আরব আমিরাতের মতো একটি মুসলিম দেশ বিশ্বের জন্য সত্যিই আল্লাহর পক্ষ হতে অসীম অনুগ্রহের নিদর্শন। এ দেশটি অর্থনৈতিকভাবে বেশ সমৃদ্ধ।
রমজান পদার্পনের সঙ্গে সঙ্গে আরব আমিরাতের প্রধান সড়কগুলোর চেনা রূপ পাল্টে যায়। এমনিতে সারা বছর সড়কগুলো থাকে পরিচ্ছন্ন, তার ওপর রমজান উপলক্ষে বাড়তি সাজসজ্জা ও পরিচ্ছন্নতা অভিযানের ফলে সড়কগুলো ঝকঝক করতে থাকে। সড়কবাতির পাশাপাশি রমজানের সম্মানে আলোকসজ্জার ফলে দেশজুড়ে বিরাজ করে অনন্য মায়াবী রূপময়তা।
দুবাইয়ে রমজান শুরুর ঘোষণা দেয় দি ইউনাইটেড আরব আমিরাত মুন সাইটিং কমিটি। রমজান উপলক্ষে সেখানকার মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময়ের সংস্কৃতি বেশ পুরনো। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষ থেকে দেশব্যাপী রমজান সংশ্লিষ্ট সামগ্রী বিতরণ করা হয়। এছাড়া মাহে রমজানে আন্তর্জাতিকভাবে এখানে কোরআন তেলাওয়াত প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়ে থাকে। রমজান এলেই যেনো পুরো দুবাই নতুন উদ্যমে সেজে ওঠে। দুবাইয়ের সংস্কৃতির আদল যেনো পাল্টে যায়।
আরব আমিরাতে একই দিনে রমজান শুরু হলেও সাহরি ও ইফতারে আলাদা সময়সূচি অনুসরণ করে শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায়। তবে সব মুসলিমই সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকে। বাণিজ্যিক হোটেলগুলো এ মাসে প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। শুধু ইফতারির পূর্বে খাবারের দোকানগুলো হরেক রকমের ইফতারির পসরা সাজিয়ে রাখতে দেখা যায়।
পবিত্র রমজান মাসে আরব দেশগুলোর ধনী ব্যক্তিরা সাধারণত জাকাত দানে উৎসাহী হন। কিন্তু তেল সম্পদের প্রাচুর্যে ধনী উপসাগরীয় দেশগুলোর স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে জাকাত নেওয়ার মতো কেউ নেই। তাই ধনকুবেরদের কাছ থেকে জাকাত গ্রহণের সুযোগটি নেন পৃথিবীর বিভিন্ন অনুন্নত দেশের মানুষ। রমজানে তারা উড়ে যান দুবাইসহ উপসাগরীয় দেশগুলোতে। দুবাইয়ের মতো জৌলুসময় নগরীগুলোতে ধনকুবেররা জাকাত গ্রহণের লোক পেয়ে অনেকটা স্বস্তির হাসি দিয়ে মুক্ত হস্তে দান করেন।
পবিত্র রমজান উপলক্ষে সংযুক্ত আরব আমিরাতে সরকারি অফিস ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসমূহে সকাল ৯টা থেকে ২টা পর্যন্ত ৫ ঘণ্টা অফিস টাইম ঘোষণা করা হয়। আমিরাতের ফেডারেল অথরিটি ফর হিউম্যান রিসোর্সেস (এফএএইচআর) ২০১৬ এর ১৭ নম্বর সার্কুলারে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। ২০১২ সালের ১৩ নম্বর ক্যাবিনেট ডিসিশন অনুযায়ী এ সার্কুলার ইস্যু করা হয়।
অপরদিকে, প্রাইভেট ও বেসরকারি অফিস ও প্রতিষ্ঠানসমূহে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও অফিস টাইম সকাল ৮টা থেকে ২টা পর্যন্ত ৬ ঘণ্টা রয়েছে। অনেক প্রাইভেট বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের প্রতিষ্ঠান বা কর্মচারীদের সুবিধামতো সকাল ৬টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ৬ ঘণ্টা অফিস টাইম নির্ধারণ করে থাকেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের নিজস্ব সময়সূচি অনুসারে সর্বোচ্চ ৬ ঘণ্টা পর্যন্ত চলছে।
‘অ্যারাবিয়ান বিজনেস’-এর দেওয়া তথ্যমতে, রমজানে সর্বোচ্চ চাহিদা রয়েছে, এমন পণ্যের দাম অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। সংযমের মাসে শাকসবজি ও ফলমূলের মতো জরুরি পণ্যগুলোর যেন কোনো সংকট তৈরি না হয়, মূলত সে লক্ষ্যেই দ্রব্যমূল্য কমানোর সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভোক্তা সুরক্ষা বিষয়ক পরিচালক ড. হাশিম আল নুয়াইমির বরাত দিয়ে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো এ কথা জানিয়েছে। ড. হাশমি সম্প্রতি আবুধাবিতে খুচরা বিক্রেতা প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এসময় তিনি উল্লেখ করেন, ২০১৪ সালের তুলনায় গত বছরের রমজানে খুচরা বিক্রি ২০ শতাংশ বেড়েছে।
