লংগদু, রাঙামাটি ঘুরে: ৬১১৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের রাঙামাটির ঠিক মাঝখানটায় ৭১০ বর্গকিলোমিটারের কাপ্তাই হ্রদ। এই হ্রদকে ঘিরেই দেশের সর্ববৃহৎ জেলার বেশিরভাগ শহর-হাট-বাজার।
বলতে গেলে কেবল কাউখালী আর রাজস্থলী উপজেলা ছাড়া সদর থেকে অন্য কোনো উপজেলায় যাওয়ার স্থলপথই নেই। আর রাজস্থলীতেও যেতে কর্ণফুলী নদী পার হতে হবে ফেরিতে।
কাপ্তাই হ্রদে প্রধানতম বাহন নৌযান। দ্বিতল কাঠামোর নৌযানগুলো স্টিমারে নামেই পরিচিত এখানে। এমনই এক স্টিমারে যাত্রা শুরু হলো লংগদুর উদ্দেশে। সোনালি সূর্যের শুভেচ্ছা নিয়ে সকাল সাড়ে ৭টায় জেলা শহরের ব্যস্ত রিজার্ভবাজার ঘাট থেকে লংগদুর উদ্দেশে ছাড়লো বিরতিহীন স্টিমার এম এল শামীম। অবশ্য এর শেষ স্টপেজ মারিশ্যা। জল থৈথৈ হ্রদে ঘণ্টায় ১৮-২০ কিলোমিটার বেগে ছুটে এম এল শামীম গন্তব্যে নামালো সাড়ে তিন ঘণ্টা পর। হ্রদে পানি কমে গেলে নাকি নদী ধরে গন্তব্যে পৌঁছাতে চার ঘণ্টা লাগে এই স্টিমারের।
দীর্ঘ এই যাত্রায় কথা হলো স্টিমারের সুপারভাইজর নুরুল হক ও সারেং মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে। প্রথম জনের বয়স ৬৫ বছর ছাড়িয়েছে। দ্বিতীয়জন সত্তরোর্ধ্ব। মানুষকে জলপথ পার করাতে করাতেই দু’জনের কয়েক যুগ করে কেটে গেছে। নুরুল হক ও মোহাম্মদ আলী দু’জনেরই কাপ্তাই হ্রদে স্টিমার চালানোর আগে পদ্মা-মেঘনাসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথে লঞ্চ-স্টিমার চালানোর অভিজ্ঞতা আছে।
হাজী আব্দুল গফুর অ্যান্ড সন্স নামে একটি গ্রুপের মালিকানাধীন তাদের এম এল শামীম। এই স্টিমার চালনায় কোম্পানির মোট ৮ জন কর্মী নিয়োজিত। এরমধ্যে সুপারভাইজর ও সারেং ছাড়া বাকি ছয়জনের তিনজন হলেন লস্কর, একজন মিস্ত্রি, একজন চা দোকানদার এবং একজন সারেংয়ের সহযোগী।
এম এল শামীম ঘুরে দেখা গেল, এতে আপার ক্লাসে (ওপর তলা) ৮৮ আসন এবং লোয়ার ক্লাসে (নিচ তলা) শতাধিক আসন রয়েছে। লংগদু পর্যন্ত আপার ক্লাসের ভাড়া ১৪৫, আর লোয়ার ক্লাসের ভাড়া ১১৫ টাকা। জারাইল ও গোদা কাঠের তৈরি স্টিমারকে খুব গোছানো মনে হলো না। বডিতে রং মাখানো থাকলেও অবয়ব স্পষ্টই যেন বলছিল, বহুদিন ধরে চলছে এম এল শামীম। তবে তপ্তরোদের কোনো তাপ লাগছিল না স্টিমারের আপার কিংবা লোয়ার ক্লাসে।
২২০ হর্স পাওয়ারের ইঞ্জিনচালিত স্টিমারের আপার ক্লাসের সামনের অংশে সারেংয়ের কক্ষ, পেছনে শৌচাগার। আর লোয়ার ক্লাসের পেছনের অংশে রয়েছে চা দোকান, যেখানে রয়েছে বিস্কুট-পাউরুটিও। এই ক্লাসে রয়েছে শৌচাগারও। তবে শৌচাগারে ঢুকতে হবে মাথা নিচু করে, ভেতরে সোজা দাঁড়ানোর সুযোগ নেই।
নুরুল হকের তথ্য অনুযায়ী, পুরো কাপ্তাই হ্রদের বিভিন্ন রুটে হাজী আবদুল গফুর অ্যান্ড সন্সের ১৪টি স্টিমার রয়েছে। আর এমন স্টিমার হ্রদে চালাচ্ছে আরও ৩১টি কোম্পানি।
রাঙামাটি জেলায় চলাচলের প্রধান এ বাহনের ব্যবস্থাপনা দিক নিয়ে কথা হয় নুরুল হকের সঙ্গে।
