ঢাকা: প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) অনুমোদন পাওয়ার আগে প্রাইভেট প্লেসমেন্ট শেয়ার ছেড়ে অর্থ সংগ্রহ করলেও সঠিক সময়ে বাজারে আসতে পারেনি একাধিক কোম্পানি। ফলে প্লেসমেন্টে প্রায় আটশ কোটি টাকা আটকে আছে হাজার হাজার বিনিয়োগকারীর।
জানা গেছে, বতর্মানে মোট ১৮টি কোম্পানির প্রায় আটশ কোটি টাকা প্রাইভেট প্লেসমেন্টে আটকে আছে। পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিনিয়োগকারীদের এ টাকা আটকে আছে।
নিয়ম অনুযায়ী পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) ব্যবস্থা নেওয়ার কথা থাকলেও তারা নিচ্ছে না। বিএসইসি বলছে, কোম্পানিগুলো নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছ থেকে আইপিওর মাধ্যমে পুঁজি উত্তোলনের অনুমোদন নেয়। কোনো কোম্পানিকে প্লেসমেন্টের মাধ্যমে পুঁজি উত্তোলনের অনুমোদন দেয় না। তাই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো এখতিয়ার তাদের নেই।
তবে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে এ বিষয়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সরাসরি হস্তক্ষেপ করে থাকে। যেমন- ভারতের সাহারা গ্রুপ প্লেসমেন্টের মাধ্যমে ৩ কোটি বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে ১৫ হাজার কোটি রুপি সংগ্রহ করেছিল। যাতে সে দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়ার (সেবি) অনুমোদন ছিল না। পরবর্তীতে আদালতে মামলা করায় ২০১২ সালে ৩ বছরের সুদসহ টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেন আদালত। আর সব টাকা পরিশোধ না করায় কোম্পানির চেয়ারম্যান সুব্রত রায় সাহারাকে গ্রেফতার করা হয়।
এ বিষয়ে বিএসইসির মুখপাত্র মো. সাইফুর রহমান বলেন, ২০০৯-১০ সালে কমিশন কয়েকটি কোম্পানিকে মূলধন সংগ্রহের অনুমোদন দিয়েছিল। কিন্তু প্লেসমেন্ট বিক্রির অনুমোদন দেয়নি। আর যাদের টাকা প্লেসমেন্টে আটকে আছে, সেসব কোম্পানির অধিকাংশ এই সময়ে পুঁজি উত্তোলনের জন্য বিএসইসির অনুমোদন নিয়েছিল। এই সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন কোম্পানি প্লেসমেন্টের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করেছে। এরপর প্লেসমেন্টের ব্যাপারে আলাদা আইন করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, যারা প্লেসমেন্ট শেয়ার ক্রয় করেছে, তারা ওই কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার। তাই যেসব কোম্পানি আইপিওতে আসছে না বা লভ্যাংশ দিচ্ছে না সে কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে তারা কোম্পানি আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে পারে।
মো. সাইফুর রহমান আরও বলেন, অন্যান্য দেশে নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রির অনুমোদন দিলেও আমাদের দেশে সে নিয়ম নেই। তাই বিষয়টি নিয়ন্ত্রক সংস্থার এখতিয়ার নয়।
জানা যায়, গত ৫ বছরে ৪২টি কোম্পানি প্লেসমেন্টের মাধ্যমে ৪ হাজার ১২৯ কোটি ৩১ লাখ টাকা সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে ২১টি কোম্পানি বাজারে আইপিওর মাধ্যমে শেয়ার ছেড়েছে।
জিএমজি এয়ার লাইনস এবং এসটিএস হোল্ডিংসের আইপিও আবেদন বাতিল করা হলেও প্লেসমেন্টের সম্পূর্ণ অর্থ ফেরত দেয়নি। এছাড়া লংকা-বাংলা সিকিউরিটিজ কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরত দিয়েছে।
অন্যদিকে, শেয়ারবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহে আগ্রহী ১৮ কোম্পানির প্লেসমেন্ট শেয়ারে আটকে আছে বিনিয়োগকারীদের ৭৮৩ কোটি ৩ লাখ টাকা। যেসব কোম্পানিতে টাকা আটকে আছে তার মধ্যে- আনন্দ শিপইয়ার্ডে ১৪০ কোটি, ফাইবার শাইনে ১৫ কোটি, ইফাদ অটোয় ২০ কোটি, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডে ৪৮ কোটি, কেয়া কটন মিলে ১২ কোটি টাকা, এনার্জি প্রিমায় ১৫৫ কোটি ১০ লাখ টাকা, রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলে ২৫ কোটি টাকা এবং মোহাম্মদ ইলিয়াস ব্রাদার্স ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্টে ৬০ কোটি টাকা আটকে আছে।
এছাড়া হামিদ ফেব্রিকসে ৩০ কোটি ৯৬ লাখ, সাইফ পাওয়ারটেকে ২৭ কোটি ৬৩ লাখ, টুং হাই নিটিং অ্যান্ড ডাইংয়ে ২০ কোটি ৮৩ লাখ, এনার্জি প্যাক পাওয়ার জেনারেশনে ১৫০ কোটি ৭০ লাখ, খান ব্রাদাস পিপি ওভেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজে ৬ কোটি ৫ লাখ, সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজে ২৪ কোটি ৩৫ লাখ, এরিয়ান কেমিক্যাল ১৭ কোটি, মিয়ামকো জুট মিলসে ১৬ কোটি ৯৩ লাখ, তসরিফা ইন্ডাস্ট্রিহে ৬ কোটি এবং ইয়াকিন পলিমার ৭ কোটি ৪ লাখ টাকা আটকে আছে।
তবে ইতিমধ্যে রতনপুর স্টিল, সাইফ পাওয়ারটেক ও সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানিকে আইপিও অনুমোদন দিয়েছে বিএসইসি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কোম্পানি প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রির আগে ঘোষণা দেয়। তাই এসব কোম্পানির প্রতি নজরদারি করা উচিত। কোনো কোম্পানি প্লেসমেন্টের টাকা নেওয়ার পর আইপিওতে আসতে ব্যর্থ হলে বিএসইসিকে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। আইপিও অনুমোদন না পেলে প্লেসমেন্টের টাকা ফেরত দিতে কোম্পানিকে বাধ্য করতে হবে। আর কোম্পানি যদি কোনো আইন ভঙ্গ করে থাকে, তবে ওইসব কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস (এআইএ) বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. মিজানুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘কোম্পানিগুলো যখন প্লেসমেন্ট বিক্রি করে তখন তারা বিনিয়োগকারীদের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাজারে আসবে এবং তাদের নিয়মিত লভ্যাংশ দেবে। কিন্তু যখন দীর্ঘদিন পার হয়ে যায়, তখন বাজারে না আসতে পারলে নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত তাদের টাকা ফেরত পাওয়ার ব্যবস্থা করা। ’
তিনি আরও বলেন, এছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থা যেসব কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দেওয়া সম্ভব নয় তা সরাসরি বলে দিলে বিনিয়োগকারীদের প্লেসমেন্ট আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে। তা না করলে দীর্ঘদিন ধরে টাকা আটকে থাকে। যা বাজারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কারণ বিনিয়োগকারীরা তা থেকে কোনো মুনাফা পায় না।
বাংলাদেশ সময়: ১০৪৫ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০১৪