ঢাকা: দেশের শেয়ারবাজারের ভয়াবহ কলঙ্কের অধ্যায় ২০১০ সালের ডিসেম্বর। এরপর একে একে পার হয়েছে সাড়ে ৩ বছরেরও বেশি সময়।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, পুঁজিবাজারের গতি ফেরাতে সরকারের পক্ষে থেকে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুর্বল নিয়ন্ত্রক সংস্থার কারণে তার কোনো সুফল পায়নি দেশের পুঁজিবাজার। বরং নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যর্থতায় গতি হারিয়ে তলানিতে ঠেকেছে।
ডিএসই’র সাবেক সভাপতি আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, ধসের পর বিভিন্ন কারণে মার্চেন্ট ব্যাংক, ব্রোকারেজ হাউজসহ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ সক্ষমতা হারিয়েছে। কিন্তু গত সাড়ে ৩ বছরে কেউ তাদের সক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। যে কারণে বাজারে বর্তমান অবস্থা বিরাজ করছে।
তিনি বলেন, ক্যান্সার হলে কেমো দিতে হয়। কিন্তু চুল পড়ে যাওয়ার ভয়ে যদি কোমো না দেওয়া হয় তবে চিকিৎসা পাওয়া যাবে না। ঠিক তেমনি সাময়িক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে- এ ভয়ে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকাও পুঁজিবাজারের জন্য ক্ষতিকর হয়েছে। পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করতে হলে আগে বিনিয়োগ সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এজন্য যার যে দায়িত্ব তা সঠিকভাবে পালন করতে হবে। প্রয়োজনে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), ঢাকা স্টাক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জকে (সিএসই) সম্মিলিতভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান ও তথ্যপদ্ধতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, বাজারে বড় বিনিয়োগকারী ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা নীরবতা পালন করছেন। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আস্থাহীনতাই ভূগছে এটি সত্য। তবে শেয়ারবাজারের বড় সমস্যা হলো নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বলতা। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাজারের উন্নয়নে ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। ফলে বাজার পতনের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না।
তিনি বলেন, শেয়ারবাজারের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিকে ঢেলে সাজাতে হবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার পুর্নগঠন ও শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক সংস্থা ছাড়া বাজারের উন্নয়ন সম্ভব নয়।
বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১০ সালে ফুলে ফেঁপে ওঠে শেয়ারবাজার। ওই বছরের ৫ ডিসেম্বর প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাধারণ সূচক পৌঁছে আট হাজার ৯১৮ পয়েন্টে। লেনদেন হয় তিন হাজার ২৪৯ কোটি টাকা। আর বাজার মূলধন দাঁড়ায় তিন লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা।
এরপরই শুরু হয় কলঙ্কের অধ্যায়। নামতে থাকে ধস। মূল ধসের শুরু হয় ৮ ডিসেম্বর থেকে। ওই দিন লেনদেনের প্রথম সোয়া এক ঘণ্টার মধ্যে ডিএসইতে সাধারণ সূচকের ৫৪৪ পয়েন্ট পতন ঘটে।
সেদিন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি (সাবেক এসইসি) থেকে চেক নগদায়ন না হওয়া পর্যন্ত শেয়ার ক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং ম্যাচিউরড শেয়ার বিক্রয় করে শেয়ার ক্রয়ে আগাম অর্থায়ন সুবিধা বাতিল করা হয়। মূলত নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ নির্দেশনার কারণে এমন পতন বলে সে সময় ধারণা করা হয়। ফলে পরিস্থিতি সামাল দিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওই দিনই নির্দেশনা দু’টি স্থগিত করে।
