নাস্তা শেষ করে এসে আবার শুলাম। সময় কাটছে না।
১. ২৩ জুলাই, রোববারও এখানে ছুটির দিন। শহরের ইয়ুথ ফুটবল একাডেমি মাঠে খেলার আয়োজন। সিঙ্গাপুরে অবস্থানরত বিভিন্ন দেশের অভিবাসীরা অংশ নিচ্ছেন এ টুর্নামেন্টে। দ্বিতীয় রাউন্ডের খেলায় বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ সিঙ্গাপুর। বাংলাদেশ থেকে আসা অভিবাসী শ্রমিকরা সিঙ্গাপুরের পেশাদার ফুটবলারদের সঙ্গে পেরে উঠছিল না। তবে প্রাণপনে লড়াই করে যাচ্ছিল বাঙ্গালি তরুণরা।
২. আগের দিন বিকেলেই চলে এসেছে দামার হারসানতো। ২৪ জুলাই, সোমবার সকাল থেকে প্রস্তুতি তেমাসেক ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দুপুরের খাবারের। সকলেই নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরেছেন। পহেলা বৈশাখের আদলেই পাঞ্জাবি পড়লাম আমি। চৈতন্য মোদি পাঞ্জাবি(হাফ হাতা) ও কোট পরলো। দামাড়ের পরনে ইন্দোনেশিয়ার লম্বা শার্ট। কেন্ট ভেল অ্যাপার্টমেন্টের নিচে সবাই অপেক্ষা করছিল।
মালয়েশিয়ার দুই নারী পরেছেন বাতু কুরং। ঈগল ব্রডকাস্টিং টেলিভিশনের প্রযোজক এবং সাংবাদিক বোলর জানখু এজেএফ’র ৯ বছরের ইতিহাসে প্রথম অংশগ্রহণকারী মঙ্গোলিয়ান। তার পরনে ঝলমলে নীল পোশাক। এর নাম পায়া লাবের। এই পোশাক মায়ের কাছ থেকে পেয়েছেন তিনি।
ভিয়েতনামের হোচি মিন সিটি'র বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক পত্রিকার সাংবাদিক হাওং মি পরেছেন নিজ দেশের ঐতিহ্যবাহী পোশাক আও দাই। এটা আমাদের পাঞ্জাবির মতোই। তবে নিচের দিকটা অনেক বেশি দীর্ঘ।
১৬ জনের দলকে ন্যাশনাল গ্যালারি অব সিঙ্গাপুরে জাতীয় রেস্টুরেন্ট ভায়োলেট নুনে দুপুরের খাবার খাওয়ালো তেমাসেক ফাউন্ডেশন। খাবারের টেবিলে পরিচয় হলো এখানকার গবেষক আসাদ লতিফের সঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গের আসাদ লতিফ আমাকে পেয়ে বললেন, যাক শান্তিমতো বাংলায় কথা বলা যাবে। ফোন দিয়ে সময় করে চলে এসো।
৩. ২৫ জুলাই মঙ্গলবার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরে প্রথম ক্লাস। এখানে প্রত্যেকের সম্পর্কে প্রত্যেকে জানলো। এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মিডিয়া সম্পর্কে জানা গেলো। থাইল্যান্ডের পে জানালেন, তার পুরো পরিবারই সাংবাদিক। একটি স্থানীয় পত্রিকার সম্পাদক তার বাবা। এছাড়াও থাইল্যান্ডে সামরিক সরকারের অধীনে সাংবাদিকতা চর্চা কেমন চলছে, সেটিও জানালেন।
লাওসের পাতিচিন উঠে এসেছে একেবারে দরিদ্র পরিবার থেকে। এক সময় স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। লেখালেখিকে ভালবেসে চলে আসেন সাংবাদিকতায়। স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়েছে ২৮ বছরের পাতিচিনের। এখন ৬ বছরের এক সন্তানের জনক তিনি। শ্রীলংকার শানিকা তার সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতায় কাভার করেছেন তামিল টাইগারের বিরুদ্ধে তার রাষ্ট্রের যুদ্ধাভিযান। যুদ্ধে ছোট শিশুদের মৃত্যুর দৃশ্যের কথা স্মরণ করে কেঁদে ওঠেন তিনি। ৪: এরই মধ্যে ব্যাংকে যাওয়া আসা শুরু হয়েছে। প্রতিদিন ৪ থেকে ৫ জন বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকে গিয়ে অ্যাকাউন্ট করে আসছেন। তবে সবাই একসঙ্গে ২৬ জুলাই বুধবার গেলাম শ্রম মন্ত্রণালয়ে। এখানে তিন মাস থাকতে হলে এবং বৃত্তির টাকা পেতে হলে এই মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নিতে হবে।
এজেএফ কর্তৃপক্ষ সবকিছু আগে থেকে ঠিক করে রেখেছিলেন। সেখানে গিয়ে কূপন নিয়ে সবাই একে একে ছবি তুলে নেই। আমাদের হাতে কাগজের পাশ ধরিয়ে দেয়া হলো, ভিজিটিং স্কলার। মালয়েশিয়ার আকি বললেন, এটা যে কারো জন্য সৌভাগ্যের। সিঙ্গাপুরে ভিজিটিং স্কলারের সম্মান অনেক।
