ঢাকা: ব্যাংকগুলোর শেয়ার দরে তাদের অর্জিত মুনাফার কোনো প্রভাব পড়ছে না। অথচ ভালো মুনাফা করে যাচ্ছে পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত ব্যাংকগুলো।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, গত বছর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থাকায় ব্যাংকগুলো ভালো ব্যবসা করতে না পারায় লোকসান হয়েছিল বা মুনাফা কমেছিল। কিন্তু চলতি অর্থবছরের শুরুতে ব্যাংকগুলো সরকারি ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করে। যা থেকে তাদের মুনাফার সিংহভাগ এসেছে। কারণ, অর্ধবার্ষিকী সময়ে বন্ডের সুদের হার অনেক বেশি ছিল। এছাড়া এলসি থেকে কমিশন ও বিদেশিদের পাঠানো রেমিটেন্স থেকেও ব্যাংকগুলোর অনেক আয় হয়েছে। তবে বছর শেষে নিরীক্ষিত প্রতিবেদন অনুযায়ী শেয়ার দর বাড়তে বা কমতে পারে।
তালিকাভূক্ত ৩০ ব্যাংকের প্রথমার্ধের অনিরিক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রায় ৮০ শতাংশ ব্যাংকের মুনাফা বাড়লেও তার কোনো প্রভাব নেই এসব ব্যাংকের শেয়ার দরে। ফলে ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগ করে কয়েকশ’ কোটি টাকা আটকে আছে বিনিয়োগকারীদের।
জানা গেছে, গত ৩০ জুন পর্যন্ত হিসাবে ব্যাংকগুলোর অর্ধবার্ষিকীতে (জানুয়ারি থেকে জুন-২০১৪) ২৩টি ব্যাংকের মুনাফা বৃদ্ধি পেয়েছে, কমেছে ৫টির এবং লোকসান করেছে মাত্র ২টি ব্যাংক।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, ন্যাশনাল ব্যাংক গত বছর অর্ধবার্ষিকীতে লোকসান করেছিল ১৮৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। আর চলতি অর্থবছরের অর্ধবার্ষিকীতে লোকসান কাটিয়ে মুনাফা করেছে ১১৯ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।
গত বছর অর্ধবার্ষিকীতে বিপুল পরিমাণ লোকসানে থেকেও এ কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়েছিল ১২-১৩ টাকায়। কিন্তু চলতি অর্থবছরে বিপুল পরিমাণ মুনাফা করে এ কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হচ্ছে মাত্র ১০ টাকায়।
শুধু ন্যাশনাল ব্যাংকই নয়, অধিকাংশ ব্যাংক ভালো মুনাফা করলেও তার প্রভাব শেয়ার দরে পরছে না। ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ব্যাংকের শেয়ার নিয়ে হতাশা বাড়ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ব্যাংকগুলো মুনাফা করলেও তার প্রভাব শেয়ার দরে পড়ছে না। তার প্রধান কারণ, ব্যাংকের ওপরে বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে। অন্য খাতের কোম্পানির শেয়ার মাঝে মাঝে বাড়লেও দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংক শেয়ার দর নিম্নমুখী। তবে ব্যাংকগুলো ধারাবাহিকভাবে মুনাফা করতে থাকলে ভবিষ্যতে শেয়ার দরের ইতিবাচক পরিবর্তন হবে।
হিসাব মতে, গত অর্থবছরের অর্ধবার্ষিকীতে (জানুয়ারি থেকে জুন-২০১৩) ন্যাশনাল ব্যাংকের লোকসান হয়েছিল ১৮৬ কোটি ৭৫ লাখ। চলতি অর্থবছর একই সময়ে ব্যাংকটি মুনাফা করেছে ১১৯ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। সুতরাং, ব্যাংকটির মুনাফা বেড়েছে ৩০৬ শতাংশের কিছুটা বেশি।
অন্যদিকে, প্রিমিয়ার ব্যাংক গত বছর ২০৪ কোটি টাকা লোকসান করলেও চলতি বছরে ৩৪ কোটি টাকা, প্রাইম ব্যাংক ৬৫ কোটি টাকা লোকসান কাটিয়ে ১০১ কোটি ২০ হাজার টাকা মুনাফা করেছে।
এছাড়া চলতি বছরে ইউসিবিএল’র মুনাফা ১০৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ১৯৪ কোটি টাকা, পূবালী ব্যাংকের মুনাফা ১১২ কোটি ৬০ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ১৬৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা, আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংকে মুনাফা ৬৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ১১৭ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, এবি ব্যাংকের মুনাফা ৩৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ৮০ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, এসআইবিএল’র মুনাফা ২৪ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৬১ কোটি ৭০ লাখ টাকা, সাউথ-ইস্ট ব্যাংকের মুনাফা ১১৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ১৫৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা, সিটি ব্যাংকের মুনাফা ৪০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৭৪ কোটি ২০ লাখ টাকা, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের মুনাফা ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ৩৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, এক্সিম ব্যাংকের মুনাফা ৩৫ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৬৫ কোটি ৯৩ লাখ টাকা, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের মুনাফা ২২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ৪৩ কোটি টাকা, উত্তরা ব্যাংকের মুনাফা ৫২ কোটি ৩০ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ৭২ কোটি টাকা, আইএফআইসি’র মুনাফা ৪৫ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৪৬ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, যমুনা’র মুনাফা ৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ২৮ কোটি টাকা, স্টান্ডার্ড ব্যাংকের মুনাফা ৪৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ৬৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ব্যাংক এশিয়ার মুনাফা ৪৯ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৬৬ কোটি টাকা, ডাচ-বাংলা মুনাফা ৮১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ৯২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, ঢাকা ব্যাংকের মুনাফা ৪০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৫০ কোটি টাকা, এনসিসি ব্যাংকের মুনাফা ২৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৩৫ কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের মুনাফা ২৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ৩০ কোটি ৩৮ লাখ টাকা, ট্রাস্ট ব্যাংকের মুনাফা ৩৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ৩৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা হয়েছে।
অন্যদিকে, ব্র্যাক ব্যাংকের মুনাফা ৯৭ কোটি টাকা থেকে কমে ৯৫ কোটি ৯২ লাখ টাকা, ইস্টার্ন ব্যাংকের মুনাফা ৯৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকা থেকে কমে ৯৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা, ওয়ান ব্যাংকের মুনাফা ৪৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকা থেকে কমে ৪৩ কোটি ৬৭ লাখ টাকা, রূপালী ব্যাংকের মুনাফা ৭৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা থেকে কমে ২৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা, ইসলামী ব্যাংকের মুনাফা ১৫৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা থেকে কমে ৯৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা হয়েছে।
এছাড়া আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের লোকসান ৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ২৬ কোটি ২৯ লাখ টাকা হয়েছে এবং শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক গত বছর ২০ কোটি ৭০ লাখ টাকা মুনাফা করলেও চলতি অর্থবছরের অর্ধবার্ষিকীতে ৪৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা লোকসান করেছে।
প্রাইম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এহসান খসরু বলেন, আগে ব্যাংকগুলোর মুনাফা কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দেখানো হতো। বাংলাদেশ ব্যাংক এগুলো একটি সিস্টেমের মধ্যে আনার চেষ্টা করছে। যার কারণে ব্যাংকগুলোর মুনাফায় ভাটা পড়েছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে চিন্তা করলে এটা সঠিক সিদ্ধান্ত। তাই আপাতত ব্যাংকের শেয়ার মুনাফার প্রভাব না পড়লেও ভবিষ্যতে বিনিয়োগকারীরা এর সুফল ভোগ করতে পারবেন বলে আশা করা যায়।
বাংলাদেশ সময়: ১২০২ ঘণ্টা, আগস্ট ০৭, ২০১৪