ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

বুড়িগঙ্গা-মেঘনা ছুঁয়ে পশুর নদীর ডাকে

শুভ্রনীল সাগর, ফিচার এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪১৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৬
বুড়িগঙ্গা-মেঘনা ছুঁয়ে পশুর নদীর ডাকে ছবি: শুভ্রনীল সাগর/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

এম ভি মধুমতি থেকে (ঢাকা-খুলনা): দৌড়ে এসে জাহাজের রেলিংয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে দুই সহদরা বালিকা। একটু নদী দেখেই এক দৌড়ে কেবিনে, সেখান থেকে আবার রেলিং। নাম জিজ্ঞেস করতেই একরাশ লজ্জামাখা মুখ নিয়ে দ্বিগুণ বেগে ছুট। কেবিনমুখে দাঁড়ানো মায়ের সস্নেহ ধমক, নাম বলো!

কে শোনে কার কথা! ওদের আজ দস্যিপনায় পেয়ে বসেছে। সে পাক।

রেলিংয়ের ঠিক পাশ দিয়ে সারি সারি কেবিন। মাঝখানের গলিপথ ধরে পেছনের দিকে এগুলে চিলতে উঠান, বলা ভালো- এম ভি মধুমতির তিন তলার পেছনের ডেক। খোলা আকাশের নিচে বেশ ছিমছাম বসার জায়গা। জাহাজ ছাড়ার নির্ধারিত সময় সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা। তখনও ছাড়েনি কিন্তু এর মধ্যেই জমাটি আড্ডা বসে গেছে। চারপাশে ক্ষুদে দস্যুদের হুটোপুটি তো রয়েছেই। ছবি: শুভ্রনীল সাগর/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমউপরে হুল্লোড় নিচে রোজকার ব্যস্ত সদরঘাট। বুড়িগঙ্গার বুকে দূর থেকে শোনা যাচ্ছে জাহাজের সম্মোহনী ভেঁপু। মূল ঘাটে ঢুকে কাঙ্ক্ষিত জাহাজের খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মধুমতি ছেড়ে যাবে লালকুঠি ঘাট থেকে। মূলঘাট থেকে দু’মিনিটের হাঁটাপথ। এখান থেকেই ঢাকা-মংলাগামী (খুলনা) মধুমতি ছেড়ে যায়। এটি সদরঘাটেরই একটি অংশ। তাই বলে ঘাটের ব্যস্ততা মোটেও কম নয়। ডানে-বামে, সামনে-পিছনে সারি সারি খুলনা, চাঁদপুর কিংবা বরিশালের জাহাজ। কোনোটি এসে পৌঁছালো, কোনোটি ছেড়ে যাওয়ার অপেক্ষায়। কেউ নামছে, কেউ উঠছে- কারও শেষ মুহূর্তের তাড়া।

বুড়িগঙ্গার সেই রাম নেই, অযোধ্যাও নেই। একই কথা সদরঘাটের জন্যও। নবাবি আমলের বুড়িগঙ্গা-সদরঘাটের যে জৌলুস তা আজ নানা কারণে অনেকটাই ফিকে। এরপরও বুড়িগঙ্গার এপাড়-ওপাড় মালবাহী কার্গো, জাহাজ, লঞ্চের ভিড়। ধ্যানী শিল্পীর মতো মিহিন ঢেউয়ের তারে সারাক্ষণ তুলে চলেছে ডিঙি নৌকার সুর। ছবি: শুভ্রনীল সাগর/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমসূয্যিমামা ঘুমাতে গেলেই বদলে যায় বুড়িগঙ্গার চিরচেনা রূপ। সদরঘাটকে তখন জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে উপন্যাসের মায়াময় সেই গঞ্জ বলে মনে হয়। যার বর্ণিল আলোকছটার আকর্ষণে দূরদেশে পাড়ি জমানো নাবিক জাহাজ ভেড়ায়। স্বপ্নের সওদাগররা ভিড় করে আলোর মায়াবনে। রেলিংয়ে ঠেস দিতেই চোখ চলে যায়। মনে হয়, ওই আলোর মধ্যে কী যেনো ফেলে গেলাম!

মিনিট কুড়ির বিলম্ব কাটিয়ে ততোক্ষণে চলতে শুরু করেছে মধুমতি। সঙ্গে পাড়ি জমায় সারি সারি আলোর মশাল। নীল-লাল-সবুজ আলো। কলকারখানা, হাট-বাজার, বাসা-বাড়ির রকমারি আলোর বারতা আমাদের বুকপকেটে জমা হয় নিমেষেই। আমরা, আলোর যাত্রীরা গল্প নিয়ে ফিরি। যেমন ‘ছলাৎ ছল, ছলাৎ ছল/ঘাটের কাছে গল্প বলে নদীর জল…’। ছবি: শুভ্রনীল সাগর/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমদিন দু’য়েক আগে আকাশজুড়ে ছিলো পূর্ণিমার চাঁদ। সেই হিসাব অনুযায়ী, কৃষ্ণপক্ষ দ্বিতীয়া তিথি। এর মানে চাঁদের আকার ত্রয়োদশী-চতুর্দশীর কম নয়। কিন্তু চাঁদের দেখা কই?