এদিন আর কাজ নেই। সবাই দলবেঁধে ঘুরতে গেলাম লিটল ইন্ডিয়ায়। ২২ ডলার রিচার্জ করা ট্রান্সপোর্ট কার্ড দিয়েছিল এজেএফ কর্তৃপক্ষ। এমআরটি'তে লিটল ইন্ডিয়া স্টপেজে নেমেই চোখে পড়ে দক্ষিণ ভারতীয়দের খাবারের দোকান। দোসা খেয়ে উৎফুল্ল চায়নিজ তরুণীরা। তবে সবার জন্য এ খাবার সুস্বাদু ছিল না।
৫. ২৭ জুলাই বৃহস্পতিবার সকালে উঠেই ব্যাংকে চলে গেলাম। সকাল ৮টা ৪৫মিনিটে ডিবিএস ব্যাংকের এনইউএস ব্রাঞ্চে থাকার কথা। তবে কংও সঙ্গে যাবে বলে ওর জন্য অপেক্ষা করতে হলো কিছুক্ষণ। দেরি হয়ে গেলো। আগেই অনলাইনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে গেলে ভালো। আমাদের দেশে ব্যাংকগুলোতে ঢুকতে এখনো ভয় পাই। তা সরকারি হোক বা বেসরকারি। কেমন জানি মনে হয়, তারা সাধারণের মতো নয়। তবে সিঙ্গাপুরের ব্যাংকের অভিজ্ঞতা ভিন্ন। ব্যাংকের গার্ডের কাজটি করেন ব্রাঞ্চ ম্যানেজার। হাতে হাতে টোকেন তুলে দেয়া, নির্দিষ্ট অফিসারের সঙ্গে বসিয়ে দেয়া, অফিসারকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা এবং একটা হাসি উপহার। এখানে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে শুরু করে এটিএম কার্ড হাতে তুলে দেয়া হলো ২০ মিনিটের মধ্যে। কিভাবে টাকা জমা দিতে হয় এবং টাকা তুলতে হয়, শিখিয়ে দেয়া হলো। ব্যাংকের ম্যানেজার ঘুরে বেড়াচ্ছেন টেবিল থেকে টেবিলে।
৬. শুক্রবার ২৮ জুলাই, সকালটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে ৪০ লক্ষ বইয়ের লাইব্রেরি ঘুরে দেখার জন্য। এনইউএস'এর সেন্ট্রাল লাইব্রেরি ৬তলা। এটা শুধু ঘুরে দেখতেই ১ দিনের বেশি সময় প্রয়োজন।
বিকেলে সবাই মিলে গেলাম আরব স্ট্রিটে। এখানকার সুলতান মসজিদের নির্মাণশৈলী সবাইকে মোহিত করলো। তবে ভেতরে প্রবেশ করতে না পারায় মনে খেদ থেকে গেল সবার। হাজী লেনের লাইভ মিউজিক উপভোগ করলো সবাই।
আমার নিজের একটি ব্যক্তিগত দক্ষতা রয়েছে। সেটা হচ্ছে মানুষকে নকল করা। আর মানুষকে নিয়ে গান বানানো। সবার মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জনের এইতো সুযোগ। আর বাংলা গান সম্পর্কে এখানে ধারণা নেই সহপাঠীদের। তাদের বললাম লালনের কথা, রবীন্দ্রনাথের কথা। মুগ্ধ হয়ে শুনলেন সবাই। রাত করে কেন্ট ভেলে ফিরলাম সবাই। বাসে ফেরার সময় পে'র সিঙ্গেল মাদার হওয়ার ইচ্ছে এবং কোরিয়ান ছেলেদের প্রতি আকর্ষণের গল্প ছিল মজাদার। তবে বোলা জানালো মঙ্গোলিয়ান ছেলেরা অনেক বেশি শক্তিশালী। আর দক্ষিণ এশিয়ার ছেলেদের মতো রোমান্টিক যে আর কেউ হয় না সেটা সবারই জানা।
৭. ২৯ জুলাই শনিবার ছুটির দিন। কী করবো ভাবিনি। সকালের নাস্তা সেরে রুমে ফিরলাম। অনেকেই ঘুরতে বেরিয়েছে নিজের মতো। চৈতন্য তার খালার বাসায় বেড়াতে গেলেন। ফেসবুকে দেখলাম পে যাচ্ছে ন্যাশনাল গ্যালারিতে। জাপানের চিত্রশিল্পী কুসামার প্রদর্শনী দেখতে। গুগলে কুসামার কাজ দেখে আমারো দেখতে যাওয়ার ইচ্ছে হলো।
পে'র সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো ক্লিমেন্তি এমআরটি স্টেশনে। দুজনে সেভেন ইলেভেন থেকে কিছু কিনে পেটে দিলাম। ন্যাশনাল গ্যালারির টিকেট কাউন্টারে না গেলে বুঝতাম না এখানকার মানুষ কতটা শিল্পপ্রিয়। মোট তিনটি গ্যালারি ঘুরতে হলে খরচ করতে হবে ৩০ ডলার (১৮০০ টাকা)। পুরো একটা ছুটির দিন কাটাতে কিনলাম টিকেট।
কুসামা নিজের জীবনকে বসিয়েছেন নিজের ক্যানভাসেই। শৈশব এবং কিশোরের মায়া আর স্মৃতি তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। ৬০ এর দশকের গোড়ায় পুরো দুনিয়াকে নাড়া দেয় কুসামার চিত্র। একজন কিশোরীর জীবন ঘিরে যে টানা পোড়ন চলতে থাকে, বেড়ে ওঠার গল্প ছুঁয়ে যায় সবার হৃদয়।
বাংলাদেশ সময়: ১২১১ ঘণ্টা, আগস্ট ০৫, ২০১৭
এমএন/জেএম
ভারতীয় খালা বলেই খাবারের দাম দিলেন