আল্লামা মাহমূদুল হাসান। দেশের অন্যতম শীর্ষ আলেমদের একজন।
পবিত্র রমজান মাস সহজে আল্লাহর ওলি হওয়ার মাস। অাল্লাহর প্রিয় হওয়ার মাস। হজরত মুজাদ্দেদে আলফে সানি (রহ.) বলেছেন, সত্তর বছর ইবাদত-রিয়াজত করে যে মর্যাদা পাওয়া যায়, এ মাসে সেই মর্যাদা লাভ করে সহজেই আল্লাহর প্রিয় হওয়া যায়। আল্লাহর অসংখ্য বান্দা এ মাসে ইবাদত-মুজাহাদা করে আল্লাহর মারেফাত লাভে ধন্য হন। তাই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ এ মাসেও যদি অবহেলা ও গাফলতের চাদর শরীরে ঝুলিয়ে রাখি। দুনিয়া-আখেরাতের মহা কামিয়াবি থেকে বঞ্চিত হই তাহলে এর চেয়ে বদনসিবি আর কিছুই হবে না।
আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘ওহে ঈমানদার! তোমাদের পূর্ববর্তী পুরুষদের ওপর যেমন রোজা ফরজ ছিল, তোমাদের ওপরও তেমনি রোজা ফরজ করা হয়েছে, যাতে তোমরা আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হও। ’
এ মাস ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতার মাস। সহানুভূতি ও সমবেদনা জ্ঞাপন করার এটাই উপযুক্ত মাস। এ মাসে মুমিনদের রিজিক বর্ধিত করা হয়। যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, তার জন্য এটি মাগফেরাত ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির উসিলা হবে। আর রোজাদার ব্যক্তিও সমপরিমাণ সওয়াবের ভাগি হবে, অথচ রোজাদারের সওয়াব হতে কিছুই হ্রাস হবে না।
এ মাসের প্রথম ভাগ দয়া, মধ্যভাগ ক্ষমা এবং শেষভাগ জাহান্নাম থেকে মুক্তির। এ মাসে যারা অধীনস্ত কর্মচারীদের পরিশ্রম কমিয়ে দেয়। আল্লাহ তাদের সমূহ গোনাহ ক্ষমা করে দেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন।
এ মাসের পূর্ণ সওয়াব হাসিল করতে হলে কিছু করণীয় বিষয় রয়েছে। তেমনি বর্জনীয় বিষয়ও আছে। এসব কাজের কয়েকটি ছাড়া প্রায় প্রত্যেকটি বছরের সব মাসেই পালনীয়। সেগুলো হলো-
করণীয় বিষয়সমূহ
-নিজে রোজা রাখা। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন এবং অধীনস্তদেরকে ভালোবাসা ও দরদের সঙ্গে রোজা রাখার জন্য অনুপ্রাণিত করা। অন্যান্য প্রতিবেশীর কাছেও রোজা রাখার দাওয়াত পেশ করা।
-নিয়মিত তাকবিরে উলার সঙ্গে জামাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়া করা।
-অধিক পরিমাণে কোরআন তেলাওয়াত করা।
-প্রতিদিন খতমে তারাবির নামাজের শরিক হয়ে পুরো কোরআন শরিফ শোনা।
-সাহরি খাওয়ার আগে বা পরে তাহাজ্জুদ আদায়া করা।
-প্রত্যেক নামাজের আগে-পরে জিকির, তাসবিহ-তাহলিল অধিক পরিমাণে পাঠ করা।
-তাসবিহে ফাতেমিসহ অধিক পরিমাণে দরুদ শরীফ পড়া।
-মৃত মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীর জন্য দোয়া করা।
-ছোট-বড় সব গোনাহ থেকে একনিষ্ঠভাবে তওবা-ইস্তেগফার করা।
-বান্দার হক আদায় করা। প্রয়োজনে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া।
-অধিক পরিমাণে দান-খয়রাত করা।
-রমজানের শেষ দশ দিনে ইতেকাফ করা।
বর্জনীয় বিষয়াদি