তিনি জানান, লংগদু-নানিয়ার-বরকল-জুরাছড়ি-বিলাইছড়ি সব স্থানেই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে প্রায় সবাই এ বাহনে চলাচল করেন। উপজেলায় শহরে রাঙামাটি বা চট্টগ্রামের পত্র-পত্রিকাও যায় এই স্টিমারে। এসময় সারেংয়ের আসনের পাশে তার টেবিলের সামনেই দেখা যায় চট্টগ্রামের কিছু আঞ্চলিক পত্রিকা, যেগুলো যাচ্ছে লংগদু ও মারিশ্যায়।
নুরুল হক স্বীকার করেন, জেলার অর্ধেকের বেশি উপজেলার বিশাল জনগোষ্ঠীর চলাচলের প্রধান বাহন স্টিমারের ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত হতে পারে।
তার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন নজর কাড়ছিল চারপাশের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য। হ্রদের দু’দিকে ঘন সবুজ পাহাড়ের হাতছানি, হ্রদের জলে বসতভিটে, নীল আকাশের নিচে নীলাভ জলের মায়া, পাহাড়ের ভাঁজ থেকে বেরিয়ে পড়া ক্ষুদ্র-ছোট-মাঝারি ঝরনাধারা, হ্রদের কোলঘেঁষে গড়ে ওঠা বাজার।
নুরুল হকই বলেন কেবল হ্রদটাই যে পর্যটক টানার প্রধান কেন্দ্র হতে পারে সেকথা। সেক্ষেত্রে বাহন অর্থাৎ যাতায়াত সেবার প্রসঙ্গ এলে সংশ্লিষ্টদের ভাবতেও বলেন তিনি।
নুরুল হক মনে করেন, পর্যটক টানতে হলে স্টিমারসহ হ্রদে চলাচলের বাহনে সেবা বাড়ানোর বিকল্প নেই। পর্যটকরা এসে চলাচলটা স্বাচ্ছন্দ্যে করতে না পারলে আর আসবেন না। সুগম চলাচল যেকোনো স্থানেই জনসমাগম বাড়ায়।
কাপ্তাই হ্রদের লংগদুর এদিকটাকে অনেকে ইউরোপ-আমেরিকার গোছানো পর্যটন স্পটের সঙ্গে তুলনা করেন। সে প্রসঙ্গে নুরুল হকও সায় দেন। বলেন, সবকিছু পরিকল্পিত হলে কাপ্তাই হ্রদে কেবল হাওয়া খাওয়ার জন্যই প্রকৃতিপ্রেমীদের ঢল নামবে। আর তাতে এখানকার মানুষেরই কর্মসংস্থান বাড়বে, উন্নয়নের ছোঁয়া লাগবে জনপদে জনপদে।
গল্পে গল্পে সারেং মোহাম্মদ আলীও গলা মেলান নুরুল হকের সঙ্গে। তিনি তার পদ্মা-মেঘনায় কর্মজীবনের গল্পও করেন। বলেন, অন্তত সড়কের চেয়েও নৌপথটা নিরাপদ এবং উপভোগের। কেবল দরকার পরিকল্পনা।
রিজার্ভ বাজার থেকে যাত্রা করে ছবির মতো হ্রদ পাড়ি দিয়ে স্টিমার ঠেকলো লংগদু ঘাটে। মোটরসাইকেল ভাড়া করে যাত্রা হলো পরবর্তী গন্তব্য ৩ টিলা বনবিহার ও বৌদ্ধমন্দিরের দিকে।
**সাজেকের দুর্গম সড়কের এক কিশোর হেলপার
** ঘুম ভাঙালো মেঘ
** কেওক্রাডংয়ের চূড়া থেকে সূর্যোদয় দর্শন! (ভিডিও)
** কেওক্রাডংয়ের রাতের আকাশের কতো বিশালতা!
** কেওক্রাডংয়ের দুর্গম পথে প্রশান্তির চিংড়ি
** বগালেকে ফ্রি ফিশ স্পা!
** মুরংদের তুলার কম্বল, টেকে ২শ’ বছর
** আত্মশুদ্ধির আহ্বানে আকাশে শতো ফানুস
** মেঘ ফুঁড়ে পাহাড়ের গায়ে রোদ বাতি!
** জলের ওপর বসতভিটে
** হ্রদের জলে কার ছায়া গো!
** সড়ক যেন আকাশছোঁয়ার খেলায় (ভিডিও)
** সাজেকের ভাঁজে ভাঁজে প্রকৃতির সাজ
** মানিকছড়ির ফুলের ঝাড়ুতে পরিচ্ছন্ন সারাদেশ
** নট ইউজিং ‘ইউজ মি’
বাংলাদেশ সময়: ১১০৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০১৬
এইচএ/জেডএম