে নেমে যেনো আঁধার চিরে বয়ে চলা ঝিরির জল ছুঁতে চাইছে।
বাইরে ভাদ্র মাসের কড়া রোদে পুড়ে এসে গুহার ভেতরটাকে এতোক্ষণ প্রাণ জুড়ানো শীতলই মনে হচ্ছিলো। কিন্তু হামাগড়ির ভঙ্গিমায় এগুতে গিয়ে দরদর করে ঘামতে থাকলো শরীর। আরো ক’মিনিট এগুনোর পর চাম কমলো কোমরে। এবার মাথা সোজা করা যাচ্ছে। সুরঙ্গটাও ফের প্রশস্ত হয়ে উঠেছে।
আর একটু এগুতেই হাতের বাঁয়ে কোমর সমান এক কানাগলি রেখে কোমর সমান ঢালু বাইতেই দূরে আলোর রেখা গেলো। আর একটু এগুতেই গুহার প্রশস্ত মুখ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাথর বনের ফাঁক গলে গড়িয়ে গড়িয়ে নামছে পানি। এখানে ওখানে শহুরে আগন্তুকদের কাণ্ডজ্ঞানের সাক্ষী হয়ে পড়ে আছে পরিত্যক্ত মশাল, পানির বোতল, সফট ড্রিকসের ক্যান।
অথচ এই ঝিরিই কিনা এই পাহাড়ি জনপদের কতো মানুষের অন্যতম পানির উৎস্য। আর এই ঝিরির জন্ম দিয়েছে কয়েক কিলোমিটার বর্গের আয়তনে বিস্তৃত বেশ কিছু ঘামা পাহাড়। সারাবছই ভেজা ভেজা থাকে বলে ঘামা পাহাড় বলে ওগুলোকে।
তিন কিলোমিটার দূরের আনিন্দসুন্দর রিসাং ঝরনাকে ঘিরে থাকা ওই ঘামা পাহাড়গুলো থেকে চুইয়ে চুইয়ে নামে পানি। এমন অসংখ্যা চোয়ানো পানির ছোট ছোট ধারা মিলে এই ঝিরির জন্ম। পাথর আর পাথুরের মাটির গুহা পেরিয়ে এঁকে বেঁকে আরো কিছু পাহাড় পেরিয়ে এই ঝিরি পড়েছে চেঙ্গি নদীতে।
চেঙ্গি পার হলেই খাগড়াছড়ি শহর।
ঢাকা-খাগড়াছড়ি সড়কের পাশে আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্র থেকে শতাধিক ফুট ঢালু রাস্তা বেয়ে নিচে নামার পর শ’তিনেক সিঁড়ি ভেঙ্গে তবে আলুটিলার রহস্যময় গুহা। স্থানীয় ত্রিপুরাদের ভাষায় এর নাম মাতাই হাকর। যার বাংলা অর্থ দেবগুহা।
গুহার প্রবেশ মুখের ব্যাস ১৮ ফুট হলেও এগুনোর সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ সরু হয়ে এসেছে। কোনো কোনো স্থানে একাধিক মানুষ পাশাপাশি চলা কষ্টকর। আর গুহামুখে আলো-আঁধারির খেলা থাকলেও মাঝখানটায় একদমই নিকষ অন্ধকার। অক্সিজেনের সরবরাহ কম খাকায় তাই মাঝের অংশটাতে অনভ্যস্ত হাতে মশাল জ্বালিয়ে রাখতে কসরত করতে হয়।
গা ছমছমে অনুভূমি নিয়ে সাড়ে তিনশ’ ফুট দীর্ঘ এই প্রাকৃতিক সুড়ঙ্গে ভ্রমণ ভয়সংকুল হলেও দারুণ রোমাঞ্চকর। কোথাও কোথাও পিচ্ছিল বলে পা ফেলতে হয় সাবধানে। মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা পাথর-কাঁকরে পা হড়কানোও বিচিত্র নয়।
বাংলাদেশ তো বটেই, সারাবিশ্বেই এমন প্রাকৃতিক সুড়ঙ্গের নজির বিরল। এ গুহা এই উপমহাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক সুরঙ্গও বটে।
এ গুহায় ভ্রমণ সবচেয়ে উপভোগ্য হয় মশালে। চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়কে পাশে আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্রের প্রবেশ মুখে মাত্র ১০ টাকায় মশাল মেলে। ওখান থেকে খাগড়াছড়ি শহরের দূরত্ব ৮ কিলোমিটার পূর্ব দিকে।
তবে পর্যটন কেন্দ্রের ঢালু রাস্তা বেয়ে সিঁড়িপথে আসার সময় চেঙ্গির ওপারের খাগড়াছড়ি শহর পুরোটাই উঠে আসে চোখের সামনে। সিঁড়িপথের দু’পাশে কখনো ঘণঝোপ, কখনোবা পাহাড়ের খাড়া দেওয়াল।
পুরো পথটাই ছায়াঢাকা, শীতল। পুরো এলাকাজুড়েই পুলিশ আর সেনা জওয়ানদের উপস্থিতি নিশ্চিত নিরাপত্তার বোধ তৈরি করে রাখে। আলুটিলার এই রহস্যময় গুহা খাগড়াছড়ির প্রধান আকর্ষণই বটে।
চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি আসা যায় আলুটিলায়। খাগড়াছড়ি থেকে আসতে হয় রিজার্ভ গাড়ি বা অটো রিকশায়। রাঙামাটি থেকে আসতে হলে বিসিক শিল্পনগরীর মোড়ে মোড় নিতে হয় বাঁ দিকে। রিসাং ঝরনার দূরত্ব এখান থেকে ৩ কিলোমিটারের বেশি নয়।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৭ ঘণ্টা, আগস্ট ২০, ২০১৬
জেডএম/