-নিজ বাসা-বাড়ি গোনাহমুক্ত রাখা। মনে রাখা উচিত, গোনাহ ইহকাল ও পরকালের জন্য সর্বনাশের কারণ। তাই সব ধরনের গোনাহ থেকে সম্পূর্ণভাবে বেঁচে থাকা। বিশেষ করে গীবত-পরনিন্দা, অপপ্রচার, দোষচর্চা, মিথ্যা, কান কথা, গালাগালি, ঝগড়া-কলহ, নাচ-গান-বাদ্য, বেপর্দা, সিনেমা, টিভি, মদ, জুয়া, অর্থলোভ, অন্যায়ভাবে অপরের সহায়-সম্পত্তি দখল করা, মানুষকে কষ্ট দেওয়া, ঠকানো, ধোঁকা দেওয়া ইত্যাদি থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকা। আর এসব করে থাকলে খাঁটি মনে তওবা করা এবং আগামীতে গোনাহ থেকে বিরত থাকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করা।
-অনেকের বাড়ির পাশে মসজিদ আছে। যেখানে অসংখ্য মুসল্লি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে থাকেন। অতএব, এমন কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকা, যার কারণে মুসল্লিদের নামাজ ও ইবাদতের ক্ষতি হয়। যারা দোকানে, বাসা-বাড়িতে, বিয়ে-শাদী ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উচ্চৈস্বরে মাইক বাজিয়ে থাকেন, এতে নামাজি ও ইবাদতকারীর কতটুকু অসুবিধা হয়, তা আমরা কখনো ভেবে দেখি না। এটিই মোটেই উচিত না।
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে আল্লাহর মসজিদগুলোতে তার নাম উচ্চারণ করতে ব্যাঘাত ঘটায় এবং তা ধ্বংস করতে প্রয়াস পায়, তার চেয়ে অধিক অত্যাচারী আর কে হতে পারে?’
-বিদআত, কুফুর ও শিরক থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা।
-অসৎ লোকের সংশ্রব থেকে দূরে থাকা।
-দোকানদারদের রোজাদারদের প্রতি সম্মানার্থে পর্দার আড়ালে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবসা বর্জন করা। কারণ, রিজিকের মালিক স্বয়ং আল্লাহ। তার অসন্তুষ্টি আজাব-গজবের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই এহেন কাজ থেকে বিরত থাকা। অন্যের পাপের বোঝা কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকা।
হজরত আশরাফ আলী থানবী (রহ.) বলেছেন, এক অমুসলিম লোক তার সন্তানকে রমজান মাসে দিনের বেলায় প্রকাশ্যে পানাহার করতে দেখে তাকে ধমক দিয়ে রোজাদারের প্রতি সম্মান করে প্রকাশ্যে পানাহার থেকে বিরত থাকতে বলে। তখন ছেলেটি বলল, আমরা তো মুসলমান নই, তাহলে আমাকে পানাহার থেকে বিরত থাকতে বলছেন কেন? পিতা বললেন, তোমার কথা সঠিক বটে, কিন্তু মুসলমানরা আমাদের প্রতিবেশী। সুতরাং তাদের ধর্মীয় বিষয়াদির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাশীল হওয়া মানবতার দাবি।
ওই লোকটির মৃত্যুর পর স্বপ্নে এক বুজুর্গ তাকে জান্নাতে ঘুরতে দেখে জিজ্ঞেস করল, হে লালাজি! তুমি তো অমুসলিম। জান্নাত পেলে কিভাবে? লালাজি উত্তরে বলল, আমার ছেলে রমজান মাসে দিনের বেলায় দোকানে বসে প্রকাশ্যে পানাহার করার সময় আমি মুসলমানদের ধর্মের প্রতি ও রমজান মাসের প্রতি শ্রদ্ধা করে তাকে ধমক দিয়েছিলাম। প্রকাশ্যে পানাহার না করার উপদেশ দিয়েছিলাম। এর বরকতে মহান আল্লাহ আমাকে মৃত্যুর পর জান্নাত দিয়ে সৌভাগ্যশীল করেছেন।
তাই আমাদেরকে এ ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেও গোনাহের কাজ পরিহার করতে হবে। আল্লাহ পাক এ সমস্ত কথা সকল মুসলমানকে মানার তওফিক দান করুন। আমিন।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৫ ঘণ্টা, জুন ২৯, ২০১৬
এমএইউ/