জাহাজ লক্ষ্মী নদী শীতলক্ষ্যাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে ধলেশ্বরীতে এসে পড়ে। দু’ধারে কমতে শুরু করেছে ইটভাটা আর কারখানার আলো। এতোক্ষণে দেখা দিলো দুধভাতের গোল থালার মতো চাঁদ। এতোসব বাহরি আলোর ভিড়ে মুখ লুকিয়ে ছিলো বুঝি!

চাঁদমামার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিও জানান দিলো, এখন থেকে পৌষের রাজত্ব। পয়লা পৌষ স্বমহিমায় দেখা দিয়েছে বৃহস্পতিবার (১৫ ডিসেম্বর) থেকে। উত্তুরে হাওয়া আমাদের সুতি কাপড়ের শরীর ভেদ করে হু হু করে জাহাজের ডেক, সিঙ্গেল কেবিন আর কানের লতি কাঁপিয়ে দিয়ে চলে যায়। ছবি: শুভ্রনীল সাগর/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কিন্তু পৌষকে থোড়াই কেয়ার করে দুই শিশুযাত্রী রায়ান ও নিশা। সমানে দাপিয়ে চলেছে। মা কতো করে বুঝিয়ে চলেছে, শীতের কাপড় পরে নিতে। ডেক থেকেই নড়ানোই গেলো না! হয়তো ভাবছে চলে গেলেই বুঝি শেষ হয়ে যাবে নদী!

ইচ্ছে হয় ওদের গিয়ে বলি, তোমরা তেরো নদী পাড়ি দেবে বাবু। এই মধুমতি তোমাদের বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, মেঘনা, হিজলা, কীর্ত্তনখোলা, সুগন্ধা, বিষখালী, গাবখান, শরণখোলা, ঘষিয়াখালী ঘুরিয়ে পশুর নদীতে গিয়ে থামবে।

ওদের আর দোষ দিয়ে কী লাভ- বড়দের বয়সও যেনো অনেকটা কমে গেছে। আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠেছে ওদেরই মতন।

রাত বাড়ে আর কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়। চাঁদ মেঘনার কোল থেকে ক্রমশ মাঝ আকাশের বুকে গিয়ে ঠেকে। মেঘনার বিশুদ্ধ জলের উপর তার তখন একচ্ছত্র অধিকার। টানাজালে একসঙ্গে অনেক মাছ তুললে যেমন রোদের আলোয় মাছের আঁশ চিক চিক করে ওঠে, তেমনি জোয়ারের ফেনিল মঞ্চে ওঠে রুপালি নাচন। হঠাৎ দলধরে কচুরিপানা ভেসে যায়। চাঁদের আলোয় ওদের জেগে ওঠা চর বলে ঠাহর হয়।

সদরঘাটের পর মধুমতি প্রথম থামে চাঁদপুর ঘাটে। সরু নদী পেরিয়ে জাহাজ মেঘনার প্রশস্ত জলরাশির আলিঙ্গনে। গতিও আট, নয় নটিক্যাল মাইল থেকে ক্ষণে ক্ষণে বেড়ে দশ-এগারোতে গিয়ে ঠেকে।

চাঁদপুরে পৌঁছাতে সাড়ে দশটা হয়ে যায়। এর আগে শুরু হয়ে যায় খাওয়া-দাওয়ার তোড়জোড়। জাহাজের কর্মীরা কেবিনে কেবিনে গিয়ে খোঁজ নেন কে কী খাবে। অনেকেই আনন্দ করে খান জাহাজের ক্যান্টিনে। দোতলায় ক্যান্টিন, পাশে খোলা জায়গা, এর ওপাশে চা-কফির দোকান। কেউ নিচ্ছে মাছ-ভাত-মুরগির স্বাদ, কেউবা কাঁথা-কম্বল পেতে শীতের আরাম।

চায়ের দোকানে জোরে গান বাজছে। গান না আদা চা, কার লোভে বলা মুশকিল- ভিড় কমেই না!

রাত বাড়ে, এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে পৌষের দাপট। অমন ডাগর চাঁদ দেখলে মনও উতলা হয়। তাই আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে কেবিন ছেড়ে। রেলিংয়ে হাত ঠেকানো দৃষ্টিগুলো সুদূরপ্রসারী। ১৫ ডিসেম্বর পেরিয়ে যায়, ১৬ ডিসেম্বরের প্রথম প্রহর থেকে শুরু হয় মহান বিজয় দিবসের ক্ষণ। আলোর যাত্রীদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে শুক্রযোগ চাঁদ। এখানে যে থামার নয়…

বাংলাদেশ সময়: ১০১২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৬
এসএনএস/এটি

সহযোগিতায়

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