কেওক্রাডং, রুমা, বান্দরবান থেকে: উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম। যতো দূর চোখ যায়, কেবল পাহাড় আর পাহাড়।
যতো দূর চোখ যায়, কেবল মেঘ আর মেঘ। ধূসর-কালো মেঘ, দুধসাদা মেঘ, পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ। মেঘেরা যেন পাহাড়ের ওপরে, পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে সমাবেশে জড়ো হয়েছে! এ যে মেঘেরও রাজ্য!
যতো দূর চোখ যায়, কেবল তারা আর তারা! ছোট-বড় তারা, কাছের-দূরের তারা, উজ্জ্বল-অনুজ্জ্বল তারা! যেন মিছিল বেরিয়েছে তারাদের। সব তারা জমা হয়েছে এই এখানে।
দেশের শীর্ষ পর্বতের চূড়া কেওক্রাডংয়ের বিকেল, গোধূলি ও রাতের আকাশের চিত্র ঠিক এমনটা। তবে এ ক’টি বাক্যে কেওক্রাডংয়ের আকাশের বিশালতা বা নয়নাভিরাম সৌন্দর্য যে বর্ণনা করা যায় না, তা বেরিয়ে আসে পর্বতারোহী অভিযাত্রী ইভান রেজভী সনির মুখে, “এটা কেওক্রাডং নয়, সাক্ষাৎ নিসর্গ। এটাই পুরো বাংলাদেশ। ”
সত্যিই যেন নৈসর্গিক অনুভূতি জাগে বান্দরবানের রুমা উপজেলার পাহাড় সারির মাঝে সবচেয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা কেওক্রাডংয়ের বিকেল আর রাতের আকাশ উপভোগে।
হাজার ফুট উচ্চ্তার বগালেক থেকে আরও প্রায় ২২শ’ ফুট বেয়ে কেওক্রাডং পর্বতে পৌঁছানোর পর মন যেমনি উল্লসিত হয়ে পড়ছিল, তেমনি রাজ্যের ক্লান্তি ভর করছিলো পুরো শরীরে।
এই পরিশ্রান্ত শরীর নিয়ে যখন ৬৩ সিঁড়ি বেয়ে একেবারে চূড়া (চূড়া নির্দেশক) ছুঁলো পা, তখন মেঘ ছুঁয়ে আসা হাওয়া ঝাপটা দিয়ে যেন সব ক্লান্তি নিয়ে গেল। বিকেল আর গোধূলিতে পাহাড়-মেঘের মিতালী দেখতে দেখতে সন্ধ্যা গড়ালো। সূর্য গেল ঘুমুতে।
কটেজের আনুষ্ঠানিকতা সেরে রাতের বেলা ফের চূড়ায় ওঠার পর মনে হলো তারাদের পড়শী আসমানে উঠে গেছি যেন। তারায় তারায় যেন তারার মহাসমাবেশ বসে গেছে কেওক্রাডংয়ের আকাশে। কতো তারা যেন কেওক্রাডংয়ের পাহাড়ের দিকে এগিয়ে এসেছে। মেঘ জমাট বেঁধে আড়াল করতে চাইলে মনে হয় সারি বেঁধে মিছিল করে চলেছে তারারাও।
তারার এই মুগ্ধতার মধ্যেই চলছিল দূর পাহাড়ের মেঘ ছুঁয়ে আসা তুমুল হাওয়ার দাপুটে ঝাপটানি। হাওয়ায় থেকে থেকে শরীর কেঁপে উঠলেও চোখ যেন বুজিয়ে দিচ্ছিল ঘুমে।
এমন রাতের আকাশে এই অনুভূতি নেওয়ার জন্যই কেওক্রাডংয়ের চূড়ায় বিকেলে এসেও অবস্থান করছেন অভিযাত্রী সনি। তিনি এসেছেন ঢাকার উত্তরা থেকে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। তার সঙ্গে এসেছেন আরও ৮ জন।
সনি বলেন, ১৩ বছর আগে থেকে স্বপ্ন লালন করছিলাম দেশের শীর্ষ এই পাহাড় চূড়ায় উঠবো। এখন আমি সেই চূড়ায়। এই যে অনুভূতি, এটা প্রকাশের ভাষা হয় না, শব্দ হয় না।
“যদি কোনো নিয়ম-রীতি না থাকতো, তবে পাটি বিছিয়ে কেবল আকাশের দিকে তাকিয়ে রাতভর তারা গুনতাম। ঘুমাতাম না। ” রাতের আকাশ নিয়ে এমন শিহরণ সনির।
অভিজ্ঞ অভিযাত্রী রিয়াসাদ সানভী তখন চূড়ায় বসে আশপাশের পাড়াগুলো দেখাচ্ছিলেন। দিনের বেলায় পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে যে জনপদগুলো তেমন চোখে লাগেনি, রাত গড়াতেই বাতির আলোতে স্পষ্ট হয়ে উঠলো সেগুলো।
সানভী একে একে বলে চলছিলেন, “চূড়ার সোজা পূবদিকে দেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বতের চূড়া দুমলং। তার খানিকটা ডানে চুংচাং পাড়া। আর বামে রুমনা পাড়া…একেবারে ডানে হেলিপ্যাডের ওপাশে পাসিং পাড়া, দেশের সবচেয়ে উঁচু গ্রাম বা জনপদ…এখানে ঘরের জানালা দিয়ে মেঘ ছোঁয়া যায়…”
সনি-সানভীদের সঙ্গে গল্পে গল্পে রাত যখন গড়াচ্ছিল, মেঘের সঙ্গে যুদ্ধ করে তখন হেসে উঠতে থাকলো চাঁদ। এতোক্ষণ কেওক্রাডংয়ের আকাশে সুন্দরের যে খানিক অপূর্ণতা ছিল, তা যেন পূর্ণ করে দিলো এ ‘শুভ্রটিপ’। দোতলা কটেজের ঝুলন্ত বারান্দায় পড়া চাঁদের আলো তখন যেন বলে যাচ্ছিল, ‘শুভরাত্রি!’
আরও পড়ুন-
** মুরংদের তুলার কম্বল, টেকে ২শ’ বছর
** আত্মশুদ্ধির আহ্বানে আকাশে শতো ফানুস
** মেঘ ফুঁড়ে পাহাড়ের গায়ে রোদ বাতি!
** জলের ওপর বসতভিটে
** হ্রদের জলে কার ছায়া গো!
** সড়ক যেন আকাশছোঁয়ার খেলায় (ভিডিও)
** সাজেকের ভাঁজে ভাঁজে প্রকৃতির সাজ
** মানিকছড়ির ফুলের ঝাড়ুতে পরিচ্ছন্ন সারাদেশ
** নট ইউজিং ‘ইউজ মি’
** কেওক্রাডংয়ের দুর্গম পথে প্রশান্তির চিংড়ি
** বগালেকে ফ্রি ফিশ স্পা!
বাংলাদেশ সময়: ২১৪৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০১৬
এইচএ/এএ