এছাড়াও আরব আমিরাতে বিভিন্ন কোম্পানি তাদের ভোজ্যপণ্যের ওপর রমজানকে উপলক্ষ্য করে বিভিন্ন ছাড় দিয়ে থাকে। কেউবা দামে ছাড়, কেউ পরিমাণে বৃদ্ধি করে ভোক্তাদের এই সুবিধা দিয়ে থাকে। এখান থেকেও আমাদের শিক্ষা নেয়া উচিত। শুধু তাই নয়; পণ্যের মানের উৎকৃষ্টতা যেন বজায় থাকে সে দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া হয়। যাতে রোজা রেখে মানুষ কষ্ট না পায়। এছাড়া বিভিন্ন এনজিও ও বড় বড় ব্যবসায়ী রমজানকে সামনে রেখে তাদের বিশেষ কার্যক্রম হাতে নিয়ে থাকে। যাতে মানুষ সুন্দরভাবে রমজানের এই মহান মাসটিতে নির্বিঘ্নে সিয়াম সাধনা করতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোতেও একই অবস্থা পরিলক্ষিত হয়।
এ মাসে প্রতি বছর স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাংলাদেশি মালিকানাধীন বিপণি বিতানগুলোতেও ছাড় দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে বিক্রয়ে বেশ সাফল্যও পেয়েছেন বলে জানালেন বাংলাদেশি কয়েকজন ব্যবসায়ী। তারা জানান, পণ্যে বিশেষ ছাড় ও মান বিবেচনায় সস্তা পেয়ে অনেক প্রবাসী আমিরাত থেকে মালামাল কিনে কার্গোর মাধ্যমে পাঠাচ্ছেন নিজ নিজ দেশে। আরব আমিরাতের আবুধাবি ও দুবাইয়ের শপিং মলে আগত বাংলাদেশি ক্রেতারা জানান, দেশমাতৃকার মায়া ত্যাগ করে পরদেশে আসা প্রবাসীরা রমজানে এমন বিশেষ ছাড় পেয়ে খুবই খুশি। তারা আশা করেন, বাংলাদেশেও ব্যবসায়ীরাও রমজান উপলক্ষে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম মানুষের নাগালের মধ্যে রাখবেন।
রমজান উপলক্ষে সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকার এক হাজারের বেশি কারাবন্দিকে মুক্তি দিতে যাচ্ছে। আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ খলিফা বিন জায়েদ আল নাহিয়ান ১ জুন ২০১৬ বুধবার এ ঘোষণা দিয়েছেন বলে দেশটির বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম জানায়। কারাবন্দিরা যেনো সংশোধন হয়ে পরিবারের মাঝে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারে- সে জন্য এ সুযোগ দেওয়া হচ্ছে বলে সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়।
মহিমান্বিত এ মাসে রোজাদারদের প্রতি এ দেশের লোকদের যে কি অপার শ্রদ্ধাবোধ তা চোখে না দেখলে বুঝা যাবে না। তাদের ইফতার আতিথেয়তার রীতিমতো রূপকথার মতো। প্রতি রমজানের মতো এবারও সরকারি ও বেসরকারিভাবে পাড়া-মহল্লায় কিংবা বড় বড় মসজিদের পাশে তাঁবু টাঙিয়ে বিশাল প্যান্ডেল বানিয়ে ব্যাপকভাবে ইফতার আয়োজনের পাশাপাশি আরবদেরকে রাস্তায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে গাড়ি থামিয়েও ইফতার বিতরণ করতে দেখা যায়। এই তো সোমবার (১৩ জুন) দেখা গেল ইফতার আতিথেয়তার বিরল এক চিত্র। ওইদিন আরব আমিরাত মিনিস্টার অফ স্টেট ফর ইয়ুথ শাম্মা সুহাইল ফারিস আল মাজরুইকে রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে নিজ হাতে ইফতার বিতরণ করেন।
এছাড়া ইফতারের সময় একজন অন্যজনকে প্রাধান্য দেয়া কিংবা জোর করে ইফতারে শরিক করানো দেখলে মনে হবে যেন হাজার বছর ধরে বংশ পরম্পরায় ধারণ করা আতিথেয়তার গুণটি আরবরা এখনো ধরে রাখার নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন পুরোদমে।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩৬ ঘণ্টা, জুন ১৮, ২০১৬
এমএইউ/