এতে তাৎক্ষণিকভাবে বাজার ঘুরলেও দিন শেষে ঠিকই সূচকের পতন ঘটে ১৩৪ পয়েন্ট। এরপর পতই যেন নিয়তি হয়ে ওঠে শেয়াবাজারের। চারদিন পর ১২ ডিসেম্বর সূচকের পতন ঘটে ২৮৫ পয়েন্টের। এটি ছিলো ১৯৯৬ সালের পর শেয়ারবাজারে সবচেয়ে বড় পতন। তবে রেকর্ড যেন সৃষ্টি হয় রেকর্ড ভাঙ্গার জন্য, এর প্রমাণ পাওয়া যায় পরের সপ্তাহে ১৯ ডিসেম্বর। এদিন বাজারে নামে মহাধস। সূচকের পতন ঘটে ৫৫১ পয়েন্ট।
এ পতনের পর আর মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি দেশের শেয়ারবাজার। ব্যর্থ হয়েছে সরকারের সব প্রচেষ্টাও। প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে ২১ দফার বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ, নিয়ন্ত্রক সংস্থার পুর্নগঠন কোনো কিছুই কাজে আসেনি। সর্বশেষ চলতি অর্থবছরের বাজেটে বিনিয়োগকারীদের ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স বা মূলধনী আয়ের মুনাফা কর প্রত্যাহার করা হলেও তার সুফল পাচ্ছে না শেয়ারবাজার।
পতন থেকে শেয়ারবাজরের উত্তরণের জন্য সরকার প্রধান পদক্ষেপ নেয় ২০১১ সালে। সে সময় নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খোন্দকারসহ সব সদস্যকে বিদায় করে দিয়ে নতুন করে কমিশন পুর্নগঠন করা হয়। ওই বছরের মে মাসে নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ড. এম খায়রুল হোসেনকে।
দায়িত্ব নিয়েই খায়রুল হোসেন ঘোষণা দেন, ৩ মাসের মধ্যে শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা হবে। আর না পারলে দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন। সে সময় তিনি বলেছিলেন, পুঁজিবাজারে বর্তমানে নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আমি এসব বিষয়ে অবগত। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাই হচ্ছে আমাদের প্রধান লক্ষ্য। আমাদের হারানোর কিছু নেই। পুঁজিবাজারের উন্নয়নের জন্য যদি কাজ করতে না পারি তাহলে দায়িত্ব ছেড়ে দিতে কুন্ঠাবোধ করবো না।
খায়রুল হোসেনের ওই ঘোষণার পর ৩ মাস নয়, পার হয়ে গেছে ৩ বছরেরও বেশি সময়। এ সময়ের মধ্যে পুঁজিবাজার ধস কাটিয়ে ওঠা তো দূরের কথা, উল্টো তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নানা ব্যর্থতার কারণে। মন্দা বাজারে উচ্চ প্রিমিয়ামে একের পর কোম্পানির প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) অনুমোদন, রাইট শেয়ার ইস্যুর অনুমোদন, প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে ব্যর্থতা রয়েছেই। নেওয়া হয়নি ধসের ফলে হারানো বিনিয়োগ সক্ষমতা ফিরিয়ে আনার কোনো পদক্ষেপও। রয়েছে মিউচুয়াল ফান্ডের বিধিমালা সংশোধন, পরিচালকদের ২ শতাংশ শেয়ার ধারণে বাধ্যবাধকতা আরোপের ক্ষেত্রেও ব্যর্থতার ছাপ।
এসবের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠী নানাভাবে শেয়ারবাজার থেকে নিজেদের ফায়দা হাসিল করে নিয়েছে বলে অভিযোগ আছে। এসব কারণে পতন কাটিয়ে আর মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি শেয়ারবাজার। বরং ৫০ শতাংশের মতো মূল্য সূচক হারিয়েছে শেয়ারবাজার।
সর্বশেষ গত ১০ জুলাই লেনদেন শেষে ডিএসই’র সূচক দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৩৬৩ পয়েন্টে। লেনদেন হয়েছে মাত্র ১৭৭ কোটি টাকা। আর বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা। এ দিন টানা অষ্টম দিনের মতো ডিএসইতে সাধারণ মূল্য সূচকের পতন ঘটে।
এসব বিষয়ে কথা বলতে বিএসইসি’র চেয়ারম্যান ড. খায়রুল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ সময়: ২০২৩ ঘণ্টা, জুলাই ১২, ২০১৪